‘পরাণ’ জুড়িয়েছে
একজন দর্শক যখন হাসিমুখে হল থেকে বের হন এবং বলেন যে, তার টাকাটা উসুল হয়েছে; তখন একজন সিনেমাপ্রেমী হিসেবে সত্যিই ‘পরাণ’ জুড়িয়ে যায়
সিনেমা হল থেকে বের হতে হতে একজন তরুণ দর্শক হাসিমুখে তার বন্ধুকে বলছিল, ছবিটা দেখে টাকাটা উসুল হয়েছে।
স্টার সিনেপ্লেক্সে টিকেটের মূল্য ৩০০-৩৫০ টাকা। সঙ্গে পপকর্ণ, কোল্ড ড্রিংকস বা অন্য কোন ফুড আইটেম নিলে খরচটা নেহায়েত কম হয় না। এতো টাকা খরচ করে ছবি দেখে একজন দর্শক যখন হাসিমুখে হল থেকে বের হন এবং বলেন যে, তার টাকাটা উসুল হয়েছে; তখন একজন সিনেমাপ্রেমী হিসেবে সত্যিই পরাণটা জুড়িয়ে যায়।
‘পরাণ’ দেখতে গিয়ে পরাণ জুড়িয়েছে হলভর্তি দর্শক দেখেও। লাস্ট কবে সিনেপ্লেক্সে বাংলা সিনেমার শো-এ এতো বেশি দর্শক দেখেছি তা ভুলে গেছি। ৮০ শতাংশ কিংবা তারও বেশি সংখ্যক দর্শকে পূর্ণ ছিল হল। দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ, উদ্দীপনা ছিল ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। দর্শক ফানি ডায়লগে হেসেছে, মিমের আইরনিক সংলাপে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে; রাজকে দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছে, গানগুলো উপভোগ করেছে।
হলিউড-বলিউডের শত শত কোটি বাজেটের ছবির সঙ্গে তুলনা করলে হয়তো পরাণের বাজেট স্বল্পতা চোখে পড়বে; তবে গল্পে, সংলাপে, নির্মাণে, অভিনয়ে বাংলাদেশি সিনেমা হিসেবে ‘পরাণ’ পয়সা উসুল বানিজ্যিক ছবি হয়েছে। বছরে এ ধরনের ১০-১২টা ছবি তৈরি হলেও বাংলা সিনেমার দুর্দিন কিছুটা হলেও কাটবে।
পরাণ-এর গল্পে রিফাত হত্যাকান্ড অর্থাৎ রিফাত, মিন্নি ও নয়ন বন্ডের চাঞ্চল্যকর ঘটনার প্রভাব আছে। মূলত ছবিটি ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত ওই ঘটনাটি দ্বারাই অনুপ্রাণিত। যদিও রিফাত, মিন্নি ও নয়ন বন্ডের গল্পের সঙ্গে এই গল্পের থিম মিলে যায় তথাপি ‘পরাণ’কে হুবহু ‘রিফাত, মিন্নি ও নয়ন বন্ডের গল্প’ বলার সুযোগ নেই। নির্মাতা রায়হান রাফী মূলত ওই ঘটনাটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একটি ত্রিভুজ প্রেমের গল্প তৈরি করেছেন। যে গল্পে- প্রেমটা আগুন নিয়ে খেলার মতো, যার পরিণতিটা হয় ভয়ংকর।
গল্পে দেখি, অনন্যা অর্থাৎ বিদ্যা সিনহা সাহা মিম কলেজপড়ুয়া সুন্দরী মেয়ে। তার পেছনে ঘুরঘুর করে পাড়ার বখাটে, নেশাখোর রোমান অর্থাৎ শরিফুল রাজ। মিম যদিও রাজের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত; তবে যেহেতু সে ছাত্রী ভালো না এবং পরীক্ষায় বার বার ফেল করে সেহেতু রাজের নানা সাহায্য-সহযোগিতা সে উপভোগ করে। রাজ মিমের সহপাঠীকে, শিক্ষককে ভয়ভীতি দেখিয়ে মিমকে নকল করতে কিংবা পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পেতে সাহায্য করে। রাজ মিমকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ফুচকা খাওয়ায়, তাকে দামী মোবাইল ফোন গিফট করে। মিমও রাজের সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে যায়। এ সময় কলেজের ভদ্র, শান্ত, ভালো ছাত্র সিফাত অর্থাৎ ইয়াশ রোহানকে দেখে মিম তার প্রেমে পড়ে। অনেকটা জোর করেই সে সিফাত অর্থাৎ ইয়াশ রোহানের কাছাকাছি যায়।
এরপর শুরু হয় এক ভয়ঙ্কর গল্প। কীভাবে মিম তার জীবনে ইয়াশ রোহানকে জড়িয়ে নিয়ে রাজকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় এবং তার পরিণতিটাই বা কী হয় সেটাই দেখা গেছে রায়হান রাফীর রোমান্টিক ড্রামা থ্রিলার ‘পরাণ’ – এ।
আমি বারবারই বলে আসছি যে, রাফী এ সময়ের বাংলা বানিজ্যিক সিনেমার সেরা নির্মাতা। একটা বিনোদনমূলক উপভোগ্য ছবি তৈরি করতে যে সব উপাদান দরকার তার সবকিছু রাফীর ছবিতে পাওয়া যায়। যদিও তার গল্প বলার ধরণ এবং নির্মাণ স্টাইল প্রায় সব ছবিতে একই রকম— যা তার একটা বড় লিমিটেশন। তথাপি বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমা যেখানে অত্যন্তই বোকা বোকা, ক্লিশে, হাস্যকর; রাফীর ছবি সেখানে গল্পে, চিত্রায়নে, গানে রুচিশীল ও উপভোগ্য।
এতো স্বল্প বাজেটেও সে যতটুকু দেখাতে সক্ষম সেটি বাংলা সিনেমায় সচরাচর পাওয়া যায় না।
মোটামুটি ভালো বাজেট পেলে রাফি বলিউডের ছবিকে টেক্কা দিতে সক্ষম।
‘পরাণ’ রাফীর আগের দুই ছবি ‘পোড়ামন ২’ এবং ‘দহন’ থেকে হয়তো বাজেটে কিংবা গ্ল্যামারে পিছিয়ে, তবে গল্পে, অভিনয়ে ‘পরাণ’ই এখন পর্যন্ত রাফীর সেরা কাজ।
রাফীর ছবিতে অভিনয় করা মানেই ওই অভিনয়শিল্পীর ক্যারিয়ারে অন্য মাত্রা যোগ হওয়া। ‘পরাণ’– এর কল্যাণে বিদ্যা সিনহা সাহা মিম এবং শরিফুল রাজের ক্যারিয়ারেও যোগ হলো ভিন্ন মাত্রা।
বিদ্যা সিনহা সাহা মিম ছবির প্রধান চরিত্রটি পেয়েছেন এবং আমার মতে, প্রথম ছবি ‘আমার আছে জল’ (২০০৮)- এর পর এতোটা ভালো চরিত্র তিনি পেয়েছেন। পুরো ছবির গল্পই তাকে কেন্দ্র করে ঘরে উঠেছে এবং গোটা ছবি জুড়েই তার সরব উপস্থিতি ছিলো।
তব, সবকিছু ছাপিয়ে পর্দায় যেন বিস্ময় তৈরি করেছেন শরিফুল রাজ। রাজকে তার প্রথম ছবি ‘আইসক্রিম’ (২০১৬) থেকেই ভালো লেগেছে। পরবর্তীতে ‘ন ডরাই’ (২০১৯) এবং ‘গুণিন’ (২০২২) – এও তার কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু ‘পরাণ’ দেখে বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে এ ধরনের একটি চরিত্র করার জন্য রাজের চেয়ে ভালো কোন অভিনেতা নেই। বিশেষ করে বখাটে চরিত্রে তার লুক এক কথায় দুর্দান্ত! এটাই এ বছরে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সিনেমার সেরা পারফরমেন্স- নিঃসন্দেহে।
এটা এরকম ভয়ংকর ও নেগেটিভ চরিত্র না হলে হলফ করে বলা যেত যে, আগামী বছরের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল প্রথম আলো তারকা জরিপ পুরস্কারসহ সেরা সব পুরস্কার রাজ ইতোমধ্যে বুক করে ফেলেছে!
ইয়াশ রোহান বরাবরের মতোই কিউট ছিল দেখতে এবং সে তার স্বভাবসুলভ ন্যাচারাল পারফরমেন্সটিই দিয়েছে। তবে সে খুবই ভালো অভিনেতা যেহেতু- তাই তাকে কিউট, ভদ্র ছেলের চরিত্রে টাইপকাস্ট না করে বরং বৈচিত্রময় চরিত্রে ব্যবহার করলে আমরা বড়পর্দায় আরেকজন ভালো অভিনেতাকে পেতে পারি।
এলাকার লিডার চরিত্রে রোজী সিদ্দিকী বসে বসেই নজর কাড়া একটা পারফরমেন্স দিয়েছেন। মিমের বাবা-মায়ের চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিম এবং শিল্পী সরকার অপুকেও ভালো লেগেছে। তবে একটু বেশি ভালো লেগেছে ইয়াশ রোহানের মায়ের চরিত্রটি।
অন্যদিকে রাজের বন্ধুর চরিত্রে রাশেদ মামুন অপু খুবই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পেলেও এই চরিত্রে তাকে খুব একটা ভালো লাগেনি আমার। তবে দর্শকরা সম্ভবত উপভোগই করেছে তার তোতলামি।
ছবির গানগুলো সুন্দর। তবে ‘চলো নিরালায়’ ছাড়া বাকি গানগুলো মনে রাখার মতো না। রাফীর ছবিতে আরো সুন্দর গান প্রত্যাশা করি।
লোকেশন সুন্দর। আউটডোরের চিত্রায়নও সুন্দর। তবে বেশির ভাগ দৃশ্য ইনডোরে হওয়ায় গোটা ছবি সে অর্থে গ্ল্যামারাস হয়নি। যদিও রাজের দৃশ্যগুলো শুট করা হয়েছে খুবই যত্নের সাথে এবং গ্ল্যামারাসভাবে।
সিনেমা হলের ভেতরে ও বাইরে দর্শকদের রেসপন্স দেখেও ‘পরাণ’ জুড়িয়েছে। দুজন নারী দর্শক সিনেমা হল থেকে হাসিমুখে বের হচ্ছিল। একজন আরেকজনকে বলে – ‘ছবিটা ভালোই লেগেছে; তাই না!’ অন্যজনও ‘হ্যাঁ’ বলে সায় দেয়।
বিশেষ করে শরিফুল রাজকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করে বিস্মিত হয়েছে অনেকেই। দর্শকদের অনেকেই তাকে পরীমনি’র জামাই হিসেবেই চেনে। কিন্তু সে যে এতো ভালো অভিনয় করবে তা হয়তো তারা কল্পনাও করেনি।
যাইহোক, বাংলা বাণিজ্যিক ছবি হিসেবে রায়হান রাফীর ‘পরাণ’কে আমি দিবো – 4*/5