Select Page

ভালোবাসার ক্লাসিক গল্প ‘জীবন নৌকা’

ভালোবাসার ক্লাসিক গল্প ‘জীবন নৌকা’

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে পপসঙ্গীত ও ব্যান্ড সঙ্গীতের সূচনাকালীন সময়ে যে কজন কিংবদন্তী ব্যান্ড সঙ্গীতের স্বাদ দিয়ে ব্যান্ড সঙ্গীতকে ও তরুন প্রজন্মকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরনা দিয়েছেন তাঁদের মধ্য বাংলা গানের সুর সম্রাট ও চলচ্চিত্রের গানের সুরের যাদুকর আলম খান অন্যতম ।

পোস্টের শেষে যে গানটির লিংক দিলাম সেই গানটির অডিও কেউ যদি পূর্বে থেকে না জেনে শুনে থাকে তাহলে সেই শ্রোতা ধরে নিবে এটা কোন পপ বা ব্যান্ডশিল্পীর গান । আসলে তা নয়, আজ থেকে ৩৫ বছর আগের তরুণদের ব্যান্ড পপ সঙ্গীতকে এগিয়ে নেয়ার জন্যই আলম খান বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শক ও শ্রোতাদের পপ/ব্যান্ড সঙ্গীতের স্বাদ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন সেই চেষ্টা থেকেই এতো দারুন ও সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা কম্পোজিশন করেছিলেন তিনি ‘’জীবন নৌকা’’ ছবির প্রথম গানটিতে।

আর গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন “জীবন নৌকা’’ ছবির সহকারী পরিচালক ও পরবর্তীতে জনপ্রিয় চিত্রনায়ক আমাদের সবার প্রিয় মাসুম পারভেজ রুবেল নিজেই। চিত্রনায়ক রুবেল’কে বাংলাদেশের সিনেমা পাগল মানুষ চিনে না এমন দর্শক নেই। রুবেল চিত্রনায়ক, চিত্রপরিচালক এটা সবাই জানেন কিন্তু রুবেল যে গান গাইতে জানেন এটা ৯৮% ভক্তরাই জানে না। ৩৫ বছর আগে তিনি প্লেব্যাক করেছিলেন যা স্মৃতি সাগরে ডুব দিয়ে খুঁজে পেতে অনেক কষ্ট হয়েছে আমার ।

এবার আসি পোস্টারের ছবি “জীবননৌকা’’’ প্রসঙ্গে। বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি দিনটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আমি যখন পরিবারের সাথে শিশুকাল থেকে সিনেমাহলে সিনেমা দেখতে যেতাম তখন চলচ্চিত্রে রঙিন ছবির যুগ মাত্র শুরু।আমি পরম সৌভাগ্যবান যে রঙিন যুগেও হাতে গোনা সাদাকালো কিছু ছবি আমি সিনেমা হলে দেখেছিলাম যার অনেককিছুর কথাও আমার মনে নেই।

১৯৮১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “জীবননৌকা’’ ছবিটি আমি সিনেমা হলের বড় পর্দায় দেখেছিলাম। সেই সময়ে আমি তেমন কিছুই বুঝিনি বা মনে নেই। শুধু ভাসা ভাসা মনে আছে ছবিতে সোহেল রানা ও সুচরিতার বেশ কয়েকটি দৃশ্য আছে নৌকা চড়ার। এরপর ছবিটি কিশোর বেলায় টেলিভিশনের পর্দায় সম্পূর্ণ দেখেছিলাম যেখান থেকে ছবিটি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু কথা বলার চেষ্টা করছি।

বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রকে যারা বস্তাপচা বলেন তাঁদের কাছে এই ছবিটা হবে রীতিমতো একটা ধাক্কা। আমার দেখা বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সেরা রোমান্টিক ক্লাসিক সিনেমাগুলোর একটি হলো এই “জীবননৌকা’’ ছবিটি। ছবিটির গল্প শুধু রোমান্টিকই নয় কিছুটা মনস্তাত্ত্বিকও বটে এবং সমাপ্তিটা খুবই করুন। ‘’জীবন নৌকা’’ ছবির গল্পের বিষয়বস্তুটা আজকের তথাকথিত অনেক আর্টফিল্মের চেয়েও অনেক উঁচুমানের।

আমার যতটুকু মনে আছে গল্পটা ছিল – মাসুম (সোহেল রানা) বড়লোকের একমাত্র সন্তান যে হাসি (সুচরিতা) নামের একজনকে খুব ভালোবাসে। সোহেল রানা বাবার অমতে সুচরিতাকে বিয়ে করে যার ফলে সোহেল রানা’র বাবা এ কে কোরেশী ছেলেকে ঘর থেকে বের করে দেয়। সোহেল রানা বাবার বিশাল ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে বনবিভাগে চাকরী নেয়। কক্সবাজারে সোহেল রানা’র বদলী হয়ে আসে। এর কিছুদিন পর স্ত্রী সুচরিতাকে সরকারী বাংলোয় নিয়ে আসে। একদিন উখিয়া সম্প্রদায়ের একদল ডাকাত সোহেল রানাকে অপহরণ করে।

ডাকাত সর্দার শেষ পর্যন্ত সোহেল রানাকে সরাসরি হত্যা না করে একটা কৌশল করে যেন সোহেল রানাকেও খুন করা যায় আবার পুলিশ ও সেনাবাহিনী যেন তাদের সন্দেহও না করে এমন। সোহেল রানার গাড়িটির চাকার নাটবল্টু ঢিলা দিয়ে রাখে এবং ব্রেকের সংযোগ কেটে দিয়ে ইচ্ছেকৃত ভাবে সোহেল রানাকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় সবাই মনে করে সোহেল রানা গাড়ী দুর্ঘটনায় মারা গেছে। সোহেল রানাও না বুঝে সেই ফাঁদে পা দেয় এবং গাড়িটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়। সোহেল রানা খুবই গুরুত্বরও আহত হয়। ডাক্তার সুচরিতাকে সব খুলে বলে এবং সোহেল রানাকে আগামী ৬ মাস যে করেই হোক ছলে বলে কৌশলে শারীরিক সম্পর্ক থেকে যেন বিরত রাখতে হবে তা না হলে সোহেল রানার একটি পা পুরো পঙ্গু হয়ে যেতে পারে এবং মানসিক ভাবেও বিকারগ্রস্থ হয়ে যেতে পারেন। সুচরিতা ডাক্তার’কে অনুরোধ করে যেন সোহেল রানা কিছুতেই তাঁর শারীরিক এই অবস্থার কথা জানতে না পারে।

সোহেল রানা যখন নিজেকে সুস্থ মনে করে তখন সে সুচরিতা’কে কাছে পেতে চায়। সুচরিতা কোন না কোন ভাবেই সোহেল রানা’কে দূরে রাখার চেষ্টা করে। এ নিয়ে ধীরে ধীরে সোহেল রানা’র সাথে সুচরিতার মানসিক দূরত্ব তৈরি হয় কিন্তু সুচরিতা সব জেনেও ইচ্ছে করেই লুকিয়ে রাখে। সোহেল রানা মনে মনে ধারনা করে সুচরিতা সম্ভবত তাঁরই বন বিভাগের জুনিয়র সহকর্মী হাসানের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ। এদিকে ৬ মাস অতিবাহিত হওয়ার দিন যেদিন শেষ হলো সেইদিন সুচরিতা খুব খুশী মনে সোহেল রানাকে কাছে টানার চেষ্টা করে এবং সাগর পাড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বায়না ধরে যেখানে বসে সে গত ৬ মাসে সোহেল রানার চোখে অচেনা সুচরিতার গল্প শোনাবে বলে।

সোহেল রানা সাগর পাড়ে নিয়ে যায় কিন্তু কিছু শোনার আগেই সুচরিতাকে মেরে ফেলে পূর্বের জমে থাকা সন্দেহের ক্রোধে। সুচরিতাকে হত্যা করার পর একটি ডায়েরী খুঁজে পায় যেখানে সুচরিতা অনেক কিছু লিখে রেখেছিল। ডায়েরীতে লিখা সব কিছু পড়ার পর সোহেল রানা’র বুঝতে পারে সে ভুল করেছে। সোহেল রানা ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং সারাদিন সাগরের যে স্থানে সুচরিতাকে ডুবে যেতে সাহায্য করেছিল সেইখানে গিয়ে বসে থাকে। এক সময় সবাই জানতে পারে সোহেল রানা সুচরিতাকে খুন করেছে। সোহেল রানাও পুলিশের কাছে স্বীকার করে। পুলিশের গাড়ী থেকে পালিয়ে সেই সাগর পাড়ে যাওয়ার জন্য ছুট দিলে পুলিশ সোহেল রানাকে গুলি করে।

রক্তাক্ত সোহেল রানা সুচরিতার মতো সাগরের ঢেউয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। সাগরের স্রোতে যেভাবে সুচরিতা ডুবে মারা গিয়েছিল সোহেল রানাও সেইভাবে মারা যায়। ……… এই হলো “জীবননৌকা’’ ছবির গল্প।

“জীবননৌকা’’ ছবিটি কেমন সুন্দর রোমান্টিক ছবির গল্প ছিল সেটা আলম খানের সুরে ও সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠের “তুমি তো এখন আমারই কথা ভাবছো’’ গানটি যারা শুনেছেন তাঁরা কিছুটা বুঝতে পারেন। ছবির গল্পটা ছিল সম্পূর্ণ নতুনআঙ্গিকের এবং ভিন্নধর্মী। মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা’কে যারা বস্তাপচা সামাজিক অ্যাকশন ছবির নায়ক, প্রযোজক ও পরিচালক বলে ভাবেন সেইসব জ্ঞানপাপী, অন্ধ’রা “জীবননৌকা’’ ছবিটি দেখলে লজ্জা পাবেন নিশ্চিত।

“জীবননৌকা ছবির প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের চিরস্মরণীয় পরিচালকদের তালিকায় থাকা নাম শহিদুল ইসলাম খোকন। এই ছবিতে সোহেল রানা’র সহকর্মী হাসানের চরিত্রটি করেছিল সোহেল রানা’র আপন ছোট ভাই কামাল পারভেজ আর ছবিটির সহকারী পরিচালকদের তালিকায় ছিলেন আরেক ছোট ভাই মাসুম পারভেজ রুবেল। অর্থাৎ পারভেজ ভ্রাতা ত্রয়ীদের একটি শিল্প সমৃদ্ধ ঠাণ্ডা শীতল ছবি “জীবননৌকা’’ যা আমাদের বাণিজ্যিক ছবির ক্লাসিক ছবিও বলা যায়।

জীবন নৌকা
অভিনয়ে – সোহেল রানা, সুচরিতা, ডলি চৌধুরী , টেলিসামাদ, আনোয়ার হোসেন ও কামাল পারভেজ
গীতিকার – গাজী মাজহারুল আনোয়ার
সুর ও সঙ্গীত – আলম খান
প্রযোজক, পরিচালক – মাসুদ পারভেজ
পরিবেশনায় – পারভেজ ফিল্মস
মুক্তির সাল – ১৯৮১


মন্তব্য করুন