
পুঁজিশাসিত মগজে ‘২ষ’ ও মুসলমান সমাজে ভয়
….
নুহাশ হুমায়ূনের ‘ষ’ বা পেট কাটা ষা-এর তুলনায় দ্বিতীয় সিজন ‘২ষ’ বেটার মনে হয়েছে। নরমালি হরর বললে যে প্যাটার্ন আমাদের মাথায় ঘোরে এ গল্পগুলো সেটার দৈর্ঘ্য আরো বাড়ায়া দেয় সম্ভবত। নুহাশের বানানোর স্টাইলরে রেফারেন্স করা বলা যায়, অবশ্যই রিয়েলিটি নিজেই তো হরর ব্যাপার। নুহাশের ‘ফরেন ওনলি’ দেখলেও বোঝা যায় একটা ধারাবাহিকতা বা সাধনা আছে তার।

যারে আমরা রিয়েলেটি বলতে বুঝি তাতে এমন সব এলিমেন্ট থাকে তা আমাদের জন্য ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে, যারে আলাদা করে আধিভৌতিক বলা লাগে না। আমাদের যাপনের চেয়ে ভয়ংকর আর কী! বরং তাকে ফুটায়া তোলার মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষা লাগে।
নুহাশের এবারের গল্পে হরর এলিমেন্ট আকারে হাজির হইছে পুঁজির শাসন। মন-মগজে। যেটা আবার ধর্মের সঙ্গে ব্লেন্ড করছে। ‘২ষ’-এর উল্লেখযোগ্য দুইটা দিক হলো পুঁজির খাসলত ও ধর্মের মেটাফরের ব্যবহার।
পুঁজিবাদ যে হরর অভিজ্ঞতা নিয়ে হাজির হয় সেটা বেশ ভালোভাবে দেখা গেছে মোশারফ করিমের ‘ভাগ্য ভালো’ অ্যাপিসোডে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, সম্পদ নির্দিষ্ট আর মানুষের অসীম ভোগের লোভ। ফলত সে মূলত অন্যের ধনই চুরি করছে। একইভাবে ওয়াক্তে লোভ কীভাবে ভায়োলেন্সে রূপান্তরিত হয়; তার রূপ দেখা যায়। ভায়োলেন্স ইটসেলস আরো ভায়োলেন্সকে আমন্ত্রণ জানায়। যা একইসঙ্গে এর বিপরীতে মানুষের মধ্যে প্রায়শ্চিতের আকাঙ্ক্ষাকে পুরোপুরি ঝাপসা করে দিতে পারে না; তাকে দেখা যায়। সেখানে হাজির হইছে ধর্ম।
‘অন্তরা’য় শয়তান থেকে সরাসরি হাজির পুঁজিবাদ। যে নিজে কিছুই উৎপাদন করে না; বাট অন্যকে শোষণ করে টিকে থাকে, অন্যের খাসলসকে রসদ হিসেবে গ্রহণ করে, যেটার সঙ্গে ‘ভাগ্য ভালো’র একটা কানেকশন তৈরি করা আছে গল্পে। এই যে পুঁজি তার শাসন তো সব ক্ষেত্রে আছে। এটা শয়তানকে দিয়ে খানিকটা বোঝা যেতে পারে যে শয়তান আসলে কোথায় নাই। কিন্তু সেটা আবার অন্তর্নিহিতভাবে কীভাবে দুর্বল এটা বেশ ইন্টারেস্টিংভাবে উঠে আসছে ‘অন্তরা’র শেষ দিকে। ইভেন ধরেন শেষ পর্ব; ‘বেসুরা’য় দেখা যায় শিল্প-সংস্কৃতি সমাজের মধ্যে এক ধরনের ফেইক ভ্যালু তৈরি করে, যারে সমালোচনা করেও ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছেন যাচ্ছেন। শিল্প নিজে আলাদা নিয়ম করে দিয়ে অন্যায্যতার দলভারি করে। যেমন; ফ্যাসিবাদ যেভাবে ঠিকে থাকে। এই ফেইক ভ্যালুর ক্রিটিক করতে গিয়ে নুহাশ অবশ্য একটা ফেইক সমাজের মধ্যে আমাদের হাজির করেন; যেখানে সমাজটা আসলে এমনই, আমরা দেখি না।

ধর্ম নিয়ে আরা যা বলতেছিলাম… ‘২ষ’ এর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে হরর বলতে আমাদের গল্প উপন্যাস বা ইভেন্ট সিনেমায় ধর্মীয় দিক থেকে দেখলে যে হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্ম রিলেটেড থাকে; যদিও আমাদের কেচ্ছার ভেতর জ্বীন-শয়তান, শুভ-অশুভর মুসলমানি ডাইমেনশন আছে। কিন্তু সমাজে থাকলেও ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী মিথ বা বয়ানের জায়গা থেকে খুব একটা বেশি পাওয়া যায় না। ওই সিরিজের মধ্যে এই জায়গাটা খুব কৌতুহলগ্রাহীভাবে ফুটে উঠছে। কালচারলি অন্য ধর্মের তুলনায় বাংলায় মুসলমানদের হীনমন্য দেখানোর যে প্রবণতা আছে তার তুলনায় মনে হয় মুসলমানরা যে ভয়ও পাইতে পারে তা অদৃশ্য। যেখানে ভয় নাই, সেখানে আসলে কী থাকে? প্রেমও থাকে না।
মানে হলো, গড়পরতার ধারণা বা অচ্যুত করে রাখায় মুসলমান সমাজের গল্পগুলো (যদি কোনো আদিকল্প থাকে তাও) ফুটায়া তোলা একটু কঠিন। এখানে ধরেন ‘ওয়াক্ত’-এর মতো প্রচুর গল্প পাবেন সমাজে, কিন্তু ফিকশনে পাবেন না। কিন্তু সাপ মানুষের রূপ ধরে প্রতিশোধ নিতেছে একই রকম গৌনধর্মের কত গল্প আমাদের সাহিত্য-নাটক-সিনেমা ভরপুর। ‘২ষ’ দেখে মনে হইছে, সেই ওয়াক্ত থেকে বেসুরা; নুহাশ একটা অচলায়তন ভাঙছেন। ‘বেসুরা’য় অবশ্য আদি মাতার যে ধারণা সেটা অনেকগুলো কালচারে থাকা ধারণার মিক্সড। ইভেন পুঁজির পরম হয়ে উঠার বিপরীতে ধর্মের অধিষ্ঠানের আলাপও ইউনিক হয়ে উঠছে অনাভ্যাসের কারণে, নইলে তো গল্প এমনই হয়।
তো, এতদূর পড়ার পর আমার এক বন্ধু একটা মন্তব্য করছে। সেটা এমন ‘এতদিনের বাংলা সাহিত্যে তো নদিয়া আধিপত্যের একটা ব্যাপার ছিল। মিথ বলতে শাক্ত, শৈব উপাদানগুলোই আসতো। কিন্তু নুহাশের গল্পে পূর্ব বাংলার একটা প্রতিধ্বনি আছে। যেহেতু পূর্ববাংলার মানুষ মুসলমান বেশি, তাই তাদের প্রতিনিধিত্ব মানে মুসলিম মিথ ও সংস্কারের প্রতিনিধিত্ব। নুহাশ এদিক থেকে তার বাপের ঐতিহ্য ধরেই আগাইছেন।’ (যার যার প্রাপ্য সে যেন পায়; এ চিন্তা থেকে মন্তব্যটা নিজের ভাষায় লেখা হইলো না।)
গল্প যে আপনারে ঠিক করে দেয় কী করবেন। সম্ভবত ‘২ষ’-এর মধ্যে সেটা পাওয়া যায়। মানে এভাবে ভাবতে পারার মধ্য দিয়ে এভাবে দেখানোর সম্ভাবনা থাকে আরকি!