Select Page

‘নকল’ ধরি ঘরের, ধরি না বাহিরের

‘নকল’ ধরি ঘরের, ধরি না বাহিরের

পৃথিবীর চলচ্চিত্র, সংগীত ইন্ডাস্ট্রিতে এক নম্বর বা শীর্ষ চোরের স্থান দখল করে আছে কারা বলত পারবেন? না বাংলাদেশ নয়। তাহলে শুনুন, ফেসবুকে অতীতেও দেখেছি এবং বর্তমানেও দেখছি অসংখ্য সুশীলদের আমাদের চলচ্চিত্র, গান নিয়ে ভারতের অমুক সিনেমা কিংবা তমুক গানের নকল বলে চিৎকার তোলে। তাদের চিৎকারে মনে হয় নকল করে করেই বুঝি আমাদের চলচ্চিত্র, সংগীত চলছে। অথচ এই নকলবিরোধীদের ভারতীয় চলচ্চিত্র কিংবা গান নকল নিয়ে কখনও কোন কথা বলতে দেখি না।

এক.

হিন্দি সিনেমা কি পরিমাণে নকল করে তা বুঝাতে একটি সিনেমা দিয়ে বুঝাতেই যথেষ্ট। বলিউডে এমনও সিনেমা আছে যে সিনেমার গল্প কপি করা হয়েছে হলিউড থেকে আর সিনেমার ৬টি গানের সবগুলো গানই ছিলো হুবুহু অন্য দেশের বা অন্য ভাষার গানগুলোর হুবুহু সুর কপি / নকল করে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো আমির খান ও মনীষা কৈরালার সুপারহিট ‘Maan’.

সিনেমাটি যার গল্পটা নকল করা হয়েছিলো ১৯৫৭ সালে নির্মিত হলিউডের বিখ্যাত ‘An Affair to Remember’ সিনেমা থেকে। সিনেমার ৬ টি গানই সেসময় দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো কিন্ত শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবগুলো গানই ছিলো নকল সুরের। মালয়েশিয়ার পপষ্টার ইভানের ‘yang sedang sedang’ গান নকল করে ‘ধিনাক ধিন তানা’, আলজেরিয়ান পপষ্টার তাহার ‘Ya Rayah গান নকল করে ‘কালি নাগিন য্যাসা কালি কালি’, ইটালিয়ান পপষ্টার টটো কুন্তিয়ানোর ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত জনপ্রিয় ‘Italiano’ গানটি নকল করে ‘নেশা ইয়ে পেয়ার কা নেশা হ্যায়’, ইটালিয়ান ব্যান্ড রিচি এন্ড প্রভেরীর ‘Come Vorreri’ গানের সুর থেকে ‘খুশি অর গম’, ইউরোপীয়ান ব্যান্ড ‘Jars to Clay’ এর ‘liquid’ গানের সুরে ‘ক্যাহেনা তুমসো ক্যাহেনা’ এবং তামিল একটি সিনেমায় হরিহরণ ও সুজাতার কন্ঠের জনপ্রিয় ‘Ettho Oru Patto’ গানটির সুরে ‘চাহা হ্যা তুজকো’ গানটি নকল করা হয়। উল্লেখ্য যে ইটালিয়ান পপষ্টার টটোর গানটি অনেকে ভুলে গেলেও নতুন করে আবারও সামনে আসে ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ী ইতালি ফুটবল দলকে সম্বর্ধনা দেয়া অনুষ্ঠানে টটো গানটি নতুন করে পরিবেশনা করলে।

অর্থাৎ হলিউড, ইতালী, আলজেরিয়া, মালয়েশিয়া ও তামিল থেকে কপি করা গল্প ও গান নকল করে ভারতীয় ও আমাদের দেশের দর্শকদের মন জয় করা সিনেমা হলো বলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেতা আমির খানের মান। আরও মজার ব্যাপার হলো যে মান সিনেমার সংগীত পরিচালক ছিলেন বলিউডের বহু জনপ্রিয় (নকল সুরের) গানের সুরকার জুটি ‘নাদিম-শ্রাবণ’ এর শ্রাবণের পুত্র। ৯০ দশকে বলিউডের এই নাদিম শ্রাবণ জুটি আমাদের গানও কপি করে সুপারহিট হয়েছিলেন। এই হলো আমাদের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে থাকা ইন্ডাস্ট্রি হিন্দি সিনেমা ও গানের অবস্থা।

দুই.

এই ভারতপ্রেমী যারা তারা কি কলকাতার রূপবান, ঝিনুকমালা, নিস্পাপ, অপেক্ষা, বৌমা, আক্রোশ, সত্য মিথ্যা, প্রেমের প্রতিদান, বন্ধু আমার, পিতা মাতা সন্তান, বাংলার বধু’র মতো ছবিগুলো দেখেছিলেন? উপরে উল্লেখিত ছবিগুলোর মতো আরও অসংখ্য কলকাতার বাংলা ছবি আছে যা ছিল বাংলাদেশের ছবিগুলোর হুবহু নকল। পার্থক্য শুধু একটাই, বাংলাদেশের ছবিগুলোর প্রধান চরিত্রগুলো ছিল মুসলিম আর কলকাতার ছবিগুলোর প্রধান চরিত্রগুলো ছিল হিন্দু। বাদবাকি সব বাংলাদেশের ছবির। কাহিনী, সংলাপ, চিত্রনাট্য, গান সবকিছু বাংলাদেশের হুবহু।

কিন্তু কলকাতার প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের মূল চলচ্চিত্রের সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সত্ত্ব নিয়েছিল বলে কোনদিন শুনি নাই বা দেখিও নাই। বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সফলতা পাওয়া ছবিগুলোকে কলকাতা নকল করে মুক্তি দিতো। অনেকে বলতে পারেন যে সেগুলো ‘নকল’ নয় ‘রিমেক’। আমি ‘নকল’ শব্দটা ব্যবহার করেছি কারণ বাংলাদেশের মূল প্রযোজনা সংস্থা থেকে অনুমতি না নিয়ে পুরো ছবিটাই মেরে দেয়ার কারণে।

রিমেক হলো আমি কোন দেশের ছবিকে আমার নিজ দেশে তৈরি করার জন্য মূল ছবির প্রযোজনা সংস্থার শর্ত মেনে অনুমতি নিয়ে তৈরি করা। অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য ছবিটির সর্বসত্ত্ব লাভ করে নির্মাণ করার নাম হলো রিমেক। আবার নিজদেশের কোন পুরনো ছবিকে পুনরায় নির্মাণের জন্য প্রথম ছবিটির প্রযোজনা সংস্থা থেকে অনুমতি নিয়ে পুনরায় নির্মাণের নামও রিমেক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘স্বজন’, ‘আমার ঘর আমার বেহেশত’ ছবিগুলো ছিল রিমেক। এর বাহিরে যে ছবিগুলো ভারতীয় ছবির গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হয়েছিল সেগুলো ‘নকল’।

কলকাতা একদিন আমাদের ছবি দিয়ে নিজদেশের দর্শকদের ধরে রাখার চেষ্টা করতো। সেদিন কলকাতার ছবির চেয়ে আমরা ছিলাম এগিয়ে। কিছু কিছু জায়গায় বলিউডের হিন্দি ছবির চেয়েও আমাদের ছবিগুলো এগিয়ে ছিল। সেই সময় ভারতের ছবি যেমন আমরা নকল করেছি, আমাদের ছবিও ভারত নকল করেছিল। নকলের দিক দিয়ে ভারত সর্বদা এগিয়ে ছিল এবং এখনও আছে। তারা হলিউডের ছবিগুলোকে দেদারছে নকল করতো ,করছে এখনও।

এই কদিন আগেও প্রিতমের সুরে ‘বেশরম’ ছবির ‘বেত্তমিজ দিল’ গানটিও ছিল অঞ্জন দত্তের ‘রঞ্জনা’ গানটির সুরের অনুকরণ। এই ক্ষেত্রে প্রীতম অঞ্জন দত্তের কোন অনুমতি নেয়নি। নকল হলেও গানটি শোনা থেকে আমাদের দেশের ভক্তরাও বাদ পরেনি। আমাদের দেশেও গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই ক্ষেত্রে আমাদের বাংলাদেশের শ্রোতারা কেউ বলেনি ‘নকল গান শুনবো না’। কিন্তু ঐ একই কাজ যদি বাংলাদেশের কোন ছবিতে হতো তাহলে আমাদের নকল প্রতিরোধ দর্শকগুলো চিৎকার করে উঠতেন। অথচ হিন্দি সিনেমার ১০টির মধ্য ৯টি সিনেমাই থাকে নকল।

তিন.

আমাদের দেশে নকল ছবি আগে যেমন হয়েছিল ঠিক তেমনি তার চেয়ে বেশি মৌলিক গল্পের ছবিও হয়েছিল । সেই কারনে সেই সময়ে এই বিষয়টা মহামারী আকার ধারন করেনি । ‘দোস্ত দুশমন’, ‘ এক মুঠো ভাত’, ‘নিশান’, ‘বারুদ’, ‘আসামী হাজির’, ‘রাম রহিম জন’, বজ্রমুষ্টি’, ‘ক্ষতিপূরণ’, ‘সারেন্ডার’, ‘বিজয়’, ‘মরণের পরে’, ‘দোলনা’ ছবিগুলোর মতো নকল কিন্তু ভালো ছবি এদেশে হয়েছিল । ‘সারেন্ডার’, ‘ক্ষতিপূরণ’, ‘দোলনা’,’মরনের পরে’, ছবিগুলো জাতীয় পুরস্কারও লাভ করেছিল। ‘বারুদ’, ‘আসামী হাজির’, ‘দোস্ত দুশমন’, ‘বজ্রমুষ্টি’ ছবিগুলোর কথা আজো দর্শক ভুলতে পারেনি। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় যে ‘বারুদ’, আসামী হাজির’, ক্ষতিপূরণ, সারেন্ডার, বিজয় , বজ্রমুষ্টি ছবিগুলোর টাইটেলে শুরতেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল ‘একটি বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত’। দর্শকদের আর কষ্ট করে বুঝতে হতো না ছবিটি নকল না মৌলিক ।

‘নকল’ ছবি আপনি একদিনে হুট করে কমিয়ে আনতে পারবেন না। কারন আমাদের মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে আগে মেধাবীরা পরিচালনা করতেন, কাহিনী লিখতেন সেই মেধাবী এখন শূন্য । তাই আপনি বর্তমানের কাছ থেকে বেশি বেশি মৌলিক গল্পের ছবি আশা করতে পারেন না।

এই ক্ষেত্রে আমরা যারা দর্শক তাদেরও দায় এড়ানো সম্ভব নয়। কারণ আপনি ঘরে বসে বিদেশি নকল ছবি দেখবেন আর সেটার প্রশংসা করে ফেইসবুক, ব্লগে লিখবেন তাতে তো আমাদের আজকের মেধাশূন্য পরিচালক ও কাহিনীকাররা সাহস/উৎসাহ পাবেই নকল ছবি তৈরি করার। একজন শিক্ষক যখন নকলের বিরুদ্ধে থাকেন তখন তিনি শুধু তাঁর নিজ স্কুল/ কলেজের শিক্ষার্থীদের হাতেনাতে নকলে ধরেন না তাঁর চোখের সামনে যে কোন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের নকল করতে দেখলে বাধা দেন।কারণ নকলের বিরুদ্ধে থাকাটাই তাঁর আদর্শ সে যেই হোক না কেন।

আমরা বাংলাদেশের ছবি বেলায় যত দোষ ধরতে পটু বিদেশি ছবির বেলায় আমরা অন্ধ। আমরা বাংলাদেশের নকল ছবি দেখবো না অবশ্যই তা ভালো উদ্যোগ কিন্তু এই ‘দেখবো না’ নীতিটি কি আমরা বিদেশি নকল ছবির বিরুদ্ধে থাকতে পারি না? আমরা যদি ঘর থেকেই নকল ছবি দেখা বন্ধ করতে পারি সেটার সুফল কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পে এসে পরবে এটা আপনি নিশ্চিত হতে পারেন। কারণ একজন প্রযোজক, পরিচালক, কাহিনীকার যখন জানবে দর্শক এখন নকল গল্পের বিদেশি ছবিও দেখে না তাহলে নিজেদের ছবিকেও নকল কাহিনী মুক্তো করতে বাধ্য হবে। আপনাকে নকল ছবির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হলে আপনার নিজের অভ্যাসটা আগে পরিবর্তন করতে হবে তা না হলে আপনার ‘আদর্শ’ র মাঝে খুঁত আছে যে খুঁত নিয়ে আপনি নকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারেন না ।


মন্তব্য করুন