Select Page

ব্র্যান্ড ডিরেক্টর শহীদুল ইসলাম খোকন

ব্র্যান্ড ডিরেক্টর শহীদুল ইসলাম খোকন

একটা সময় ছিল যখন শহীদুল ইসলাম খোকন নামটাই হয়ে উঠেছিল তাঁর ছবির সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। হ্যাঁ, তাঁর ছবিতে তখনকার সব পর্দা কাঁপানো অভিনয়শিল্পীরা ছিলেন কিন্তু তারপরেও একজন শহীদুল ইসলাম খোকন ছিলেন নিজেই নিজের পরিচয় যা তিনি তাঁর মেধা ও কাজ দিয়ে অর্জন করেছিলেন। ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছিলেন।

শহীদুল ইসলাম খোকনের জন্ম বরিশালে। মাসুদ পারভেজ সোহেল রানার ‘মাসুদ রানা’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। সোহেল রানাই তাঁর চলচ্চিত্রের গুরু। তিনি সোহেল রানার কাছেই পরামর্শ নিতেন তাঁর ছবির গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য। শিল্পী ডলি সায়ন্তনী ‘উত্থান পতন’ ছবিতে তার সুপারহিট গান ‘রংচটা জিন্সের প্যান্ট পরা’-র প্লেব্যাক করার জন্য অডিশন দিয়েছিলেন সোহেল রানার কাছেই। সোহেল রানা তাকে গানটির জন্য উপযুক্ত মনে করলে তাকে ফাইনাল করা হয়। এমন অনেক সিদ্ধান্ত সোহেল রানাই খোকনকে দিতেন যেটি ছবির জন্য পজেটিভ হয়ে আসত এবং খোকন সেগুলোকে নিজের মেধায় পরিবেশন করতেন।

শহীদুল ইসলাম খোকনের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারকে তিনটি দিক থেকে দেখা যায়। প্রথমত আশি-নব্বই দশকের সময়ে তাঁর ছবিতে তখনকার ক্রেজ ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি ও রুবেল। এই হিরো-ভিলেন জুটির ক্রেজ তিনি তৈরি করেছিলেন যেসব ছবি দিয়ে সেটা একটা দিক স্পেশালি মার্শাল আর্টের বাপক জনপ্রিয়তার ছবিগুলো, দ্বিতীয় দিক হলো অন্যান্য কমার্শিয়াল ছবি এবং তৃতীয় দিক হলো এক্সপেরিমেন্টাল ছবি।

প্রথম ছবি: রক্তের বন্দী
খোকন-ফরীদি-রুবেল কোলাবোরেশন: লড়াকু, বজ্রমুষ্টি, বীরপুরুষ, উদ্ধার, বিষদাঁত, পালাবি কোথায়, অকর্মা, বিপ্লব, উত্থান পতন, নরপিশাচ, সন্ত্রাস, টপ রংবাজ, অপহরণ, শত্রু ভয়ঙ্কর, সতর্ক শয়তান, ঘাতক, দুঃসাহস, বিশ্বপ্রেমিক, রাক্ষস, লম্পট, গৃহযুদ্ধ, চারিদিকে শত্রু, দিন মজুর, ভণ্ড, পাগলা ঘণ্টা, যোদ্ধা, মুখোশধারী, চাই ক্ষমতা
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবি: রক্তের বন্দী, পদ্মগোখরা, কমান্ডার, ম্যাডাম ফুলি, ভিজা বিড়াল, টাকা, লাল সবুজ ও চেহারা: ভণ্ড ২
এক্সপেরিমেন্টাল: ওঙ্কার ও স্বপ্নপূরণ

প্রথম ছবি ‘রক্তের বন্দী’ ছিল ফোক-ফ্যান্টাসি বা রাজা-বাদশাদের গল্প। ছবিটি ফ্লপ হয়। শহীদুল ইসলাম খোকনের যে পরিচিতি গড়ে উঠেছিল অ্যাকশন নির্মাতা হিসেবে তার সাথে তাঁর প্রথম ছবির কোনো মিল নেই। মূলত সোহেল রানার পরামর্শে ‘লড়াকু’ ছবি দিয়েই খোকনের নিজস্ব আইডেনটিটির যাত্রা শুরু হয়। এ ছবির সুপারহিট সাফল্যের পর একের পর এক মার্শাল আর্টভিত্তিক ছবি নির্মাণ করতে থাকেন এবং দর্শক সাদরে গ্রহণ করতে থাকে। রুবেল-ফরীদির ছবিগুলো ছিল ডিরেক্টর হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য।

তিনি কমার্শিয়াল ছবিকে ইউনিক সব আইডিয়া দিয়ে রিপ্রেজেন্ট করেছেন। কিছু নমুনা দেখা যাক:

এক. ‘বিপ্লব’ ছবিতে রুবেলের ইঁদুর কামড়ে দেয়ার মতো অদ্ভুত ঘটনা।

দুই. ‘বজ্রমুষ্টি’র মতো ছবিতে মার্শাল আর্টের ইতিহাসকে শৈল্পিকভাবে প্রদর্শন করা যেখানে ছবিটিতে নায়ক থেকে শুরু করে সবার গেটাপ, কস্টিউম সবকিছুতে ছিল নতুনত্ব এবং মার্শাল আর্টের ইতিহাসকে গল্পে গল্পে প্রেজেন্ট করার ঘটনা।

তিন. ‘অপহরণ’ ছবিতে ফরীদিকে কমেডি ভিলেন হিসেবে এন্টারটেইনিং করে তোলা। মাথায় ঘুষি দিলে আলুর মতো ফুলে যেত আর অদ্ভুত ভঙ্গিতে সেটা নিয়ে মজা করতেন ফরীদি।

চার. ‘বিষদাঁত’ ছবিতে অদ্ভুত যন্ত্রের মাধ্যমে ইলিয়াস কোবরাকে দিয়ে টার্গেট কিলিং করানো।

পাঁচ. ‘বিশ্বপ্রেমিক’ ছবিতে তিলকে কেন্দ্র করে সিরিয়াল কিলিং-এর ইনোভেটিভ আইডিয়া। এছাড়া ভিলেন-নায়িকা রোমান্সে ফরীদি-মৌসুমীর ‘তোমরা কাউকে বোলো না’ গানের ইউনিক ব্যবহার।

ছয়. ‘ভণ্ড’ ছবিতে ড্যান্সিং কুংফুর কমিক ব্যবহার।

সাত. ‘ম্যাডাম ফুলি’ ছবিতে ফুটবল কুংফুর ব্যতিক্রমী ব্যবহার।

আট. ‘টাকা’ ছবিতে অদ্ভুত এক যন্ত্রের মাধ্যমে মাইন্ড চেঞ্জ করে মজার সব কান্ড ঘটানো হয়। কমেডি ছবি।

নয়. ‘যোদ্ধা’ ছবির প্রচারে পুরো পোস্টারে শুধু নিজের নাম লিখে প্রচার করেছিলেন কোনো নায়ক-নায়িকা-ভিলেন কিছুই ছিল না।

তাঁর ছবিতে খুব সূক্ষ্মভাবেই সোশ্যাল মেসেজ থাকত। যে মেসেজ কাজী হায়াৎ তাঁর ছবিতে দিতেন খোকনও দিতেন। কনটেন্টের দিকে খেয়াল করলে তা বোঝা যায়। ‘সন্ত্রাস’ ছবিতে সেই সময়ের সমাজের বাস্তব চিত্র উপস্থিত ; ‘পালাবি কোথায়’ ছবিতে কমেডির আড়ালে নারীলোভী মালিক বা শ্রমিক অসন্তোষের জন্য দায়ী ফরীদিকে শাস্তির মাধ্যমে এ সেক্টরের বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে, ‘ভন্ড’ ছবিতে সমাজে ভদ্রবেশী ভন্ডদের মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে রাজিবের চরিত্রটির মাধ্যমে, ‘ঘাতক’ ছবির মাধ্যমে ৭১ পরবর্তী মুখোশধারী নেতাদের মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে, ‘গৃহযুদ্ধ’ ছবিতে পারিবারিক সম্পর্কের টানাপড়েনকে তুলে ধরা হয়েছে, ‘মুখোশধারী, চাই ক্ষমতা’ ছবিগুলোতে ক্ষমতার জন্য সুবিধাবাদীরা কতদূর যেতে পারে সে বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে, ‘লাল সবুজ’ ছবিতে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও লোকাল পলিটিক্সের বাস্তব চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। ‘ভিজা বিড়াল’ ছবিতেও ভদ্রবেশী দুশ্চরিত্রের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। এভাবে খোকনও হয়ে উঠেছেন বক্তব্যধর্মী ছবির নির্মাতা।

এক্সপেরিমেন্ট করেছেন সাহিত্যভিত্তিক ছবিও। উনত্তরের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে আহমদ ছফার কালজয়ী উপন্যাস ‘ওঙ্কার’ অবলম্বনে ‘বাঙলা’ ছবিটি নির্মাণ করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। শাবনূরের ক্যারিয়ারের অন্যতম শক্তিশালী অভিনয়ের ছবিটি এসেছে খোকনের হাতেই। ছবিতে তিনি বোবা মেয়ের চরিত্রে শাবনূরকে দিয়ে অসাধারণ অভিনয় আদায় করে নিয়েছেন। সাহিত্যভিত্তিক ছবিতেও যে তাঁর সম্ভাবনা অনেক ছিল সেটি পরিষ্কার এ ছবিতে। মৌসুমীকে নিয়ে ‘স্বপ্নপূরণ’ ছবিটিও হার্ট টাচিং গল্পে ছিল এবং এক্সপেরিমেন্টাল কাজ খোকনের। মাহফুজকে দিয়ে নির্মিত ‘লাল সবুজ’ ছবি তাঁর ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য ছবি এবং মাহফুজের ক্যারিয়ারেও বহুল প্রশংসিত ছবি ছিল।

খোকনের ছবির বহু গান সুপারহিট ছিল। উল্লেখযোগ্য: বুকে আছে মন, সুন্দর এই পৃথিবী ভালো লাগে না, মন যারে চায় তারে প্রেম শেখাবো – লড়াকু, রংচটা জিন্সের প্যান্ট পরা – উত্থান পতন, জীবনে একজন প্রিয়জন – বজ্রমুষ্টি, তোমরা কাউকে বোলো না, শিখা আমার শিখা – বিশ্বপ্রেমিক, শোনো শোনো ও প্রিয় প্রিয় গো, এখনো সে যে এলো না – রাক্ষস, লিখিনি প্রেমেরই চিঠি – নরপিশাচ, ও সাথীরে আমারই জীবন শুধু তুমি – ভণ্ড ও দেখো দেখো আমাকে দেখো – বীরপুরুষ।

শহীদুল ইসলাম খোকনের ছবি দিয়েই রুবেল, হুমায়ুন ফরীদির দুর্দান্ত ক্রেজের পাশাপাশি ড্যানি সিডাক, ইলিয়াস কোবরা, মিশেলা, কবির খাঁ, সিরাজ পান্নারা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তারা সবাই প্রফেশনাল মার্শাল আর্টে দক্ষ ছিল। নায়িকাদের মধ্যে খোকনের ছবিতে আলোচনায় এসেছিল সিমলা (ম্যাডাম ফুলি), তামান্না (ভন্ড), পূর্ণিমা (যোদ্ধা)। নায়িকা সিমলার প্রথম ছবি ‘ম্যাডাম ফুলি’ খোকনের পরিচালনায় এবং সিমলা খুবই প্রশংসিত ছিল। সিমলা প্রথমদিন শুটিংয়ে গিয়ে ক্যামেরা কোনদিকে আছে বুঝতে পাচ্ছিল না তখন খোকন তাকে বলেছিলেন-‘তিমি ক্যামেরাকে খুঁজবে না, ক্যামেরাই তোমাকে খুঁজে নেবে, তুমি শুধু আমার কথামতো অভিনয় করে যাও।’ তাঁর সে কথাটি সিমলাকে অনেক অনুপ্রাণিত করেছিল। কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা ইন্টারভিউতে বলেছিলেন-‘খোকন ভাই একটা ছবি নির্মাণের আগে প্রচুর পড়াশোনা করতেন।’ এজন্যই তিনি ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হতে পেরেছিলেন।

শহীদুল ইসলাম খোকন নিজেও তাঁর বেশিরভাগ ছবিতে অভিনয় করেছেন ছোটবড় চরিত্রে। এর মধ্যে ‘বিষদাঁত’ ছবির ক্লাইমেক্সে ছবির ভয় ধরানো ভিলেন হিসেবে তিনিই আবির্ভূত হন হুমায়ুন ফরীদি থাকার পরেও। অভিনয়ও ছিল লাজবাব। ‘উত্থান পতন’ ছবিতে রুবেলের বন্ধু থেকে শক্রতে রূপ নিয়ে সে ছবিতেও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন। ‘সন্ত্রাস’ ছবিতে তিনি রুবেল ও জাফর ইকবালের পাশাপাশি তিনিও নায়ক ছিলেন যাকে ছবির মাঝপথে পাওয়া যায়। প্রফেশনাল মার্শাল আর্ট তিনিও এ ছবিতে দেখিয়েছেন। ‘রাক্ষস’ ছবির ‘এখনো সে যে এলো না’ গানে খোকনকে দর্শকসারিতে বসে স্টেজে নাচতে থাকা মৌসুমীর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত সব কমিক এক্সপ্রেশন দিতে দেখা যায়। আরো অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। অভিনেতা হিসেবেও তিনি ন্যাচারাল ছিলেন।

শহীদুল ইসলাম খোকনের অনেক ছবিতেই ক্রিয়েটিভ সব ট্যাগলাইন ব্যবহৃত হত। আজকালকার চলচ্চিত্রের সময়টা আপগ্রেড হলেও ছবিতে আমরা হাস্যকর ট্যাগলাইন ব্যবহার করতে দেখি। কিন্তু খোকন সেই আশি-নব্বই দশকেই অসাধারণ ক্রিয়েটিভ সব ট্যাগলাইন ব্যবহার করতেন। কিছু ট্যাগলাইন: ভন্ড – keep the imposter away, গৃহযুদ্ধ – family vs family, চারিদিকে শত্রু – no retreat no surrender, সন্ত্রাস – kill the terrorist, লম্পট – the peeping tom, নরপিশাচ – the notorious culprit, শত্রু ভয়ঙ্কর – that devil once again, যোদ্ধা – he is alone to save the paradise, বিপ্লব – symbol of new generation , সতর্ক শয়তান – the bloody hero ও পাগলা ঘণ্টা – the war for nothing।

নব্বই দশকে তিনিই পরিচালক হিসেবে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নিতেন যতটুকু শোনা যায়। এটিও পরিচালক হিসেবে তাঁর শক্ত অবস্থানের পরিচয়।

একজন শহীদুল ইসলাম খোকন তাঁর নাম তৈরি করেছিলেন ক্রিয়েটিভ ওয়েতে। তাঁর পরিচালনার ধরনই তাঁকে সমসাময়িক অন্য পরিচালকদের থেকে আলাদা করেছিল। নিজের আইডেনটিটি তৈরির মাধ্যমেই তিনি দর্শক-সমালোচকদের কাছে ব্র্যান্ড ডিরেক্টরে পরিণত হয়েছিলেন। ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল মারা যান শহীদুল ইসলাম খোকন। তাঁর আবদান আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করব।


About The Author

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

Leave a reply