বধূ ও দেশের আবহে মাতৃভাষা
কালজয়ী ঔপন্যাসিক আহমদ ছফা-র ‘ওঙ্কার’ উপন্যাস নিয়ে শহীদুল ইসলাম খোকন নির্মিত ছবি ‘বাঙলা‘। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদের জন্য মিছিল থেকে পাওয়া যায় সেইসব শ্লোগান ‘তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ যে শ্লোগানের উৎপত্তি বা বীজ ছিল ভাষা আন্দোলন। ইতিহাসের সেই তাৎপর্য থেকে ছবির নাম ‘বাঙলা’ নির্বাচনেও ভাষার প্রতি গভীর চেতনা প্রকাশ পেয়েছে। ‘বাঙলা’ শব্দটি থেকে ‘বাংলা’ শব্দ এসেছে। শহীদুল ইসলাম খোকন ‘বাঙলা’ নামটি নির্বাচন করে মূল চেতনাটি ধারণ করেছেন।
ঔপন্যাসিক আহমদ ছফা-র ‘ওঙ্কার’ নাম বাছাই গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ‘ওঙ্কার’ অর্থ ‘আদিধ্বনি’ যা হচ্ছে ‘সকল ভাষার মূল’। সে সূত্রে আমাদের মাতৃভাষার মূল সেই ‘বাঙলা’ যার থেকে ‘বাংলা’ এসেছে। উপন্যাস থেকে ছবির নামকরণ তাই গভীরতা রেখেই করা হয়েছে।
ছবির প্রধান চরিত্র সতরী বা শাবনূর বোবার ভূমিকায় মিছিল দেখলে জানালার শিক ধরে কথা বলতে চাওয়া একটি সাহসী চেতনা। শাবনূরের হারমোনিয়ামে গান শিখতে চাওয়া, স্বামী মাহফুজের সাথে আধো আধো শব্দ করা, মাঝরাতে চিলেকোঠায় গলা সারতে গিয়ে গোঙানির আওয়াজ সবই মাতৃভাষা ‘বাঙলা’-র জন্য সাধনা।শেষে জানালার ওপারের মিছিল দেখার চূড়ান্ত পরিণতিতে মুখে রক্ত উঠে ‘বাঙলা’ শব্দটি বেরিয়ে আসে শাবনূরের। ভাষাই মূল চেতনা এভাবেই। পুরো ছবিতে শাবনূরের পরিশ্রমী অভিনয়ের জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট না। ভাষার জন্য আকুতি শাবনূর শতভাগ ফুটিয়ে তুলেছে। মেইনস্ট্রিম বাণিজ্যিক ছবির পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকন সাহিত্যভিত্তিক ছবিতেও সম্পূর্ণ নতুন দক্ষতা দেখান যা অসাধারণ।
বোবা মেয়ে সতরী বা শাবনূরের বিয়ে হয় মাহফুজের সাথে। মাহফুজ কথা বলতে চায় তার স্ত্রীর সাথে কিন্তু সে সাধ অপূর্ণই থেকে যায় তাই সে বলে ‘এ শব্দহীন জীবন আর ভালো লাগে না।’ অফিস আর বাসার একঘেয়েমি জীবন তার ভালো লাগে না। রাস্তায় গণঅভ্যুত্থানের মিছিলও তার বিরক্ত লাগে। বোবা বধূর মনের কথাও সে বোঝাতে পারে না তাই কষ্ট তার রাগ, অভিমানে বের হয়ে আসে।
প্রথমত বলতে হয় মূকাভিনয় যারা করে তাদের অভিনয়ে পরিশ্রম দ্বিগুণ হয়। এটা কঠিন কাজ।মূক-বধির বা সোজা বাংলায় বোবা-কালা যারা তাদের মতো অভিনয় করা সহজ নয়। শাবনূর বোবা মেয়ের চরিত্রে নিজের স্বাভাবিক অভিনয় করে সক্ষমতা দেখিয়েছে। সতরী চরিত্রে শাবনূরের ক্যারেক্টারাইজেশন স্টেপ বাই স্টেপ দেখানো যাক :
১.
মাহফুজ অফিস থেকে ফেরার পরে বাসায় স্ত্রী শাবনূরকে খুঁজছে, পাচ্ছে না। উঠোনে দাঁড়াতেই কোণের জানালায় চোখ গেল তার। যা দেখল মাহফুজ তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। শাবনূর জানালায় হাত রেখে বাইরের মিছিলের সাথে নিজের গলা সাঁধছে। মাহফুজ বিস্মিত হয়ে তা দেখছে। শাবনূর মুখের ভঙ্গিগুলোকে পরীক্ষা করছে। বাইরে থেকে ভেসে আসা ‘বাঙলা’ ধ্বনির সাথে গলার মুভমেন্ট যাচ্ছে। তার সাথে ঠোঁট একবার খুলছে আবার বন্ধ হচ্ছে। তার সাথে ঘামছে তো ঘামছেই। বোবা মানুষেরা ভাষাযুদ্ধ চালায় নিজের সাথে। শাবনূরের অভিনয় সেটা বলে দেয় এখানে।
২.
শাবনূর শেষ সিকোয়েন্সে মুখে রক্ত উঠে ‘বাঙলা’ শব্দটা বলে। বোবার মুখ দিয়ে রক্ত উঠে ঔপন্যাসিক আহমদ ছফা রূপকার্থে সংগ্রামকে দেখান যেখানে ভাষার প্রতি একজন গৃহবধূরও দরদ আছে বাইরে আন্দোলনরত মানুষের পাশাপাশি।
৩.
শেষবার মিছিলের সাথে নিজের কথা বলার চেষ্টাটা চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় শাবনূরের। আওয়াজ করতে করতে লুটিয়ে পড়ে আর রক্তমাখা কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে ‘বাঙলা’ শব্দটি। ওটা সেরা মুহূর্ত ছবির।
মাহফুজের চরিত্রটি সরকারি কর্মকর্তার এবং সে ভীতু। নিজের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে ভালোবাসে। তার অফিস আর বাড়ি ছাড়া তেমন কোনো যাতায়াত নেই। মিছিল দেখলে সে ভয় পায়।মিছিলের মর্ম তার বোঝার বাইরে। সে আড়ালে থেকে মিছিলের চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। তারপর লোকজনের কাজ নেই বলতে থাকে। মাহফুজ অবশ্য ছবির শেষ দৃশ্যে শাবনূরের রক্তমাখা মুখে ‘বাঙলা’ শব্দটি শোনার পরে তার চেতনা ফিরে আসে। মাহফুজ তার ছোটবোনকে যখন পড়ায় বোন (উপমা) শাসন করে। ‘personality’ শব্দের ব্যাখ্যা জানার ফাঁকে শাসন করলে বোন এজন্য তার কাছে পড়তে চায় না তখন মাহফুজ বলে-‘না জানাটা অপরাধ না কিন্তু জানতে না চাওয়াটা অপরাধ, জানতে না চাওয়াটা লজ্জার।’ শাবনূরকে psychological support দিতে মাহফুজের চেষ্টা ভালো ছিল। বোনের জন্য হারমোনিয়াম কিনলে শাবনূরও গলা সাঁধতে চায়। শাবনূর রাতে ছাদে গিয়ে গলা সাঁধলে মাহফুজ বলে-‘তোমাকে কেউ বোঝে না।’ এ সংলাপটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ শাবনূরের চরিত্রটি অসহায় মেয়ের ছিল।
হুমায়ুন ফরীদির চরিত্রটি নিখুঁত। মেয়ে শাবনূরের সাথে দেখা করার পর বাড়ি থেকে বের হবার পর দেয়ালে লেখা শ্লোগান-‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’ দেখার সময় একচোখে যে এক্সপ্রেশনটা দেয় ওটা তার পক্ষেই সম্ভব। ভাষা সংগ্রামের প্রতি তার সমর্থন ছিল না। সুবিধাবাদী চরিত্রে ছিল। তার অভিনয়ে সেটাই ফুটে ওঠে।
ছবির গানের মধ্যে ‘কথার ভেতরে কথা থাকে/কে পারে বুঝিতে তারে’ গভীরতাসম্পন্ন ছিল। গানটি জীবনের দর্শনকে তুলে ধরে।
‘ওঙ্কার’ নামটিতে যে আহবান আছে আহমদ ছফা-র শহীদুল ইসলাম খোকন নিজের ট্র্যাকের বাইরে গিয়ে সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং তিনি সফল। ছবিটি ভাষা সংগ্রামের অন্যতম প্রধান চেতনা সৃষ্টিকারী দলিল।
আহমদ ছফা, শহীদুল ইসলাম খোকন ও ‘বাঙলা’ তিনটিই ক্লাসিক হয়ে থাকুক।