Select Page

ভারতীয় সিনেমাতেই কি সমাধান?

ভারতীয় সিনেমাতেই কি সমাধান?

বিস্ময়কর হলেও সত্যি, বাংলাদেশে অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন এদেশের সিনেমা হলগুলোতে চেন্নাই, বোম্বাই ও কলকাতার সিনেমা মুক্তি দিলে এদেশের সিনেমা ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে। আগ বাড়িয়ে অনেকে আবার ভাবতে শুরু করেছেন, ভারতীয় সিনেমা এদেশের হলে না চলার কারণে বাংলাদেশের সিনেমার কাঙ্ক্ষিত উন্নতি ঘটেনি।

কোলাজ: গিয়াস উদ্দিন সেলিম, পরীমনি, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, নুরুল আলম আতিক ও হিন্দি সিনেমা ‘পাঠান’-এর দৃশ্য

মিডিয়া যে মানুষের চিন্তাকে কিভাবে ম্যানিপুলেট করে ফেলেছে তার ভালো একটি উদাহরণ এটি। আমাদের মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ তাদের পরজীবী চিন্তা দিয়ে মানুষের মস্তিষ্ককে অকার্যকর বানিয়ে ফেলতে পেরেছে, এটা দেখে খুবই কষ্ট লাগছে।

এসব ফালতু চিন্তা মোকাবেলা করতে কিছু জরুরি প্রশ্ন তোলা দরকার।

আসলে বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি কেন ধ্বংস হয়ে গেল?

আসল কারণগুলো কী কী?

বাংলাদেশের হলে ১৯৬৫ সাল থেকে ভারতীয় সিনেমা দেখানো বন্ধ হয়েছে। তা সত্ত্বেও ৭০,৮০ ও ৯০ দশক পর্যন্ত কীভাবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি ব্যবসা সফল ও প্রশংসনীয় অনেক মুভি তৈরি করতে পেরেছে?

৯০ দশকের পর কী এমন ঘটনা ঘটলো যাতে আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি মুখ থুবড়ে পড়ল?

আমার মতে, বাইরের প্রভাবকগুলোর চেয়ে আমাদের আভ্যন্তরীণ প্রভাবকগুলো সিনেমায় ইন্ডাস্ট্রির দুরবস্থার জন্য বেশি দায়ী।

বাংলাদেশে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের মতো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতেও ব্যাপক সিন্ডিকেশন ঘটেছিল। কিছু প্রযোজক-পরিচালক, নায়ক-নায়িকা পুরো ইন্ডাস্ট্রিকে দীর্ঘ সময় ধরে এমনভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন যে দীর্ঘদিন ধরে এখানে নতুন প্রযোজক-পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী ঢুকতে পারেনি। এই ব্যক্তিরা আগে ভালো কাজ করেছেন বটে। কিন্তু যুগের সঙ্গে নিজেদের পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য কনটেন্ট বানানোর উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেননি। নতুন নির্মাতাদের অভাবে আমাদের এফডিসি ক্রমান্বয়ে যুগের অনুপযুক্ত হয়ে উঠেছে। দর্শকের বিবর্তন ঘটে গেছে কিন্তু কনটেন্টের বিবর্তন ঘটেনি। পুরনো ধারার কনটেন্ট কিছুদিন পর্যন্ত নিম্নবর্গের দর্শকরা দেখে গেছে কিন্তু একসময় তারাও এগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাদের বক্তব্য আমরা পাইনি কারণ তারা কথা বলতে পারেনি। বা আমাদের জানাতে পারেনি।

আমার মনে হয়, আশির দশকের যে নতুন নির্মাতারা বেশি বেশি বিকল্পধারার দিকে ঝুঁকলেন তার পেছনে এফডিসি রিজেকশন বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু এফডিসিতে ঢুকতে না পেরে তারা যে বিকল্পধারা গড়ে তুললেন সেটা রাজনৈতিকভাবে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ছোট সিনেমা না করে তাদের উচিত ছিল বড় সিনেমা করা। কিন্তু কলকাতা প্রভাবিত ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন তাদের সেদিকে যেতে দিল না। ফলে আমরা এফডিসির বাইরে বড় সিনেমার ধারা তৈরি করতে পারলাম না। পরে ৯০ দশকে আমাদের বন্ধুরা ছোট সিনেমার আইডিয়া থেকে বের হয়ে এসে বড় সিনেমা করা শুরু করলেন। তারা একটা নতুন দিক দেখাতে পেরেছেন।

আমার মনে হয়েছে, আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির নীতি নির্ধারকরা ৯০ দশকের প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকারদের এফডিসিতে আমন্ত্রণ জানালে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হতো। কারণ ততদিনে এফডিসি নির্মাতারা ফুরিয়ে গিয়েছিলেন। নায়ক-নায়িকাদের আবেদন শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভালো প্রযোজকরা হারিয়ে এফডিসিতে ফাটকাবাজদের রাজত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো সরকারই এফডিসিতে নতুন রক্ত সঞ্চালনের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সিন্ডিকেট ভেঙে নতুন বাণিজ্যিক সিনেমা তৈরি করার উদ্যোগ আসেনি। ফলে, আমাদের সিনেমা দেশের বাজার হারিয়েছে। আমাদের বাজারে চাহিদা ছিল ব্যাপক, হল ছিল অনেক। কিন্তু এই চাহিদার বিপরীতে একজন নায়ক দুজন পরিচালক তিনজন নায়িকা যে কনটেন্ট উপহার দিচ্ছেন তাতে সারা বছরের কন্টেন্টের চাহিদার ২ শতাংশ মেটে না। এতে হল বন্ধ হয়ে গেছে, সিনেমা প্রযোজনা কমে গেছে, পরিচালনা কমে গেছে, এফডিসি হয়ে পড়েছে সংগঠনভিত্তিক একটা রাজনীতির মঞ্চ। পরিস্থিতি এমন যে এখান থেকে আর ভালো কিছু আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

অথচ এই ইন্ডাস্ট্রিতে সময় মতো তারেক মাসুদ, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, নুরুল আলম আতিক, গিয়াস উদ্দিন সেলিমসহ এসময়ের পরিচালকদের স্থান করে দিতে পারলে আমাদের সিনেমা নতুন দিগন্ত দেখতে পারতো।

নুরুল আলম আতিকের ‘পেয়ারার সুবাস’ চলচ্চিত্রে জয়া আহসান

৯০ দশকে এবং তারপরে আরো একটি ঘটনা ঘটেছে। সিনেমার মূল সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টি না দিয়ে এবং সেগুলোর সমাধানের পথ বাতলে না দিয়ে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এফডিসির সিনেমাকে নিজের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। সিনেমাকে দোষারোপ করে, সিনেমার দর্শকদের দোষারোপ করে তারা একে একটা অপরাধকর্মে পরিণত করেছে। বাংলা সিনেমা মাত্রই যে অশ্লীল, দেখার অযোগ্য, নিম্নবর্গের খেটে খাওয়া মানুষদের দর্শনীয় বস্তু এটা তারা মধ্যবিত্ত দর্শকদের মনের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফলে মধ্যবিত্ত দর্শকরা তাদের সিনেমা দেখার চাহিদা জানান না দিয়ে, তাদের মনমতো সিনেমা তৈরি করার তাগিদ না জানিয়ে বাংলাদেশের সিনেমা ও সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে। ৯০ দশক থেকে পরের ৩০ বছরে যে প্রজন্মগুলো বাংলাদেশে বড় হয়েছে তাদের মধ্যে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার অভ্যাসটাই চলে গেছে। নতুন এই বিরাট সংখ্যক দর্শক হারিয়ে সিনেমা হলগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভাগ্য বরণ করে নিয়েছে।

আমার কাছে সবসময় মনে হয়, বাংলাদেশে বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি ও শোবিজ নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে সব সময় ভারতীয় কনটেন্টের ভোক্তা হয়ে থাকুক এটা আমাদের দেশের অনেক মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী ও নীতিনির্ধারকরা সচেতনভাবে চান। ফলে এদেশের কনটেন্টকে দোষারোপ করে বাইরের কনটেন্টকে বড় করে তোলার দিকে তাদের মনোযোগ সবসময় নিবদ্ধ থাকে।

আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি, হল ব্যবস্থা ও দর্শক অভ্যাস নষ্ট করে সবচেয়ে বড় লাভ কার হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর আপনারা সহজে সবাই দিতে পারবেন। ঘরে ঘরে টেলিভিশনে ল্যাপটপে মোবাইল ফোনে পিসিতে আপনারা কোন সিনেমা দেখেন, কোন গান শোনেন, কোন সিরিয়াল দেখেন, আপনার দেশের টেলিভিশনে কোন দেশে নির্মিত বিজ্ঞাপন বেশি চলে, সেখানে মডেল হিসেবে কাদের উপস্থাপন করা হয়, পত্রপত্রিকায় কাদের ছবি বেশি ছাপা হয়, আপনি কোন নায়ক-নায়িকার ভক্ত এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলে মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যাবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংসের ফল কী হয়েছে?

ছোট পর্দার কথায় আসি।

বড়পর্দায় না হয় ভারতীয় কনটেন্ট মুক্তির ব্যবস্থা অনেকদিন ধরে হয়নি। কিন্তু ছোট পর্দায় তো বিস্তর কনটেন্ট চলেছে। আমাদের চ্যানেল পশ্চিমবঙ্গে চলার ব্যবস্থা হয়নি কিন্তু ভারতীয় চ্যানেলগুলো আমাদের এখানে সমানে চলেছে। এতে কি প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে? মানুষ কি ভারতের ওটিটি কন্টেন্ট বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ওটিটি কনটেন্ট দেখতে শুরু করেছে? আমাদের টিভি সিরিয়ালগুলো কি তাদের চেয়ে ভালো হচ্ছে? আমাদের এখানে কি বিগ স্টার তৈরি হচ্ছে?

আরেকটা প্রসঙ্গ উত্থাপন না করলেই নয়, সেটা হলো আমাদের সরকারগুলো কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে খুবই উদগ্রীব। পরিস্থিতি এমন যে স্বাধীনভাবে চিন্তা করে দর্শকের উপযোগী কনটেন্ট তৈরি করা এখানে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় নির্মাতারা লেখকরা অভিনেতা অভিনেত্রীরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতাও হারাচ্ছেন।

একটা ইন্ডাস্ট্রি আয়ের অন্যতম উৎস রেভিনিউয়ের অন্যতম উৎস আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।

আমার মনে হয় ভারত থেকে কনটেন্ট এনে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে না। মুক্ত মতের প্রসার ঘটাতে হবে, লেখক নির্মাতাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে, আর ইন্ডাস্ট্রিতে দলীয় পরিচয়ের বাইরে প্রকৃত কাজের লোকদের সুযোগ দিতে হবে, তাদের কনটেন্ট নির্মাণের অবাধ ব্যবস্থা করে দিতে পারলে বাংলাদেশ আবার সিনেমায় ঘুরে দাঁড়াবে। তরুণদের সুযোগ দিলে তারা কেউ বাণিজ্যিক সিনেমা বানাবে কেউ আর্ট ছবি বানাবে কেউ বিজ্ঞাপন বানাবে কেউ নাটক বানাবে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি তাতে ঘুরে দাঁড়াবে।

তবে এসবের আগে আমাদের চিন্তার মধ্যে যে পরজীবীতা ও চিন্তাহীনতা বাসা বেঁধেছে সেটা থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে হবে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মাহবুব মোর্শেদ

লেখক ও সাংবাদিক

মন্তব্য করুন