Select Page

ফর্মুলার সিনেমা, সিনেমার ফর্মুলা

ফর্মুলার সিনেমা, সিনেমার ফর্মুলা

একটি প্রবাদ আছে— ‘ঘুরে ফিরি বটের তল’। সহজ বাংলায়— ঘুরে ফিরে বটের তলা, আরো সহজভাবে— ঘুরে ফিরে সেই একই জিনিস। এই প্রবাদটা কার সাথে সবচেয়ে বেশি যায় বলেন তো? চিন্তা করে বেশি কষ্টের দরকার নেই। সম্ভবত বাংলা সিনেমার সাথে।

শুধু বলে দিলেই তো হবে না, কিছু প্রমাণও দরকার। কারণ বাংলা সিনেমার অতি জনপ্রিয় ও গৎবাঁধা একটি সংলাপ— ‘আদালত প্রমাণ চায়’। আমাদের ঢাকাইয়া চলচ্চিত্রের কয়েকটি জনপ্রিয় কাঠামো বা ফর্মুলা হলো :

১. সিনেমার শুরুতেই সন্তান হারিয়ে যাওয়া, অন্যের কাছে বড় হওয়া। শেষে কোন একটি চিহ্নের মাধ্যমে (গান বা গলার লকেট) বাবা-মায়ের কাছে আবার ফিরে আসা।

২. ছোটবেলায় ভিলেনের হাতে বাবা-মা খুন হন। সেই খুনের বদলা নিতে সন্তান বড় হতে থাকেন। একসময় বদলা নেন এবং সেই বদলা যতই নৃশংস হোক না কেন, নায়কের যত দোষই থাকুক না কেন— তিনি শেষ দৃশ্যে সমস্ত পাপ মোচন করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে আসেন।

৩. গরীব নায়ক বা নায়িকা স্বাবলম্বী হতে শহরে এসে কাজ শুরু করেন। অল্প কিছু সময়ের মাধ্যমে অর্থাৎ মাত্র দুই-তিন মিনিটেই (কয়েকটা জাম্প শটে) তারা সম্পদের মালিক হন। (যদিও এ ক্ষেত্রে নায়িকাদের কম দেখা যায়, নায়কদের বেশি দেখা যায়। এর মানে কি দাঁড়ায়? পরিশ্রম শুধু নায়ক বা পুরুষরাই করেন বা তাদেরই করতে হয়? নারীদের কাজ শুধু ঘরে থাকা? )

৪. নায়ক গুণ্ডা বা সন্ত্রাসী— কিন্তু একই সাথে সৎ ও পরোপকারী। ধনীদের সম্পদ লুট করে গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। এই কারণে তার সাত খুন মাফ।
৫. প্রেম। এর আবার অনেক প্রকারভেদ; ধনী-গরিব প্রেম, ত্রিভুজ প্রেম, ভালোবাসার অদৃশ্য শক্তিতে অর্ধমৃত নায়কের নায়িকার সামনে প্রবল শক্তিশালী মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া।

কথা হচ্ছে, এগুলো কেন হচ্ছে? আমাদের কি কাহিনির এত অভাব? শুধু বাজেটের স্বল্পতাই কি এর কারণ? এইসব প্রশ্ন করলে আবার একেকজন একেকজনের কাঁধে দোষ চাপান, যদিও প্রকৃত সত্য হচ্ছে পরিচালক থেকে শুরু করে আমরা দর্শক— সবাই এক সুতায় গাঁথা, আমরা সবাই দোষী। আচ্ছা, ব্যতিক্রমী কোন কিছুই কি আমাদের দেশে কখনো হয়নি? যেগুলো হয়েছিল সেগুলোর রেজাল্ট বা ফলাফল কি?

৬০-এর দশকে উর্দু সিনেমার বাড়াবাড়ির কারণে ঢাকাই সিনেমা বেশ একটা অস্তিত্ব সঙ্কটের মঝে পড়ে। ১৯৬২ সালে মোট ১৬টি সিনেমার মাঝে মাত্র তিনটি ছিল বাংলা, বাকি সব ছিল উর্দু ভাষায়। এক বছরের মাঝে অবস্থার আরো অবনতি ঘটে- প্রায় ৯০% সিনেমা ছিল উর্দু ভাষায় নির্মিত। ১৯৫৬ সালে আব্দুল জব্বার খান সামাজিক ড্রামা আর কিছুটা অ্যাকশন মিলিয়ে মুখ ও মুখোশ নামক যে সিনেমা বানিয়েছিলেন— বাকিরা কেউ সেই কাঠামো থেকে বের হতে পারছিলেন না। আর এদিকে উর্দু সিনেমার দাপট দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। কিন্তু বাংলা সিনেমার প্রতি দর্শকের চাহিদা আর ভালোবাসা ছিল এখনকার তুলনায় অনেক। এই ভালোবাসাটাই আঁচ করতে পেরেছিলেন নির্মাতা সালাহউদ্দিন। প্রচলিত একটা গল্প নতুন ধরনে বললেন, নাম রূপবান— বাংলা ইন্ডাস্ট্রির প্রথম লোককাহিনীভিত্তিক সিনেমা। গল্পটা এমন— একটি অলৌকিক বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ১২ বছরের মেয়ের সাথে ১২ দিনের এক নবজাতকের বিয়ে দেওয়া হয়। এরপর শর্তানুযায়ী বিয়ের দিনই তাদের বনবাসে পাঠানো হয়। এরপরে তাদের বেড়ে ওঠা, সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়েই কাহিনি এগিয়ে চলে। ভাবলে অবাক লাগে, আজ থেকে এত বছর আগে এই ধরনের কাহিনির সিনেমা আমাদের দেশেই নির্মিত হয়েছে।

[su_note note_color=”#ecf0f5″ text_color=”#ffffff” radius=”5″]

এই লেখাটি বিএমডিবি ঈদ সংখ্যা ই-বুক ২০১৭ এর অংশ। পুরো ই-বুক টি ডাউনলোড করুন এখানে

ডাউনলোড করুন[/su_note]

দর্শক যেন লুফে নিল রূপবানকে, ফলাফল রাতারাতি রূপবান একটি সফল চলচ্চিত্র। কিন্তু এই সফলতাই যেন কাল হল, ইন্ডাস্ট্রি লোককাহিনী সিনেমার একটি কাঠামো খুঁজে পেল যেই কাঠামোর আদিতে পাপ, মাঝে ফলভোগ আর শেষে যথারীতি মিলন। একই কাঠামোতে শুধু গল্পে পরিবর্তন এনে জহির রায়হান ১৯৬৬ সালে নির্মাণ করলেন বেহুলা। দেবীর কথা অমান্য করা মানে পাপ করা, সন্তান হারানোর মধ্য দিয়ে ফলভোগ আর সিনেমার শেষে স্বামীকে ফিরে পাওয়ার মধ্য দিয়ে মিলন। এই একই কাঠামোতে একে একে নির্মাণ হয় রহিম বাদশা ও রূপবান, রাজা সন্ন্যাসী, আবার বনবাসে রূপবান, গুনাই বিবি, মহুয়া, ভাওয়াল সুন্দরী, আপন দুলাল, জরিনা সুন্দরী-র মতো আরো অনেক সিনেমা। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে এগুলোর কোনটাই রূপবান বা বেহুলা-কে ছাড়াতে পারেনি এবং নির্দিষ্ট গল্পকাঠামো ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
তবে এই লোককাহিনির মাঝে কিছু সামাজিক ড্রামা আর অ্যাকশন মিলিয়ে ১৯৮৯ সালে তোজাম্মেল হোসেন বকুল বেদের মেয়ে জোসনা নামক বাংলাদেশের অন্যতম ব্যবসাসফল সিনেমা বানান। আজ পর্যন্ত লোককাহিনীভিত্তিক আর কোন সিনেমা এত ব্যবসা করতে পারেনি, একই সাথে এই ধরনের সিনেমা নির্মাণেও ভাটা পড়ে।

৭০ এর দশকটা মূলত ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমার। ১৯৭০ সালে জহির রায়হানের হাত ধরে আসে জীবন থেকে নেয়া। রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সাথে রূপক অর্থে সামাজিক টানাপোড়েন অসাধারণভাবে তুলে ধরেন জহির রায়হান। যুদ্ধের পরে ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা নির্মাণ শুরু হয় ওরা ১১ জন-এর মাধ্যমে। যে কাঠামো চাষী নজরুল ইসলাম বানিয়েছিলেন এ সিনেমার মাধ্যমে, তার বাইরে বেশিরভাগ পরিচালকেরা যেতে পারেননি। কয়জন পরিচালক মুক্তিযুদ্ধের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে সিনেমা বানাতে পেরেছেন তা প্রশ্নসাপেক্ষ। ধীরে বহে মেঘনা, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড, মুক্তির কথা, মুক্তির গান, রাবেয়া, আগুনের পরশমণি, একাত্তরের যীশু, জয়যাত্রা এরপরেও নতুন কাঠামোতে নতুন গল্প বলেছে।

এই সময়ের আরেকটি অন্যরকম সিনেমা হল জহিরুল হকের রংবাজ। এর কাহিনি আমাদের সামাজিক কাঠামোর বিপরীত বলে সমালোচকদের সমালোচনার সম্মুখীন হয়। কিন্তু রংবাজ-কে দর্শক ভালোভাবেই গ্রহণ করে। এতটাই ভালোভাবে যে এরপরে বেশিরভাগ পরিচালক এর মতো সিনেমা বানাতে শুরু করলেন ব্যবসার কারণে। এমনকি রংবাজ-এর মারামারির স্টাইল ঢাকাইয়া সিনেমাতে এখনো অনুকরণ করা হয়! (দুইজন ভিলেনের উপর ভর করে তৃতীয় ভিলেনকে আঘাত করা।)
৮০-র দশকে সিনেমার কাহিনিতে কোন সামঞ্জস্য না থাকায় তা ক্রমাগত দর্শক টানতে ব্যর্থ হতে থাকে। যদিও সামাজিক ঘরানার বেশ কিছু সিনেমা দর্শকনন্দিত হয়।

৯০ দশককে বাংলা সিনেমার নতুন সূচনা বললে খুব একটা বাড়িয়ে বলা হয় না। এইসময়ে বাংলা সিনেমা প্রবেশ করে প্রেমের গল্পে। প্রথমদিকে সবকিছু ঠিকমতো থাকলেও একসময় আবার এক নির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি হয়ে যায় যেটির বাইরে বেশিরভাগই যাওয়ার চেষ্টা করেননি। এবার নিম্নরূপ কাঠামো তৈরি হয়—

১. দুই পরিবারের বিরোধ অথচ সেই দুই পরিবারের ছেলে-মেয়ের মাঝে প্রেম। প্রথমে মেনে না নেওয়া এবং শেষে মিলন।

২. ছোটবেলায় খেলার সাথী হারিয়ে যাওয়া, বড় হয়ে নির্দিষ্ট গান বা চিহ্নের মাধ্যমে দেখা হয় অতঃপর সুখে শান্তিতে বসবাস।

৩. ত্রিভুজ প্রেম। এক নায়ক-দুই নায়িকা বা এক নায়িকা-দুই নায়ক। একজনের মৃত্যুর মাধ্যমে বাকি দুইজনের মিলন।

১৯৯১ সালে ভিন্নরকমের একটি গল্পে চাঁদনী নির্মিত হয়, যার পরিচালক এহতেশাম। ইন্ডাস্ট্রিতে তখন নতুন মুখের তীব্র সংকট— এই বিষয়টা অনুধাবন করেই এহতেশাম নতুন মুখকে নিয়ে চাঁদনী নির্মাণ করেন। সিনেমা যতটা ব্যবসাসফল হয়, তারচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায় গান। ফলে আবার এক নতুন কাঠামো তৈরি হয়— বানাও প্রেমের সিনেমা। এ সময়ে ভারতের কিছু সিনেমা নকল করে অথবা রিমেক করে সিনেমা নির্মাণও শুরু হয়। তবে নব্বই দশকের সিংহভাগ সিনেমার মূল থিম হচ্ছে প্রেম ও রোমান্স। কেয়ামত থেকে কেয়ামত, স্বজন, স্বপ্নের পৃথিবী, স্বপ্নের নায়ক, প্রেম যুদ্ধ, তুমি আমার-এর মতো সিনেমাগুলো উল্লেখযোগ্য ব্যবসা করে। এই ব্যবসা করা সিনেমাগুলোর মাঝে কোনটিই উপরে উল্লেখিত কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তবে যে সিনেমাগুলোর নাম বলা হলো, তার মাঝে বেশিরভাগ সালমান শাহ অভিনীত। এই মানুষটি বিক্ষোভ-এর মতো রাজনৈতিক বক্তব্যধর্মী সিনেমা আবার আনন্দ অশ্রু-র মতো ভিন্ন ধরনের কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন। সেগুলোও সফল। তবে সংখ্যাটা অনেক কম।

প্রেমের সিনেমা ক্ষেত্রে নায়ক-নায়িকার ধাক্কা খেয়ে পরিচিত হওয়া, চোখে-চোখ পড়তেই পাহাড়, সমুদ্র, বনে হারিয়ে যাওয়া— এটা যেন বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে একটি স্ট্যান্ডার্ড হয়ে দাঁড়ায়। এটা না থাকলে অনেকের কাছে যেন সিনেমা বস্তুটাই ‘সিনেমা’ হয়ে উঠত না, এমনকি এখনো অনেকের কাছে হয়ে উঠে না।

নব্বইয়ের শেষেরদিকের অন্যতম ব্যবসাসফল নির্মাণ আম্মাজান। কাজী হায়াতের পরিচালনা আর মান্নার দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য সিনেমাটি আজো সবার মনে আছে। তবে আম্মাজান-এর সাফল্য দেখে আবার সেই ফর্মুলা শুরু হয়। ছোটবেলায় নায়ক বা নায়িকার বাবা-মায়ের সাথে কোন অন্যায় হয়, আর নায়ক বা নায়িকা বড় হয়ে সেই অন্যায়ের প্রতিশোধ নেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, সেগুলো কোনটাই আম্মাজান সিনেমা সাফল্যকে ছুঁতে পারেনি। এমনকি খোদ কাজী হায়াৎ আব্বাজান নামে একটি সিনেমা বানিয়ে আগেরটির অর্ধেক সাড়াও ফেলতে পারেননি।

এরপরে অশ্লীলতার মতো বিষধর সাপের আগমন, যার বিষ সম্ভবত এখনো এফডিসির আনাচে কানাচে মিশে আছে। তবে ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে যেমন অনেকেই জীবনের গান গেয়ে চলেন, তেমনি এরকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কিছু ‌‘ভালো’ সিনেমা তৈরি হয়। এরকম একটি সিনেমা হল বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত মনের মাঝে তুমি। তুমুল ব্যবসাসফল এই সিনেমাতে দেখা যায়— ছোটবেলায় নায়ক-নায়িকার প্রেম, এরপরে বিচ্ছেদ, বড় হয়ে নতুন করে পরিচয়, সম্পর্কের ওঠানামা ও দিনশেষে শুভমিলন। এই সিনেমার গানও ব্যাপক জনপ্রিয়। তবে দিনশেষে আবারো সেই একই সমস্যা— এই সিনেমাও উপরে উল্লেখিত কাঠামো থেকে বের হতে পারেনি।

২০১১ সালে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া-সহ আরো বেশ কয়েকজন নতুন পরিচালকদের মাধ্যমে (যাদের মাঝে বেশিরভাগ টিভিপর্দায় কাজ করেছেন) অশ্লীলতার সময় পেরিয়ে আমাদের ঢাকাইয়া সিনেমা নতুন করে তার যাত্রা আরম্ভ করে। কিন্তু সেই নতুন যাত্রা আসলে কতটা নতুন?

ওই সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত অন্যতম দুইটি ব্যবসাসফল ও দর্শকনন্দিত সিনেমা হচ্ছে চোরাবালি ও অগ্নি। কিন্তু এই দুটি সিনেমা কি আসলেই নতুন কিছু দিতে পেরেছে? ছোটবেলায় বাবা-মার খুন হওয়া, সন্তানের সন্ত্রাসীতে পরিণত হওয়া, বড় হয়ে সাংবাদিক নায়িকার প্রেমে পড়া, হত্যার বদলা নেয়া এবং শেষে কারাগার থেকে বের হওয়া এই সবের যোগফল হল চোরাবালি। আবার ছোটবেলায় বাবা-মার খুব হওয়া, নায়িকার বড় হওয়া প্রতিশোধের নেশায়, হত্যার বদলা নেওয়া— এ সব হলো অগ্নি। নিরুপায় দর্শক এরপরেও সেই একই কাঠামোর সিনেমা দেখে যাচ্ছেন, নতুন কিছু পাবেন এই আশায়। কিন্তু নতুন কিছুই তারা দিন শেষে পাচ্ছেন না।

তারমানে কি কাঠামোর বাইরে কোন সিনেমাই হচ্ছে না? কারো ক্ষমতা নাই ভিন্ন কিছু করার? নাহ, কথাটা এতটা সত্যি না। ভিন্ন অনেক কিছু হয়েছে। ৫০ দশকের দুর্ভিক্ষ নিয়ে শেখ নিয়ামত আলীর সূর্যদীঘল বাড়ি থেকে শুরু করে মরণের পরে, ক্ষতিপূরণ (বিদেশে কাহিনী অবলম্বনে), লাল সবুজ, হুলিয়া, আগামী, দহন, ঘুড্ডি, চাকা, চিত্রা নদীর পারে, লালসালু, মাটির ময়না, কিত্তনখোলা, স্বপ্নডানায়, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, টেলিভিশন, বৃত্তের বাইরে এবং আরো অনেক সিনেমা। কিন্তু এরপরে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, যেই কাঠামোতে এইসব সিনেমার পরিচালকেরা গল্প বলেছেন, সেটি আসলে কাদের জন্য? অর্থাৎ কোন শ্রেণীর দর্শকদের জন্য? এর মধ্যে কয়টি সিনেমা প্রচণ্ড পরিমাণে দর্শকনন্দিত হয়েছে? বাংলার যে সব দর্শক সারাদিন কাজ শেষে একটু বিনোদনের আশায় সিনেমা হলে যায়, তাদের কতজনকে এই সব সিনেমার গল্প তুষ্ট করতে পেরেছে? নাকি দর্শককে তুষ্ট করার চেয়ে পুরস্কার প্রাপ্তি বা বিদেশে সম্মাননার দিকে মনোযোগ বেশি? দিনশেষে সিনেমা যদি সাধারণ দর্শকের কাছে না পৌঁছে, তাহলে সেই সিনেমার নির্মাণের আসল উদ্দেশ্য কোথায়? এসব সিনেমার ক্ষেত্রে প্রচারের পরিমাণ এত কম কেন? দর্শক যদি জানতেই না পারে যে একটি ভালো সিনেমা তার বাড়ির পাশের হলে আসছে, তাহলে সে সিনেমা দেখবে কীভাবে?

তবুও মাঝে মাঝে কিছু সিনেমা নির্মিত হয় যা মাস পিপল এবং ক্লাস পিপল দুই শ্রেণীর মানুষকেই হলের সিটে বসিয়ে রাখতে বাধ্য করে, যেমন; মনপুরা বা আয়নাবাজি। কিন্তু সারাজীবন শুধু এ দুই সিনেমার উদাহরণ দিয়ে যাওয়াটা মনে হয় না আমাদের জন্য খুব সুখকর হবে।

মৃত ভেবে বাড়ির চাকরকে দিয়ে নিজের শিশু সন্তানকে কবরে দিতে পাঠান বাবা। এক ডাকাত সর্দার চাকরকে খুন করে শিশুটিকে নিজের কাছে পালন করে। বড় হয়ে শিশুটি হয় ডাকাত। আর সেই বাবা-মার আরেক সন্তান হয় পুলিশ। এরপর ডাকাত-পুলিশের যুদ্ধ (অর্থাৎ দুই আপন ভাইয়ের যুদ্ধ) আর ২০ বছর পর হারানো সন্তানকে ফিরে পাওয়া নিয়ে নির্মিত হলো একটি সিনেমা।
প্রায় ৬০ বছর পরের কথা, বাড়ির চাকর ও চাকরানী টাকার লোভে মালিকের ছোট মেয়েকে চুরি করে পালায়। জঙ্গলে পুলিশের গুলিতে তারা মারা যান, ছোট মেয়েটিকে খুঁজে পায় এক বার ড্যান্সার। মেয়েটিও বড় হয়ে বার ড্যান্সার হয়ে উঠে। সেই মেয়ের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পড়ে খলনায়কের। ঘটনাচক্রে আসল বাবার পাশের ফ্ল্যাটে কাজের মেয়ে হিসেবে আশ্রয় নেয় মেয়েটি। একপর্যায়ে মেয়েটি ভিলেনের হাতে ধরা পড়ে। এরপর নায়ক-খলনায়কের যুদ্ধ আর বাবা তার হারানো সন্তানকে ফিরে পাওয়া— সিনেমা শেষ।

প্রথম প্যারার কাহিনী বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা ‌মুখ ও মুখোশ-এর, আর দ্বিতীয় প্যারার কাহিনী ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া দবির সাহেবের সংসার-এর। ৬০ বছর আগে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা আর অর্থের অভাবে অথবা প্রতিকূল পরিবেশে মুখ ও মুখোশ-এর নির্মাণ মেনে নিতে পারলেও, এত বছর পর ২০১৪ সালে প্রায় একই ধরনের সিনেমা নির্মাণ কীভাবে মেনে নিই? আমাদের আজকের চলচ্চিত্র কেন তার আনুষাঙ্গিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারছে না? নাকি তাকে কাটিয়ে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না? এমন তো না যে আমাদের দর্শকরা সিনেমা ভালোবাসেন না বা একেবারেই হলে যান না। এমনই যদি হত তাহলে অগ্নি, মোস্ট ওয়েলকাম, আয়নাবাজি, শিকারি-র এর মতো সিনেমা নিশ্চয় ভালো ব্যবসা করতো না?

আয়নাবাজি-র দুর্দান্ত সাফল্যের পর অনেকেই নাকি আবার সেই কাঠামোমুখী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ‘জেল পালানো’ কনসেপ্টে সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন। চঞ্চল চৌধুরীর দারুণ অভিনয় দেখে অনেক পরিচালক আবার টিভি অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন, যদিও সাধারণত টিভির অভিনেতাদের দিয়ে সিনেমা হয় না— এমনটাই বলে থাকেন তারা মাঝে মাঝেই। অথচ এরকম হওয়ার কথা ছিল না। আয়নাবাজি সফল হলে আমাদের উচিত এ টাইপ আর কিছু না বানানো, একদম ভিন্ন পথে হাঁটা। চঞ্চল কিন্তু তাই করেছেন, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস দেবী অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাতে কাজ করেছেন। অমিতাভ রেজাও রিকশা গার্ল নামের নতুন এক সিনেমার কাজে নেমেছেন, যার কনসেপ্ট আয়নাবাজি থেকে একদম আলাদা। এটাই তো দরকার। বৈচিত্র্য দরকার!

একজন পরিচালক যদি বছরে সাত-আটটি সিনেমা নির্মাণ করেন, একজন অভিনেতা যদি বছরে ছয়-সাতটি সিনেমাতে অভিনয় করেন, তাহলে তাদের কাছ থেকে ভিন্ন কিছু বা নতুন কিছু আশা করাটা মনে হয় বোকামি। একইভাবে একজন গল্প লেখক যদি আট-দশটি সিনেমার গল্প লেখেন বছরে, তাহলে নকল না হয়ে আর কী হবে? এই ধরনের সমস্যা আগে দূর করতে হবে। তাহলেই কাঠামোর ভিতরে থেকে হোক বা কাঠামোর বাইরে গিয়ে হোক— ঢাকাইয়া সিনেমার জয় হবে সর্বত্র।

সৈয়দ নাজমুস সাকিব : অভিনেতা ও লেখক


মন্তব্য করুন