Select Page

ফরহাদ মজহারের সিনেমা দেখার তীক্ষ্ণতা

ফরহাদ মজহারের সিনেমা দেখার তীক্ষ্ণতা

ফরহাদ মজহারকে নিয়ে ভাবার কালে ঢাকা মহানগরীতে যেটা ঘটে থাকে সেটা মূলত এই যে তাঁর অতিকায় উপস্থিতির সঙ্গে আলোচককুল আগেভাগেই আচ্ছামতো লড়াই করে নেন। বা নিতেই থাকেন। এই লড়াইটাতে যেহেতু জনাব মজহারের নিজের তেমন কিছু করার থাকে নাই কখনো, ফলে এই কুস্তির অন্য নাম হতে পারে ‘ছায়াযুদ্ধ’। আলোচকেরা পরিশেষে স্বীয়-স্বীয় উপস্থিতির সাথেই মোকাবিলা করতে থাকেন। নাহলে ফরহাদ মজহারের ভাবনাচিন্তা ও কর্মকাণ্ড এত ব্যাপৃত, এবং এত দীর্ঘ সময় ধরে তা বিরাজমান, এবং তাঁর উৎপাদিত বাণী নিজ-যোগ্যতায় এতটাই স্পষ্ট যে, যেকোনো পাঠকের বা আলোচকের পক্ষেই বাছাই করা অতিশয় সহজ কাজ যে কোন অংশটুকু তাঁর জন্য প্রাসঙ্গিক। এমনকি যিনি ফরহাদ মজহারকে যুঝবেন বলেই আগাম মনোস্থির করে রেখেছেন তাঁর জন্যও। কিন্তু ফরহাদ মজহারকে গ্রহণ-বর্জনের সমাজ-মনোস্তত্ত্ব নিয়ে আজকে আলাপ করছি না, এই বিষয়বস্তুতে সেটা বে-আন্দাজ লাগতে পারে বলে।

জন-পরিসরে ফরহাদ মজহারের কয়েকটা মারাত্মক রচনা হাজির হয়েছে। এটা বলার মাধ্যমে তাঁর লাগাতার মনোনিবিষ্ট রচনাচর্চা এবং বক্তৃতামালাকে আমি তুল্যবিচারে রাখিনি। এমনকি জন-পরিসর উল্লেখের মাধ্যমে পরিসর-রাজনীতিতে মোটের উপর শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত ও নগরবাসীদের সর্বাত্মক কর্তৃত্ব বিষয়ে অসতর্কও নাই। আমি বলতে চাইলাম যে, তাঁর কয়েকটা রচনার গুরুত্ব শব্দসংখ্যা কিংবা সম্ভাব্য পাঠকবর্গ কিংবা জঁরা/রচনাধারার প্রসঙ্গ ইত্যাদি ফুঁড়ে গেছে এগুলোর সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক উদ্ভাসের কারণে। আমার বিবেচনায় ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ চলচ্চিত্র বিষয়ে তাঁর রচনাখানা এই কাতারের মধ্যে পড়ে। ফলে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ যখন এটা পুস্তিকা আকারে প্রকাশের কথা ভেবেছে তখন আমি খুশি হই এই প্রকাশকের স্বতন্ত্র মনোযোগী পাঠকদের কথা ভেবেই। জনাব মজহার নিজেই বরং অন্য রচনাটি প্রকাশকের মনোযোগে আনেন।

জনাব মজহার এই প্রবন্ধটা যখন লেখেন তখনও বাংলাদেশে চলচ্চিত্র কারখানার আশুমৃত্যু আন্দাজ করা কঠিন ছিল। তিনিও সেই আন্দাজ ধরে এই রচনার অনুধাবন বা বিস্তার করেননি। বরং, চলমান জাগরুক পর্দা-গল্প উৎপাদনে শ্রেণীগত লড়াইয়ের একটা দিকদর্শন পাঠ তিনি হাজির করেছিলেন। বহু বছর আগে থেকেই ফরহাদ মজহারের প্রকাশিত হবার জন্য নিজস্ব রাস্তা বা উপায় (মিনস, মার্ক্সীয় ভাষায়) বের করতে হয়েছিল। নিজেরই প্রকাশনা সংস্থায় লাগাতার প্রকাশিত হতে থাকাকে আজকে বসে যে বা যাঁরা তাঁর একান্ত শ্লাঘা হিসাবে পাঠ করতে চান, তাঁরা ফরহাদ মজহারের প্রতি তো সুবিচার করেনই না, বাংলাদেশের স্যেকুলার-আধুনিক-লিবেরেল অহংকারমণ্ডিত প্রকাশনাব্যবস্থা বুঝতে নিজেদের প্রতিও সুবিচার করেন না। আশা করি এটাকে কেউ আত্মতুলনা হিসাবে দেখবার ভুল করবেন না যে আমি নিজেকে দিয়েও বুঝতে পারি যে প্রধান-বলবান জায়গাগুলোতে প্রকাশিত হওয়া কী পরিমাণ ঝক্কির কাজ বাংলাদেশে। ফলে জনাব মজহারের ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ রচনাও প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর নিজেরই ব্যবস্থাপনাতে। এটা ব্রাত্য রাইসুর মতো সম্পাদকদের গণতন্ত্রমনস্কতা আর সৃজনশীলতা (যার অবধারিত অংশ ধৃষ্টতাও বটে) যে রচনাটি বিডিআর্টসে বছর আঠারো বাদে আবার প্রকাশিত হয়। এতক্ষণে প্রকাশনা বলতে আমি অবশ্যই পুস্তক, দৈনিক, সাপ্তাহিকই বুঝিয়েছিলাম। সন্দেহ নাই যে, উত্তরকালের সাইবার-পরিমণ্ডল কিছুটা গণতান্ত্রিক আবহ তৈরি করতে পেরেছে তাতে পাঠকসংখ্যা যে পোর্টালের যা হোক না কেন।

ম্যজিক লণ্ঠন প্রকাশিত ফরহাদ মজহারের ‘সিনেমাপাঠ’ বইয়ের ভূমিকা হিসেবে এই লেখা

সংস্কৃতি-কারখানা নিয়ে বাংলাদেশের তত্ত্বপ্রেমীদের গড়ে বোঝাবুঝি বেশ দুর্বল ধ্যাবসা ধরনের; বহুবছর ধরেই। সেটা সবিশেষ দুর্বল সবচেয়ে তাঁদের মধ্যে যাঁদের এটার বিষয়ে তীক্ষ্ণ বোঝাবুঝি আরো জরুরি ছিল – ঢাকা শহরের চিহ্নিত কিংবা স্ববিচারকৃত পরিচয়বাহী মার্ক্সবাদীদের। চলচ্চিত্র কারখানার জনপ্রিয় উৎপাদগুলিকে তাঁরা বড়জোর দেখতে পেতেন লিবেরেল রুচিশাসিত মধ্যবিত্তের চশমা দিয়ে। কীভাবে এমনকি প্রবল কারখানার মধ্যেও নানান রকমের মোটিভ সৃজিত ও পুনর্সৃজিত হতে থাকে, কীভাবে নানাবিধ লক্ষণা দরিদ্র মানুষজনের বৃহত্তর সংহতির জমিনে দরকষাকষির মূল্যমান নিয়ে হাজির হতে থাকে, কীভাবে কল্পিত ন্যায্যতা ও জুলুমের গল্পগুলোর পাটাতনের সঙ্গে বৃহৎ বাংলাদেশের দরিদ্র শ্রেণী সম্পৃক্তি বোধ করেন, আর সেসবের সঙ্গে বৃহৎ এই সংস্কৃতি-কারখানার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটা কোথায় সেগুলো নিয়ে কোনোরকম বোঝাবুঝি তো দূরের কথা, প্রশ্ন উত্থাপনের দক্ষতাও এই তাত্ত্বিক-চিন্তক-লড়িয়েরা দেখান নাই। তাই, ফরহাদ মজহারের ‘জোসনা-পাঠ’ ১৯৯০ সালের বাংলাদেশে ‘জনপ্রিয়’ এবং ‘সংস্কৃতি-কারখানা’র পাঠে একেবারে গোড়াপত্তনীকারের ভূমিকা নিয়ে হাজির হয়। মনে রাখা দরকার, ১৯৯০ সাল কিংবা ছায়াছবিটির কাল কেবল প্রাক-সাইবার কালই নয়, উপরন্তু প্রাক-স্যাটেলাইট টেলিভিশন কালও বটে। অধিকন্তু সিনেমার জীবন্ত কাল সেটা – এমন এক মাধ্যম যা ‘জন-পরিসরে’ নানান মানুষকে, পয়সা খরচের বিনিময়ে হলেও, বিনোদন এবং/বা সংস্কৃতিসেবনে সম্পৃক্ত করে। এই কথাটি স্মরণে রাখা এখন আরো গুরুত্বপূর্ণ যখন দেশের প্রায় সকল প্রেক্ষাগৃহই বন্ধ হয়ে গেছে, দোকানপাট হবে বলে কিংবা ভিন্ন ধরনের ‘প্রাইভেটাইজড’ হবে বলে। এই বিষয়গুলোকে নিছক জমির বা ভবনের মালিকানা হিসাবে না দেখতে আমি সুপারিশ করব। এগুলো পরিসরের পুনর্বিন্যাস যেখানে জনপরিসর ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়েও চলেছে।     

এটা খুবই মজার বিষয় যে, যে পরিকাঠামো বা ফ্রেইমওয়ার্কে ফরহাদ মজহার কাজ করেছেন ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ পাঠ করতে গিয়ে, সেই পরিকাঠামোটি বরং তাঁর পরের প্রবন্ধে বিবৃত হয়েছে। দৃশ্য-উৎপাদ হিসাবে সিনেমার গুরুত্বকে তিনি কোথায় দেখেন, সিনেমা কার জন্য ও তাদের জন্য কীভাবে – এই জিজ্ঞাসাগুলো নিয়ে তাঁর ভাবনা আসলে প্রায় ৩০ বছর আগের তাঁরই প্রবন্ধটির পাটাতনকে হাজির করে। তাই এই দুটো প্রবন্ধের এক পুস্তিকার অধীনস্ত হওয়া বৌদ্ধিক বিচারে দারুণ। প্রকাশকদলের সঙ্গে আমার নিবিড় আলাপ হয়েছে। তাঁরা জনাব মজহারের রচনাকাল ধরে সূচি ভেবেছেন বলে পাঠকের জন্য সেই মজাটা ক্ষুন্ন হবে না।

দ্বিতীয় প্রবন্ধটিতে অনেকগুলো ছায়াছবি প্রাসঙ্গিকভাবেই এসেছে। এসেছে তাঁর সিনেমা বিষয়ক আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়েই। এই আকাক্সক্ষাটা জনাব মজহারের একদমই রাজনৈতিক। সিনেমা উৎপাদন, সিনেমা (উপ)ভোগ, দৃশ্যপ্রণালীর পাটাতন, এর আমূল রূপান্তর, পুরান পাটাতনের অবলোপে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষসমূহের জীবনযাপন ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের আরও অনেক আলাপসালাপের দরকার পড়বে। কিন্তু এখানে পাঠক পাবেন তাঁর চিন্তার ব্যাপৃতি এবং কেন্দ্রগুলোকে, বিশেষত সিনেমাকে একটা পাবলিক-কনসাম্পশনের প্রডাক্ট হিসেবে বিবেচনা করে।

আমি অভিমানী পাঠকদের বেশ চিনি, খামোকাই অভিমানী যাঁরা বিশেষত। তাঁদের হয়তো এই পুস্তকটি হাতে পড়ার সাথে সাথেই এই প্রশ্ন দেখা দেবে যে কেন জনাব মজহার তিরিশ বছরে মাত্র দুইটি সিনেমা-রচনা তৈরি করলেন। এটার অনেকগুলো উত্তর হয়; এবং একটাও দেবার দরকার পড়ে না। আমি এই পুস্তকটির ভূমিকা লিখবার নিমন্ত্রণ পেয়ে অত্যন্ত সম্মানিত ও খুশি বোধ করেছি। এতটাই যে, সেই প্রশ্নটারও উত্তর দেবার কথা ভাবছি। সর্বাত্মক উত্তর নয়, কারণ সেটাও দৈর্ঘ্যে বেখাপ্পা হবে। তবে সংক্ষিপ্ত প্রথম উত্তর হবে, ফরহাদ মজহার যদি ওই একটাও সিনেমা-রচনা লিখতেন তাঁর সারা জীবনে তা বাংলাদেশের সিনেমাবোদ্ধাদের জন্য ও সংস্কৃতি-পঠনে উৎসাহীদের জন্য অবশ্য-সংশ্রবীয় হয়ে আছে। দ্বিতীয় উত্তর হবে, ফরহাদ মজহার সিনেমা নিয়ে আরো লিখলে পাঠকেরা খুশি হতেন হয়তো, কিন্তু তিনি কখনোই সিনে-পণ্ডিত হবার বাসনায় সম্পৃক্ত ছিলেন না। পাণ্ডিত্য ও বিশেষজ্ঞতা নিয়ে অনেক জরুরি তর্ক জমে আছে আমাদের সমকালে। সম্ভবত এই সারকথাটিও অনেক মিত্র ভুলতে বসেছেন যে প্র্যাক্সিসের একটা মানে হবার দরকার ছিল বিশেষজ্ঞতার প্রত্যাখ্যান ও বিতর্কের অধিষ্ঠান। ফরহাদ মজহারের রচিত এই পৃষ্ঠা ক’টি যেন সেই কথাটাকে আরেকবার মনে করিয়ে দিতে পারে। তাতে পাঠকের সিনেমা-পাঠে ঔজ্জ্বল্য আসবে, বাংলাদেশের কারখানাটা যতই নিষ্প্রভ হয়ে পড়ুক না কেন। 

আদাবর, ঢাকা। ১২ অক্টোবর ২০২১


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মানস চৌধুরী

লেখক, শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী

মন্তব্য করুন