Select Page

প্রেম, পেশীশক্তি ও মনোযুদ্ধে পূর্ণ ‘পরাণ’

প্রেম, পেশীশক্তি ও মনোযুদ্ধে পূর্ণ ‘পরাণ’

পরাণ’ এককেন্দ্রিক কোনো প্রেমের ছবি না, এটি একের ভেতর অন্যান্য উপাদানের মিশ্রণে নির্মিত মানসম্মত বাণিজ্যিক ছবি

প্রেমের গল্পে এ উপমহাদেশে চলচ্চিত্র সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। প্রেমের গল্প দর্শকের মধ্যে অতীতে সমাদৃত হয়েছে এখনো হয় কিছু কম বা বেশি। শুধুই প্রেম বিষয়ক গল্প হলে আবার ছবি জমে না এর সাথে আরো মসলাদার উপাদান লাগে। রায়হান রাফী নির্মিত ঈদের ছবি ‘পরাণ’ প্রেমের সাথে পেশীশক্তি ও মানসিক দ্বন্দ্বে জমজমাট বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছে।

জনগণের দাবি ‘পরাণ’ বাস্তব ঘটনাসূত্রে নির্মিত। এর কারণ হিসেবে ট্রেলারে যে গল্পের সূত্র দেখানো হয়েছে সেটাই দাবি করার জন্য যথেষ্ট। বরগুনার রিফাত হত্যাকান্ডে মিন্নি-নয়ন বন্ড-রিফাত যেভাবে টক অব দ্য কান্ট্রি হয়ে উঠেছিল তার সাথে ‘পরাণ’ ছবির ট্রেলারে সেই গল্পের আঁচ পেয়েছিল আপামর দর্শক। দর্শকের দাবি তাদের কাছে ঠিক তাদের যুক্তিতে আবার নির্মাতা রায়হান রাফী ছবিতে যে টুইস্ট ব্যবহার করেছেন তার সাথে বাস্তবের গল্পটার সুনির্দিষ্ট দূরত্ব আছে। তাই এটি সরাসরি বাস্তবের গল্প বলাও যাচ্ছে না। কেন বলা যাচ্ছে না বা কী টুইস্টের কারণে বলা যাচ্ছে না সেটা জানতে ছবি দেখতে হবে।

ছবির নাম ‘পরাণ’ কেন! ব্যাকরণিক দিক থেকে বললে ‘প্রাণ’ শব্দের বিকৃত বা চর্চিত হয়ে ভেঙে যাওয়া রূপ হচ্ছে ‘পরাণ’ যাকে বলে অর্ধ-তৎসম শব্দের রূপ। ভালোবাসার মানুষকে ভালোবেসে অনেকেই অনেক নামে ডাকে এবং সেখানে একটা আদুরে ব্যাপার থাকে। ডাকের মধ্যে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে যার মধ্যে ‘জান’ শব্দের বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায় এটা ছেলেমেয়ে উভয়ই উভয়কে বলে থাকে। ঠিক সেভাবেই ‘পরাণ’ বলা হয়েছে যেখানে ছবিতে নায়ক-নায়িকা উভয়ই উভয়কে বলে ‘তুই আমার পরাণ’। ছবির নামের মধ্যে ভালোবাসার গভীর প্রকাশ আছে।

আসা যাক গল্পে। অনন্যা চরিত্রে বিদ্যা সিনহা মিম বারবার পরীক্ষায় ফেল করা একটা মেয়ে। তার জীবনে আসে রাজনীতিতে জড়ানো, নেশাগ্রস্ত, মাস্তান ছেলে রোমান বা শরিফুল রাজ। প্রথমে মিম তাকে ভালো না বাসলেও তার সাথে বন্ধুত্ব করে কিছু শর্তে তারপর এ গল্পে এন্ট্রি করে সিফাত বা ইয়াশ রোহান। গল্প ভিন্নদিকে মোড় নিলে শুরু হয় জটিল মানসিক দ্বন্দ্ব এবং এর থেকেই পরিণতি।

বাণিজ্যিক ছবির পরিবেশন ক্ষমতা যদি ভালো হয় তবে সেটি ওয়েল মেড হতে বাধ্য। পরিচালক রায়হান রাফী এ কাজটি করেছেন। ‘পরাণ’ ছবিতে প্রেমের গল্পে পেশীশক্তির মতো বিষয় আনা হয়েছে এবং মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি করা হয়েছে। মিম-রাজ-ইয়াশের ত্রিভুজ প্রেম স্বতন্ত্রভাবে এমনভাবে পরিবেশন করা হয়েছে যে তাদের তিনজনকেই ভালোবাসার কাঙাল মনে হয়। কিন্তু গল্পের মোড়টা শেষ পর্যন্ত একটি চরিত্রের মানসিক দ্বন্দ্বে চলে যায় যেখানে তার মাধ্যমেই পরিণতি ঘটতে থাকে বাকি চরিত্রগুলোর। এর বাইরে যোগ হওয়া পেশীশক্তির দিকটি ছিল রাজনৈতিক। রাজের চরিত্রটি রাজনৈতিক দলের সাথে যোগসূত্র তৈরি করে। প্রেমের গল্পে কোনো না দিক থেকে পেশীশক্তির প্রভাব থাকে এবং সেটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পারিবারিক বাধাই হয় কিন্তু এ ছবিতে তা ছিল রাজনৈতিক। এসবের বাইরে ছবিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে তদন্ত। তদন্তের মাধ্যমে ফ্ল্যাশব্যাকে ছবির স্টোরি টেলিং এগিয়েছে এবং তদন্তটি ছিল বুদ্ধিদীপ্ত ও বিনোদনধর্মী। এ অংশটিও ‘পরাণ’ ছবিকে এন্টারটেইনিং করেছে।

ছবির তিন প্রধান চরিত্রের মধ্যে বেস্ট পারফর্ম করেছে রোমান চরিত্রের শরিফুল রাজ। তার গেটআপ, মেকআপ, বডি ল্যাংগুয়েজ ও অভিনয় সব মিলিয়ে রাফ ব্যাপারটি ভীষণভাবে বাস্তবিক ছিল। তাকে দেখে বাস্তবেরই মনে হয়েছে। প্রেমিকাকে পাবার জন্য যেমন সে সহজ-সরল ছেলেকে শাসায়, শিক্ষককেও ভয় দেখায়, বীভৎস হয়ে ওঠে আবার নরমও হয়ে যায়। তার পাগলামি এবং ভালোবাসার মানুষকে পেতে নিজেকে ছাড় দেয়া দুটোই তার চরিত্রের সাথে দুর্দান্তভাবে মানিয়েছে। মিম দ্বিতীয় সেরা এ ছবিতে। বর্তমানের বাণিজ্যিক ছবিতে যে ক’জন নায়িকা আছে তাদের মধ্যে মিমের অভিনয়গুণ সবচেয়ে ভালো। তার এক্সপ্রেশনটাই এক্ষেত্রে পার্থক্য গড়ে দেয় বাকিদের সাথে। অনন্যা চরিত্রকে ডমিনেট করেছে মিম। তার চরিত্রে পরিবর্তনশীল একটা বিষয় আছে যা বৈচিত্র্য এনেছে। ইয়াশ রোহান ভদ্র ছেলের ইমেজে যুৎসই, তাকে এমন চরিত্রেই মানায়। তিন প্রধান চরিত্রের পর ছবিতে দর্শকের কাছে এন্টারটেইনিং মনে হবে নাসির উদ্দিন খানের অভিনয়। তার পুলিশি তদন্ত হিউমারে পরিপূর্ণ। এরপর আসবে রাজনৈতিক নেত্রীর চরিত্রে রোজী সিদ্দিকীর কুল অভিনয়। তার মতো ভালো অভিনেত্রীকে কেন এতদিন বসিয়ে রাখা হয়েছে এ ছবিতে অভিনয় দেখলে তাই মনে হবে। অনন্যার বাবা-মার চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিম ও শিল্পী সরকার অপু চমৎকার। শরিফুল রাজের বন্ধুর চরিত্রে রাশেদ মামুন অপুর আঞ্চলিক উচ্চারণে কথা বলার অভিনয় হাসির খোরাক যোগাবে।

টুইস্ট যে কোনো ছবির মোড় ঘুরিয়ে দেবে। ‘পরাণ’-এর শেষের টুইস্টটি ছবিটিকে দর্শকের কিছু ধারণা থেকে আলাদা করে দিয়েছে এটা নিজস্বতা এ ছবির।

ছবির গানের মধ্যে ‘চলো নিরালায়’ ইতোমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। গানটির মধ্যে ভালো রিদম আছে, নায়ক-নায়িকাদের সুন্দর অভিনয়ের পাশাপাশি শিল্পীদের সুন্দর গায়কীও গানটিকে পরিপূর্ণ রোমান্টিক করেছে। বাকি গানগুলোর মধ্যে ‘কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু’ এবং ‘সাজিয়ে গুঁজিয়ে দে মোরে’ হৃদয়স্পর্শী। ব্যাাকগ্রাউন্ড মিউজিক সিচুয়েশন অনুযায়ী পারফেক্ট ছিল; বিশেষ করে ছবির শেষ আধঘণ্টার টান টান উত্তেজনায় ছবির ব্যাাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছিল অসাধারণ। কালার গ্রেডিংয়ের ব্যবহার দর্শকভেদে ভিন্ন মনে হতে পারে।

পরাণ’ এককেন্দ্রিক কোনো প্রেমের ছবি না, এটি একের ভেতর অন্যান্য উপাদানের মিশ্রণে নির্মিত মানসম্মত বাণিজ্যিক ছবি। প্রেম, পেশীশক্তি এবং মানসিক দ্বন্দ্বে ছবিটি হয়ে উঠেছে উপভোগ্য।

রেটিং – ৮/১০


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন