Select Page

বক্তব্যধর্মী ছবির অসাধারণ নির্মাতা কাজী হায়াৎ

বক্তব্যধর্মী ছবির অসাধারণ নির্মাতা কাজী হায়াৎ

কাজী হায়াৎ বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ছবির কালজয়ী নির্মাতা। তিনি তাঁর সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা নির্মাতা ছিলেন। বক্তব্যধর্মী ছবির যে ধারা তাঁর হাতে শুরু হয়েছিল সেটি পরবর্তীকালে ঢালিউড ইন্ডাস্ট্রিকে সমৃদ্ধ করেছে।

তাঁর ছবির বৈশিষ্ট্যই ছিল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়া। সমস্যাগুলোকে তুলে ধরে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করে সামাজিক বার্তা দিতে চাইতেন। দর্শক তাঁর সেসব প্রচেষ্টাকে সাদরে গ্রহণ করত।

কাজী হায়াতের ক্যারিয়ার বিশ্লেষণ করলে তিনটি দিক মোটাদাগে চোখে পড়ে। প্রথমত কাজী হায়াৎ-মান্না কোলাবোরেশন, মান্নাবিহীন কাজী হায়াত এবং কাজী হায়াৎ-মারুফ কোলাবোরেশন। মান্নাবিহীন কাজী হায়াতের ছবিগুলোর মধ্যে আছে – বেরহম, দি ফাদার, লাভ স্টোরি, চাঁদাবাজ, দিলদার আলী, রাজবাড়ি, খোকনসোনা, আইন আদালত, সিপাহী, পাগলা বাবুল, জবরদখল, ক্রোধ, জখম, ধাওয়া ইত্যাদি। এসব ছবির মধ্যেও তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক বক্তব্যধর্মী ছবি আছে যার মধ্যে ‘সিপাহী’ অত্যন্ত পাওয়ারফুল ছবি যার শেষ দৃশ্যটি ছিল সাহসী দৃশ্য। ‘চাঁদাবাজ, ধাওয়া, ক্রোধ, জখম, বীর’ ছবিগুলোতেও সামাজিক-রাজনৈতিক বক্তব্য বিদ্যমান। এর বাইরে ফ্যামিলি ড্রামা এবং রোমান্টিক ধারার দু’একটি ছবি আছে।

কাজী হায়াৎ-মান্না কোলাবোরেশন ঢালিউডে পরিচালক-নায়ক জুটির মধ্যে অন্যতম সেরা। তাঁদের জুটির ছবিগুলো ঢালিউডে অসাধারণ সংযোজন বাণিজ্যিক ছবির জগতে। বক্তব্যধর্মী ছবির জন্য তাদের জুটির ছবি ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সমাজের বাস্তবতা অনুযায়ী সাজানো হত ছবির গল্পগুলো। কাজী হায়াতের সাহসী বক্তব্যে দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা যেমন চোখে পড়ত পাশাপাশি মান্নার প্রতিবাদী অনবদ্য অভিনয়ও দর্শককে আকৃষ্ট করত। কাজী হায়াৎ মান্নাকে ছবির পর্দায় প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তুলে ধরতেন। মান্না-ও নির্মাতার সে ভাষাকে জীবন্ত করে তুলে ধরত তাঁর অভিনয়শক্তিতে। মান্না-র অকালমৃত্যুতে সেই নির্মাতা-শিল্পী জুটির অসাধারণ অধ্যায়টির সমাপ্তি ঘটেছে নয়তো আমরা আরো ছবি পেতাম তাঁদের কাছে। মান্না-র মৃত্যুতে তাই কাজী হায়াতকে অসহায় দেখা গিয়েছিল, তিনি শিশুর মতো অঝোরে কেঁদেছিলেন।
তাঁদের ছবিগুলো – যন্ত্রণা, দাঙ্গা, ত্রাস, সিপাহী, দেশপ্রেমিক, দেশদ্রোহী তেজী, আম্মাজান, ধর, কষ্ট, ঝড়, বর্তমান, আব্বাজান, পাঞ্জা, তাণ্ডবলীলা, মিনিস্টার, লুটতরাজ, সমাজকে বদলে দাও, কাবুলিওয়ালা।

শুরুর দিকের ছবির মধ্যে ‘যন্ত্রণা’ বেদনাদায়ক গল্পের ছবি। চাকরি অভাবে বেকার হতাশ যুবকেরা জড়িয়ে পড়ে অপরাধ জগতে। তাদের অপরাধ ও শাস্তির করুণ গল্প নিয়ে সমাজের প্রচলিত নিয়ম-কানুনকে প্রশ্ন রেখে যাওয়া ছবি। ‘দাঙ্গা’ ছিল মাস্টারপিস ছবি। সুবিধাবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর খেলার পুতুল সাধারণ জনগণের উপর নেমে আসা নির্যাতন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও রাজনীতির বলি করে দেখানোর ছবি। নায়ক মান্না-র অসাধারণ অভিনয়ে ওসি চরিত্রটি কালজয়ী। ‘ত্রাস’ ছিল ছাত্র-রাজনীতি নিয়ে নির্মিত ছবি। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস এবং এর প্রভাবে বিভিন্ন অপরাধের বাস্তবতায় ছবিটি নির্মিত। অসৎ রাজনৈতিক নেতারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে তাদের ক্ষমতাবলে কাজে লাগায় তারই বাস্তবতা ফুটে উঠেছে ছবিতে। মান্না ছিল ছাত্রনেতা এবং তার হাত ধরে বিপ্লব ঘটে।

‘দেশদ্রোহী’ ছবিটিও স্বাধীনতা পরবর্তী নেতাদের খেলার পুতুল হয়ে ওঠা যুবকদের বিভ্রান্ত করে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করার নির্মম বাস্তবতার ছবি। মান্না মাস্তানের ভূমিকায় ছিল। ‘লুটতরাজ’ মান্না প্রযোজিত ছবি ছিল। কাজী হায়াৎ মান্নাকে দিয়ে এ ছবিতেও তৎকালীন সমাজের কালো অধ্যায়কে তুলে ধরেছেন। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মেসেজ পৌঁছে দিয়েছেন রাজিবের অপরাধ জগতের বিরুদ্ধে মান্না-র বিদ্রোহী ভূমিকার মধ্য দিয়ে। ‘তেজী, ধর’ ছিল লোকাল সিন্ডিকেট পলিটিক্স নিয়ে অসাধারণ দুটি ছবি। সমাজে ঠোকর খেয়ে কিভাবে সাধারণ যুবক অপরাধী হয়ে ওঠে তার বর্ণনা আছে ছবি দুটিতে।

‘আম্মাজান’ আরেকটি মাস্টারপিস ছবি। মায়ের করুণ পরিণতিতে সন্তানকে দায়ী ভেবে তার সাথে কথা না বলা মায়ের অধ্যায় ছিল ছবিটি। মান্না ক্যারিয়ার সেরা অভিনয় করেছে। তাঁর চরিত্রটি ছিল প্রতিবাদী ও সাধারণ মানুষের পাশে থাকা এক যুবকের। ‘কষ্ট’ ছবিটি আরেক তরুণের জীবনের অভিজ্ঞতায় অনেক কষ্টের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকার অধ্যায়। ‘বর্তমান’ বেকার তরুণের কর্মসংস্থানের পর সমাজের অপরাধের চাপে বদলে যাওয়ার গল্প নিয়ে নির্মিত অনবদ্য ছবি। ‘মিনিস্টার’ ছবিটি ছিল অল্প সময়ের জন্য মন্ত্রী হওয়া একজন সৎ তরুণের দেশ গড়ার স্বপ্নের ছবি। ‘তাণ্ডবলীলা’ পরিবার ও রাজনীতি নিয়ে নির্মিত আরেকটি চমৎকার ছবি। ‘সমাজকে বদলে দাও’ ছবিও রাজনৈতিক সুবিধাভোগী নেতাদের মুখোশ খুলে দেয়া বাস্তব ও বক্তব্যধর্মী ছবি।

কাজী হায়াৎ-মারুফ কোলাবোরেশনও সমাজের সমস্যা নিয়ে নির্মিত হলেও সবগুলো হতে পারেনি। শুরুর দিকের ‘ইতিহাস, অন্ধকার’ ছবি দুটি খুব ভালোভাবে সেটি তুলে ধরলেও পরবর্তী ছবির মধ্যে ‘শ্রমিক নেতা, পিতাপুত্রের গল্প, সর্বনাশা ইয়াবা, ছিন্নমূল, অশান্ত মন’ এসব ছবি নির্মাণের দিক থেকে দুর্বল কাজী হায়াতকে তুলে ধরেছে।

ঢালিউডের বর্তমান শীর্ষ নায়ক শাকিব খানের সাথে একটি ছবিই করেছেন কাজী হায়াত যার নাম ‘বীর’।

কাজী হায়াৎ অসংখ্য ছবিতে বাবা, চাচা, শিক্ষক, পুলিশ ইত্যাদি ছবিতে অভিনয় করেছেন। অনেক ছবিতেই তাঁর অভিনয় ন্যাচারাল ছিল।

কাজী হায়াৎ দেশের চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন। এ অবদানই তাঁকে কিংবদন্তি নির্মাতায় পরিণত করেছে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন