Select Page

রিভিউ: নবাব, রাজনীতি ও বস টু

রিভিউ: নবাব, রাজনীতি ও বস টু

ঈদ-উল-ফিতর ২০১৭-তে মাত্র তিনটি ছবি মুক্তি পেয়েছে – নবাব, বস টু এবং রাজনীতি। এর মধ্যে দুটি ছবিই যৌথ প্রযোজনার ছবি (নাকি যৌথ প্রতারণার ছবি?) সম্পূর্ণ দেশী ছবি মুক্তি পেয়েছে মাত্র একটি – বুলবুল বিশ্বাস পরিচালিত শাকিবঅপু অভিনীত রাজনীতি। একজন সিনেমাখোর হিসেবে সব ধরনের চলচ্চিত্রই আমি দেখতে আগ্রহী। ঈদের তিনটি ছবিই আমি দেখেছি। সবার অনুরোধে এই তিনটি ছবির পূর্ণাঙ্গ রিভিউ লিখলাম।

১. বস-২: ব্যাক টু রুল

ধরণঃ ক্রাইম এ্যাকশন থ্রিলার
পরিচালকঃ রাজেশ কুমার যাদব (বাবা যাদব) ও আব্দুল আজিজ
কাস্টঃ জিৎ (সূর্য্য), শুভশ্রী (রুশা রয়), নুসরাত ফারিয়া (আইশা), ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত (বিদ্যুৎ সিভালকার), অমিত হাসান (প্রিন্স শাহনেওয়াজ হুসেইন)

নামকরণ

২০১৩ এর বস-বর্ন টু রুল এর সিক্যুয়েল বা ধারাবাহিক গল্প হিসেবে ছবির নাম বস রিটার্ন্স বা বস ওয়ান্স এগেইনও রাখা যেত। তবে বস-২: ব্যাক টু রুল নামটাই পারফেক্ট ছিল।

কাচিস (কাহিনী+চিত্রনাট্য+সংলাপ)

বস এর প্লেইন সিক্যুয়েল হিসেবে বস এর কাহিনী যেখানে শেষ হয়েছে বস-২ এর কাহিনী সেখান থেকেই শুরু হয়েছে। তবে এর মাঝে বিরাট প্লটহোল রয়ে গেছে। কারণ বস সিনেমাতে সূর্য্য বিজনেস ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে সারা ভারতজুড়ে তার সাম্রাজ্য ছড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বস-২ তে এসে দেখা গেল “সূর্য্য ফাউন্ডেশন” এর জন্য সূর্য্যকে আবার নতুন করে সব প্রতিষ্ঠা করতে হচ্ছে। দুই ছবির মাঝখানে এমন কি ঘটেছিল যার কারণে সূর্য্যকে বস এর পুনরাবৃত্তি করতে হয়েছে সেটা স্পষ্ট করা হয়নি।

বস সিনেমার গল্প হুবহু কপি হলেও চিত্রনাট্যের ভিন্নতার কারণে বস-২ কে মৌলিক গল্পের ছবি বলেই মনে হবে। তবে এটা অনস্বীকার্য যে এই ছবির গল্পের থিম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রথমার্ধ (Conspiracy) তামিল মুভি Sivaji (2007) এবং দ্বিতীয়ার্ধ (Rescue & Revenge) ইন্দোনেশীয় মুভি The Raid (2011) [যেটা আবার হিন্দি Commando 2 The Black Money Trail (2017) কেও ইন্সপায়ার্ড করেছে] এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।

সংলাপগুলো মোটামুটি ভাল ছিল এবং অন্য সবার চেয়ে ভরাট কণ্ঠের অধিকারী জিতের মুখে সাধারণ সংলাপগুলোও গাম্ভীর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। তবে বাংলাদেশী ব্যবসায়ী প্রিন্স শাহনেওয়াজ হুসেইন চরিত্রে অমিত হাসান ও বাংলাদেশের পুলিশদের মুখে আঞ্চলিক সংলাপ বলিয়ে বোঝানো হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ শুধুমাত্র অশুদ্ধ ও “বাঙ্গাল” ভাষাতেই কথা বলে। যা বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর জন্য অপমানজনক।

এই অংশ পাবে ১০০তে ৪৫।

টীমওয়ার্ক

নিঃসন্দেহে এই ছবির প্রধান চরিত্র বস সূর্য্য ওরফে জিৎ একজন জাত অভিনেতা এবং একথা এই সিনেমার ক্ষেত্রেও সত্য। তবে এর চেয়েও চরম সত্য এই যে, বস সিনেমায় জিৎ “সূর্য” চরিত্রে এর অরিজিনাল মুভি “বিজনেসম্যান” এর মহেশ বাবুর রাফ এন্ড টাফ আউটলুক আর ডায়লগ ডেলিভারি স্টাইল প্রায় হুবহু ফলো করেছিলেন বলে হয়তো চরিত্রটির গভীরতা ফুটিয়ে তোলা সহজতর হয়েছিল। কিন্তু “মৌলিক” স্ক্রিপ্টের জন্য হয়তো বস-২ তে চরিত্রটির স্বকীয়তা বজায় ছিল না।

শুভশ্রী গাঙ্গুলীর করা রুশা চরিত্রটির গুরুত্ব তুলনামূলক কম হলেও পারফর্ম্যান্স ভাল ছিল। ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভবত তার ক্যারিয়ারের সর্বাপেক্ষা চ্যালেঞ্জিং (এবার রোমান্স ছাড়াই নাচগান সাথে এ্যাকশন) চরিত্র আইশা’কে ফুটিয়ে তুলতে নুসরাত ফারিয়া যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন এবং তা জারি রাখলে ভবিষ্যতে এরচেয়েও ভাল ককরবেন বলে আশা করা যায়।

বিদ্যুৎ সিভালকার চরিত্রে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত বরাবরের মত ভাল কাজ উপহার দিলেও এ্যাকশন দৃশ্যে তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ খুবই দুর্বল ছিল। এছাড়া প্রিন্স শাহনেওয়াজ হুসেইন চরিত্রে অমিত হাসান, মেয়র গোপীনাথ চরিত্রে সুপ্রিয় দত্ত ও পুলিশ কমিশনারের চরিত্রে চিরঞ্জিত চক্রবর্তীসহ বাকি সকলেই নিজেদের চরিত্রের ধরণ ও ব্যাপ্তি অনুযায়ী ভাল কাজ উপহার দিয়েছেন। তবে দুঃখের ব্যাপার বরাবরের মত এই যৌথ প্রযোজনার সিনেমাতেও বাংলাদেশের শিল্পীরা অবহেলিত হয়েছেন। মূল্যহীন ও নামমাত্র চরিত্রে নাদের চৌধুরী ও সুষমার উপস্থিতি সেই কথারই প্রমাণ দেয়।

পরিচালক আব্দুল আজিজের (!) কোন একক কাজ আমি দেখিনি, তাই তার সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে পারছি না। এ্যাকশন সিনেমা নির্মাণে পরিচালক রাজেশ কুমার যাদব ওরফে বাবা যাদব বরাবরের মত যত্ন নিয়ে কাজ করেছেন। তবে বেশকিছু বিষয়ে তার আরো হোমওয়ার্ক করার দরকার ছিল বলে প্রতীয়মান।

এই অংশ পাবে ১০০তে ৬৫।

কারিগরি

সিনেমাটির সবচেয়ে পজিটিভ কারিগরি দিক হচ্ছে সিনেমাটোগ্রাফি ও লোকেশন সিলেকশন। লাইটিং কোয়ালিটি ভাল ছিল, তবে কর্তৃপক্ষের উচিৎ ছিল মফস্বলের সিনেমা হলগুলোর কথা মাথায় রেখে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের লাউডনেস একটু সীমিত রাখা, কারণ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের আধিক্যের কারণে অনেক সংলাপ স্পষ্ট শুনতে ও বুঝতে সমস্যা হয়েছে। এরাঞ্জমেন্ট, সেটআপ, গেটআপ, মেকআপ, স্পেশাল এফেক্টসহ আনুষঙ্গিক কারিগরি দিকগুলো ভাল ছিল, তবে কিছুক্ষেত্রে ভুল পরিকল্পনার কারণে এগুলো অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করে স্বাভাবিকতা নষ্ট করা হয়েছে। (যেমন বাংলাদেশের মাজারের প্রেক্ষাপটে আফগানি স্টাইল ও পোশাকে “ইয়ারা মেহেরবান” গানটি।) দুঃখের ব্যাপার বাংলাদেশী কারিগরি প্রপঞ্চ যে এই সিনেমাতে ১০%ও ব্যবহার করা হয়নি ছবিটি দেখে সহজেই অনুমেয়।

এই অংশ পাবে ১০০তে ৬০।

বিনোদন

ক্রাইম এ্যাকশন থ্রিলার ঘরানার ছবিগুলোতে সাধারণত রোমান্স ও কমেডির পরিমাণ কম থাকলেও বিনোদনের কোটা পূরণ করে এ্যাকশন আর গল্পের থ্রিল বা টুইস্ট। এই সিনেমাতে বেশিরভাগ টুইস্ট পূর্ব থেকে অনুমেয় হলেও এ্যাকশন দৃশ্যগুলো ছিল প্রশংসনীয়। বিশেষ করে চেজিং সিকোয়েন্সগুলো ছিল দুর্দান্ত। তবে সেই তুলনায় ক্লাইম্যাক্সের ফাইটিং সিকোয়েন্স যথেষ্ট দুর্বল ও ব্যাকডেটেড ফর্মুলার ছিল। রোমান্টিক, টাইটেল আর আইটেম; এই তিন ধাঁচের মোট তিনটি গান সিনেমাতে আছে। যেগুলো বস ফ্রাঞ্চাইজিফ্রাঞ্চাইজি বা জিৎ গাঙ্গুলীর কম্পোজিশন হিসেবে আহামরি কিছু না। কোরিওগ্রাফি মোটামুটি ভাল হলেও সঙ্গীতায়োজনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের কলাকুশলীদের উপেক্ষা করার ব্যাপারটি আপত্তিজনক।

এই অংশ পাবে ১০০তে ৫৫

ব্যক্তিগত

একজন বাংলাদেশী দর্শক হিসেবে প্রতিবারের মত এবারো এমন মনমানসিকতা নিয়ে ছবিটি দেখতে হলে গিয়েছিলাম যে, অন্তত এই সিনেমাটিতে আমাদের দেশের বিষয়াবলী যৌথ প্রযোজনার নিয়মানুযায়ী সমান গুরুত্ব পাবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। এত কাস্টিংওয়ালা ছবিতে বাংলাদেশ থেকে বলার মত মাত্র ২ জন। প্রায় ১৫০ মিনিটের ছবিতে বাংলাদেশ আছে মাত্র ১৫ মিনিটেরও কম। নাচে, গানে, এ্যাকশনে নেই বাংলাদেশের চিহ্ন। যাহোক, সব না পাওয়ার মধ্যেও পাওয়া হলো, দর্শকদের আপত্তির মুখে “আল্লাহ মেহেরবান” নামের বিতর্কিত গানের লিরিক্স পরিবর্তনের মাধ্যমে ধর্মীয় আবেগের ভাবমূর্তি সমুন্নত থাকা।

এই অংশ পাবে ১০০তে ৩৫। রেটিং: ৫ এ ২.৬।

বস টু ছবিটি কেন দেখবেন

এ্যাকশন থ্রিলার মুভি, জিৎ/শুভশ্রী/ফারিয়া বা ভারতীয় বাংলা সিনেমা (যেখানে দুয়েকজন বাংলাদেশী শিল্পীকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়); এগুলোর যেকোন একটি আপনার ভাল লাগলে সিনেমাটি হলে গিয়ে দেখতে পারেন। আশা করি আমাদের সিনেমার কর্তাব্যক্তিরা ভবিষ্যতে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে সম্মান জানাবেন বাংলাদেশকেও। নাই মামার চেয়ে যেমন কানা মামা ভাল, তেমনি দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়ালও ভাল।

২. রাজনীতি

ধরণঃ- পলিটিকাল থ্রিলার
পরিচালকঃ- বুলবুল বিশ্বাস
কাস্টঃ- শাকিব খান (অয়ন হাবিবুল্লাহ), অপু খান (অর্ষা), আ.র. মিলন (শাকিল হাবিবুল্লাহ), আলীরাজ (হাজী হাবিবুল্লাহ), সাদেক বাচ্চু (চাঁদ সর্দার), অমিত হাসান (জব্বার মিয়া)

নামকরণ

ছবির গল্প আবর্তিত হয়েছে পুরাতন ঢাকার দুটি রাজনৈতিক পরিবারের পারিবারিক ও রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের গল্প নিয়ে। সুতরাং “রাজনীতি” নামটিই এই গল্প তথা সিনেমার জন্য শতভাগ মানানসই।

কাচিস (কাহিনী+চিত্রনাট্য+সংলাপ)

ছবির গল্প গড়ে উঠেছে কেপটাউনে বড় হওয়া পুরাতন ঢাকার বনেদী রাজনৈতিক পরিবারের ছোট সন্তান অয়ন হাবিবুল্লাহ (শাকিব খান)কে কেন্দ্র করে, যে বিদেশে আকর্ষণীয় মাইক্রোসফট এর চাকরি ছেড়ে নাড়ির টানে বাংলাদেশে ফিরে ঘটনাক্রমে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন।

এতটুকু থিম শুনে অনেক বিচক্ষণ দর্শক হয়তো এই অয়ন হাবিবুল্লাহ চরিত্রটির সাথে হিন্দি Rajneeti (2010) মুভিতে রনবীর কাপুরের করা সমর প্রতাপ বা হিন্দি Youngistaan (2014) মুভিতে জ্যাকি ভাগ্নানির করা অভিমন্যু কৌল চরিত্রটির মিল খুঁজে পেতে পারেন। তবে আশার ব্যাপার হচ্ছে সিনেমাটি (অন্তত আমার দেখা) কোন দেশি বা বিদেশি সিনেমার গল্প দিয়ে নির্মিত নয়। রাজনীতির মত স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে একটি চমৎকার মৌলিক গল্প উপহার দেওয়ায় এই সিনেমার কাহিনীকার কাম চিত্রনাট্যকার কাম সংলাপ রচয়িতা কাম পরিচালক বুলবুল বিশ্বাসকে আন্তরিক ধন্যবাদ। পলিটিকাল মুভির প্রধান মসলা যে টুইস্টেড স্ক্রিনপ্লে সেটা মাথায় রেখেই তিনি চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন বলে প্রতীয়মান। তবে কিছুক্ষেত্রে তিনি টিপিকাল বাংলা সিনেমার ছক থেকে বের হতে পারেননি বলে মনে হয়েছে।

সিনেমার সংলাপগুলো ছিল প্রাণবন্ত। বুলবুল বিশ্বাসের পাশাপাশি লাভ ম্যারেজ ও বসগিরিখ্যাত আরেক সংলাপ রচয়িতা দেলোয়ার হোসেন দিল আবারো প্রমাণ করলেন পুরাতন ঢাকাইয়া ভাষায় উপভোগ্য সংলাপ রচনায় তার জুড়ি নেই। সিনেমাটিতে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তব রাজনৈতিক কিছু বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলার পরও অতীতের মত বামহাত ঢুকিয়ে সিনেমার ধারাবাহিকতা নষ্ট না করে আনকাট সেন্সর ছাড়পত্র দেওয়ায় সেন্সরবোর্ডকে আলাদাভাবে সাধুবাদ জানাচ্ছি।

এই অংশ পাবে ১০০তে ৭০।

টীমওয়ার্ক

ছবির প্রধান চরিত্র অয়ন হাবিবুল্লাহ ছিল শাকিব খানের এ পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত ২২৫ সিনেমায় মধ্যে অন্যতম ব্যতিক্রমী চরিত্র এবং বরাবরের মত এটাকেও ফুটিয়ে তুলতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। দুঃখের ব্যাপার দেশের সাধারণ দর্শক শাকিব খানের নতুন ক্যারেক্টারের চেয়ে নতুন লুকের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়।

গুরুত্বের দিক দিয়ে শাকিবের পরেই আসে শাকিল হাবিবুল্লাহ চরিত্রে আনিসুর রহমান মিলনের দুর্দান্ত অভিনয়। শুধু এইটুকু বলতে পারি, এই চরিত্রটি মিলন ছাড়া বাংলাদেশের আর অন্যকোন শিল্পী এত রিয়েলিস্টিকভাবে তুলে ধরতে পারতেন বলে আমার মনে হয়না। অর্ষা চরিত্রটি অপু খানের ক্যারিয়ারে কোন নতুনত্ব না আনলেও অপু যে দিনদিন নিজেকে ভেঙ্গে আবার নতুন করে গড়তে চাইছেন এটা প্রমাণিত হয়েছে। অমিত হাসানের চরিত্রটি শেষ দিকে এসে এভারেজে রুপান্তরিত হলেও তার কাজ মোটামুটি ভাল লেগেছে।

এছাড়া আলীরাজ, সাদেক বাচ্চু, শিবা সানু, ডিজে সোহেলসহ সকলেই নিজ নিজ চরিত্রের ধরণ ও ব্যাপ্তি অনুযায়ী ভাল কাজ উপহার দিয়েছেন। একজন তরুন পরিচালকের প্রথম সিনেমার কিছু ভুলত্রুটি ক্ষমাসুব্দর দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ; এই মনমানসিকতা নিয়ে যদি ছবিটা দেখেন, আশা করি অন্য সবার মত পরিচালক বুলবুল বিশ্বাসের কাজও আপনার ভাল লাগবে।

এই অংশ পাবে ১০০তে ৭০।

কারিগরি

কারিগরি দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতির ছবি মানেই হবে বিশাল ক্যানভাস আর বিপুল ম্যানপাওয়ারের সমন্বয়; এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক। এই সিনেমার ক্যানভাস বিশেষ করে সেট এরাঞ্জমেন্ট ভাল হলেও কিছু জায়গায় অপ্রতুল ম্যানপাওয়ারের ব্যবহার দৃষ্টিকটু লেগেছে। সিনেমাটোগ্রাফি মোটামুটি ভাল ছিল, তবে পিকচার কোয়ালিটির মত সাউন্ড কোয়ালিটিও আরো ভাল হতে পারত। মেকআপ, সেটআপসহ আনুষঙ্গিক বিষয়াবলী ঠিকঠাক থাকলেও শাকিব খানের বড় চুলের গেটআপ ও শেষের দিকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অমানানসই রাজনৈতিক পোশাকের ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু ছিল।

এই অংশ পাবে ১০০তে ৫০

বিনোদন

স্বাভাবিক কারণেই পলিটিকাল থ্রিলার মুভিগুলোতে রোমান্স ও কমেডির চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় টানটান উত্তেজনাকর সিকোয়েন্সেস। তবে এই সিনেমাতে থ্রিলিং গল্পের পাশাপাশি বিনোদনের জন্য ছিল ফ্যামিলি ড্রামা, কিছু মোটামুটি ভাল মানের গান, রোমান্টিক ও এ্যাকশন দৃশ্যসমূহ। যদিও কোরিওগ্রাফি আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ভাল ছিল, তবে গানগুলো (বিশেষ করে আইটেম সংটি) আরো ভাল হবে আশা করেছিলাম। এ্যাকশন দৃশ্যগুলো ছিল একেবারেই দুর্বল ও সেকেলে।

এই অংশ পাবে ১০০তে ৫০।

ব্যক্তিগত

সোজা সাপটা কথা, “রাজনীতি” সিনেমা দেখে আমি ব্যক্তিগতভাবে পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত নই। হয়তো আরো ভাল মসলা আশা করেছিলাম। তবে এসবের মধ্যেও পেয়েছি একটি মৌলিক ও ভিন্ন স্বাদের গল্পের স্বাদ, আনিসুর রহমান মিলনের মনে রাখার মত অভিনয় আর সর্বুপরি বুলবুল বিশ্বাসের মত একজন সম্ভাবনাময় পরিচালক। এই সিনেমা সংশ্লিষ্ট সকলের কাছেই ভবিষ্যতে আরো ভাল কাজ উপহার পাবো বলে আশা ব্যক্ত করছি।

এই অংশ পাবে ১০০তে ৬০। রেটিং: ৫ এ ৩

রাজনীতি ছবিটি কেন দেখবেন

মৌলিক গল্পের একটি খাটি বাংলাদেশি বাংলা সিনেমা, যেখানে ফ্যামিলি ও পলিটিকাল ড্রামার সাথে রোমান্স, এ্যাকশন, থ্রিলার সবই আছে এবং প্রায় শতভাগ সপরিবারে দেখার মত পরিচ্ছন্ন ছবি যা আপনার ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে দিতে সক্ষম; আশা করি এই কারণগুলোই আপনার ছবিটি দেখার জন্য যথেষ্ট। সিনেমা হলে গিয়ে দেখুন দেশের সিনেমা। পরিচ্ছন্ন “রাজনীতি” সিনেমার হাত ধরেই দূর হোক দেশীয় সিনেমা নিয়ে সকল নোংরা রাজনীতি।

৩. নবাব

ধরণঃ- কপ এ্যাকশন থ্রিলার
পরিচালকঃ জয়দীপ মুখার্জী ও আব্দুল আজিজ
কাস্টঃ- শাকিব খান (রাজীব চৌধুরী ওরফে নবাব), শুভশ্রী গাঙ্গুলী (দিয়া ব্যানার্জি), মেঘলা মিজান মুক্তা (মেঘলা দাসগুপ্ত), অপরাজিতা আধ্য (মুখ্যমন্ত্রী অনন্যা চ্যাটার্জি), খরাজ মুখার্জী (ডেপুটি চীফ মিনিস্টার অভয় সরকার), অমিত হাসান (কালীচরণ), সাগ্নিক চ্যাটার্জি (এসিপি মাসুদ আখতার), রজতাভ দত্ত (পুলিশ কমিশনার গৌতম দাসগুপ্ত)

নামকরণ

আপনি যদি শখ করে আপনার ল্যাংড়া ছেলের নাম “রোনালদো” বা কালো মেয়ের নাম “সুন্দরী” রাখেন, তাহলে আপনাকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। কিন্তু সিনেমার নামকরণ করার ক্ষেত্রে কিছু প্রটোকল অবশ্যই মানতে হয়। নবাব নাম শুনে যেকেউ ধরে নেবে সিনেমার প্রধান চরিত্রে রুপদানকারী শাকিব খানের নাম ছবিতে নবাব থাকে বলেই ছবির নাম নবাব। সবার ধারণা সত্য। তবে সিনেমাটিতে নায়কের চরিত্রটির মূল নাম ছিল রাজীব চৌধুরী। শুধু নায়িকাই তাকে কয়েকবার অজ্ঞাত কারণে অজ্ঞাতনাম “নবাব” বলে ডাকে, আর তাতেই সিনেমার নাম “নবাব” !!! {ভাগ্যিস নায়িকা নায়ককে জানু, সোনা, বাবু এসব নামে ডাকত না (!)} মূলত বাংলাদেশী দর্শকদের কাছে সহজতর, আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য করার জন্যই সিনেমার নাম “নবাব” রাখা হয়েছে বলে অনুমেয়। কারণ সিনেমার গল্পে নবাব নাম বা শব্দটির কোন বিশেষত্ব বা প্রভাব নেই।

কাচিস (কাহিনী+চিত্রনাট্য+সংলাপ)

সিনেমার ট্রেলার দেখেই অনেক সিনেমাভিজ্ঞ দর্শক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে পুরো সিনেমাটিই আমির খান অভিনীত হিন্দি সিনেমা Baazi (1995) এর কপি। তাদের ধারণা ভুল। আসলে ছবির মাত্র এক-তৃতীয়াংশই Baazi থেকে খুবলিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকি একাংশ একই নায়কের Sarfarosh (1999) ও শেষাংশ কপি করা হয়েছে শাহরুখ খানের সিনেমা Baadshah (1999) {যেটা আবার Nick Of Time (1995) সহ একাধিক আমেরিকান মুভির কপি} এর শেষাংশ থেকে। স্বাভাবিকভাবেই Baazi ও Sarfarosh অংশের চিত্রনাট্যগুলোর নকলাংশ মূল সিনেমাগুলোর মতই সিরিয়াস ধাঁচে করা হয়েছে। তবে ক্রিয়েটিভিটি দেখিয়ে (!) Baadshah এর কমেডি থ্রিলার অংশকে সাসপেন্স থ্রিলার চিত্রনাট্যে রুপান্তরিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে স্ক্রিপ্ট রাইটার (!) পেলে ভট্টাচার্য সাহেব আমাদের আব্দুল্লাহ জহির বাবু সাহেবকেও লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন।

সিনেমা মুক্তির আগে শাকিব খান বলেছিলেন, এই ছবিতে তিনি পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের পুলিশদের প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং এতে বাংলাদেশী পুলিশদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা হয়েছে। এটা এযাবতকালের অন্যতম মিথ্যাচার। কারণ সিনেমাটিতে তার চরিত্র পুলিশ অফিসার শ্রী রাজীব চৌধুরী থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব চরিত্রই পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক। এককথায় পুরো গল্পের স্থান, কাল, প্রেক্ষাপট প্রায় শতভাগই পশ্চিমবঙ্গের। যেখানে বাংলাদেশী আছে কিন্তু বাংলাদেশ নেই। এই না হলে যৌথ প্রযোজনা। সুতরাং বলা যায়, Nabab is a film, of the Indians, by the Indians, for the Bengals (!)

এই অংশ পাবে ১০০তে ২০।

টীমওয়ার্ক

গল্পের প্রয়োজনেই বড় পরিমাণের কলাকুশলী প্রয়োজন হয়েছে এবং প্রায় প্রতিটা ছোট-বড় চরিত্রই জ্বলে উঠে গল্পে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পেয়েছেন। সবচেয়ে পজিটিভ ব্যাপার হচ্ছে প্রায় সবগুলো চরিত্রের শিল্পীরাই এই সুযোগ কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছেন। বলাবাহুল্য সিনেমার নাম ভূমিকায় তথা নবাব চরিত্রে থাকা শাকিব খান এর আগে একাধিক সিনেমায় পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করলেও এই সিনেমার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন অফিসার রাজীব চৌধুরীর চরিত্রটি তাকে নতুন লুকের পাশাপাশি নিজেকে নতুন আঙ্গিকে মেলে ধরার সুযোগও দিয়েছে এবং তিনি সুযোগ হেলায় হারান না সেটা আবারও প্রমাণিত।

শুধু নায়কের সাথে রোমান্স, নাচগান আর “গ্ল্যামার” প্রদর্শন করা সাধারণ নায়িকা নয়, এই সিনেমায় নায়িকা ক্রাইম রিপোর্টার দিয়া ব্যানার্জির চরিত্র ছিল তার চেয়েও বেশি কিছু, এবং শুভশ্রী গাঙ্গুলী তাতে সফলকাম হয়েছেন বলা চলে। ডেপুটি চীফ মিনিস্টার অভয় সরকারের চরিত্রে খরাজ মুখার্জীর সাবলীল অভিনয় প্রমাণ করেছে তিনি শুধু কমেডি নয়, সবধরনের চরিত্রের ভেতরেই ঢুকতে পারেন।

অন্যসব চরিত্রের ভিড়ে যে চরিত্রটি দর্শকদের মনে জায়গা করে নিয়েছে সেটা হলো এসিপি মাসুদ আখতার। সাগ্নিক চ্যাটার্জির দুর্দান্ত অভিনয় এই চরিত্রটিকে দর্শকমনে গেঁথে দিতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া রজতাভ দত্ত, অপরাজিতা আধ্য, বিশ্বনাথ সরকার, অমিত হাসান, মেঘলাসহ বাকি সকলেই নিজ নিজ চরিত্রের ধরণ ও ব্যাপ্তি অনুযায়ী ভাল কাজ উপহার দিয়েছেন।

এবার যৌথ প্রযোজনার দৃষ্টিকোণ থেকে রুপকভাবে বাংলাদেশের শিল্পীদের ভূমিকা দেখি।

অমিত হাসান- একজন ইনডোর সন্ত্রাসী
রেবেকা- একজন জিন্দা লাশ
মেঘলা- একজন বলির পাঠি (পাঠার স্ত্রীলিঙ্গ),
ডাঃ বাবু- একজন সন্ত্রাসী যে ১০ সেকেন্ডের মধ্যেই শহীদ হয়ে যায়,
বাকিরা নাম না জানা পাশিং শট দেনেওয়ালা।

তার মানে এক কথায় শাকিব খান বাদে পুরো সিনেমাতে বাংলাদেশী অন্যকোন শিল্পীরা কোন গুরুত্বই পাননি। কারণ নির্মাতাগোষ্ঠী জানেন এক শাকিবের স্টারডমই যৌথ প্রযোজনার সিনেমায় বাংলাদেশের কোটা পূরণ করতে যথেষ্ট। এটা প্রায় সকলেই জানেন যে পরিচালক (!) হিসেবে এই সিনেমায় আব্দুল আজিজ সাহেবের ভূমিকা (!) কতটুকু। তাই তার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে প্রকৃত পরিচালক জয়দীপ মুখার্জীকে নিয়ে কিছু বলি। শিকারি’র সফলতার পর জয়দীপ সাহেবকে নিয়ে প্রত্যাশা একটু বেশিই ছিল এবং তিনি প্রত্যাশা পূরণে তিনি মোটামুটি সফল। তবে অনেক ছোটখাটো বিষয়ে যত্ন নিতে গিয়ে তিনি যে বড়সড় বিষয়গুলোতে ভুল করেছেন তা সিনেমাটি দেখলেই টের পাবেন।

এই অংশ পাবে ১০০ তে ৭০।

কারিগরি

সম্ভবত কাস্টিং এ খরচ বেশি হয়ে যাওয়ায় কারিগরি দিকগুলোতে বাজেট কিছুটা কম খাটানো হয়েছে। তবে এরাঞ্জমেন্ট মোটামুটি ভাল ছিল। বিশেষ করে সেট ও ম্যানপাওয়ার ম্যানেজমেন্ট, গেট আপ, মেক আপের কাজ ভাল লেগেছে। সিনেমাটোগ্রাফি ও লাইটিং কোয়ালিটি ভাল হলেও সাউন্ড কোয়ালিটি আরো ভাল হতে পারত। লোকেশন আহামরি তেমন কিছু ছিল না। এ্যাকশন দৃশ্যগুলো প্রাণহীন থাকায় তেমন স্পেশাল এফেক্টের কাজও চোখে পড়েনি। সিনেমার শেষাংশের শুটিং যে দয়া করে বাংলাদেশে করা হয়েছে সেটা স্পষ্ট বোঝা গেছে।

এই অংশ পাবে ১০০ তে ৬৫।

বিনোদন

তিনটি সিনেমা থেকে বাছাই করে থ্রিলিং অংশগুলো নিলে গল্পে যে কিছুটা সাসপেন্সের বিনোদন পাওয়া যাবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এটাও স্বাভাবিক যে যারা ঐ তিনটি সিনেমা আগে দেখেছে তাদের জন্য এই “সাসপেন্স” হবে অস্বস্তিকর। স্যাড, রোমান্টিক, ড্যান্সিং, ও আইটেম ; এই চার ধাঁচের ৪টি গান ছিল এবং এক কথায় গানগুলো ও কোরিওগ্রাফি অসাধারণ ছিল। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আরো ভাল হতে পারত। এ্যাকশন দৃশ্যগুলো এ্যাকশন সিনেমাপ্রেমীদের হতাশ করবে। তবে সব মিলিয়ে বিনোদনের মসলা মোটামুটি মানের ছিল।

এই অংশ পাবে ১০০তে ৬০।

ব্যক্তিগত

দুঃখের ব্যাপার আমি উপরে উল্লেখিত মূল তিনটি হিন্দি সিনেমা আগেই দেখে ছিলাম। তাই গল্পের অতশত টুইস্টও আমাকে নাড়াতে পারেনি। তবে মুগ্ধ হয়েছি শিল্পীদের চমৎকার অভিনয় দেখে। সিনেমার গল্প সম্পর্কে শাকিব খানের মিথ্যাচার আমাকে আহত করলেও, তার পারফর্ম্যান্স কিছুটা হলেও শান্ত করেছে। তবে যৌথ প্রযোজনার নামে প্রতিবার বাংলাদেশকে প্রতারিত করা ও একাধিক সিনেমার গল্প জোড়াতালি দিয়ে একটা সিনেমা বানানোর প্রবণতা বন্ধ না হলে একজন বাংলাদেশী সিনেমাপ্রেমী হিসেবে কিছুতেই শান্তি পাবো না।

এই অংশ পাবে ১০০তে ৫৫। রেটিং: ২.৭।

ছবিটি কেন দেখবেন

উপরে উল্লেখিত তিনটি হিন্দি সিনেমা না দেখে থাকলে আমার বিশ্বাস আপনি নবাব দেখে আনন্দ পাবেন। আরো নতুন, আরো ভিন্নধর্মী শাকিব খানকে পাবেন। আর সর্বুপরি ঈদে বিনোদনের অন্যতম খোরাক পাবেন। সিনেমা হলে গিয়ে দেখুন বাংলাদেশের সিনেমা। আপনার আমার হাত ধরেই এগিয়ে যাক আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি।


মন্তব্য করুন