Select Page

ভালোবাসা যেভাবে ‘আনন্দ’ ও ‘অশ্রু’ হয়ে যায়

ভালোবাসা যেভাবে ‘আনন্দ’ ও ‘অশ্রু’ হয়ে যায়

আনন্দ অশ্রু
পরিচালক : শিবলি সাদিক
শ্রেষ্ঠাংশে : সালমান শাহ, শাবনূর, কাঞ্চি, দিলদার, সিরাজুল ইসলাম, সাদেক বাচ্চু, খালেদা আক্তার কল্পনা, ডলি জহুর, হুমায়ুন ফরীদি, নানা শাহ প্রমুখ।
উল্লেখযোগ্য গান : তুমি মোর জীবনের ভাবনা, তুমি আমার এমনই একজন, থাকত যদি প্রেমের আদালত, উত্তরে ভয়ঙ্কর জঙ্গল।
মুক্তি : ১ আগস্ট ১৯৯৭

‘আনন্দ’ আর ‘অশ্রু’ দুটো একজন আর একজনের জানের দুশমন বলা যায়। এদেরকে একজন আরেকজনের সৎভাইও বলা চলে। কারণটা হল এরা একে অপরকে দেখতে পারে না তাই ‘আনন্দ’ বেশিক্ষণ দীর্ঘ হয় না, ‘অশ্রু’ এসে জায়গা দখল করে। সালমান শাহ-শাবনূরের মিষ্টি-মধুর প্রেমের ‘আনন্দ’ তাই ‘অশ্রু’ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি।

ছবির শুরুটা দেখার মতো। হুমায়ুন ফরীদি তার নিজের সাম্রাজ্য রক্ষা করতে ডলি জহুরের স্বামীকে হত্যা করে। ডলি জহুর বরাবরের মতোই গগনবিদারী কান্নায় নিজের করুণ অবস্থা তুলে ধরে। তার দস্যি মেয়ে শাবনূর। তার বৈশিষ্ট্য হলো ঘরে না থাকা, বনে-বাদাড়ে ঘোরা আর এটা ওটা করে লোকের ঘুম হারাম করা। লোকে তাকে পাগলি মেয়ে ভাবলেও সে কিন্তু বুদ্ধিমতী কেননা সে জানে কোথায় কিভাবে যেতে হবে। তার তো সব জানা। যেমন সে গানে গানে জানাচ্ছে –

‘উত্তরে ভয়ঙ্কর জঙ্গল
দক্ষিণে না যাওয়াই মঙ্গল
পূর্ব-পশ্চিম দুই দিগন্তে নদী’

এমন করে কে বলবে কোথায় যাওয়াটা ভালো এবং কোথায় আছে ঘোর বিপদ! শাবনূরের ইমম্যাচিউর বিষয়টা সালমান শাহ আসার পরে ম্যাচিউরিটির দিকে যায়। দেওয়ানগণ্জে ঘুরতে যাওয়া সালমান, কাঞ্চি, দিলদারের দল সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সালমান গাছতলায় বসে গান লেখে ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’ আর পৃষ্ঠাগুলো ঢিল দিয়ে আটকে রাখে যাতে বাতাসে উড়ে না যায়। কিন্তু পৃষ্ঠাগুলো যে পেছন থেকে পগার পার হয়ে যাচ্ছে সেটা টের পায় পরে। শাবনূর এটা করে। শেষে ধরাই পড়ল। এর আগে গাছের মগডালে বসে ভূতের ভয় দেখাত সে। একবার তো দিনের বেলাতেই ভয়ে কাঁপাকাঁপি হবার যোগাড় দিলদারের। সেই চঞ্চল পাড়াগাঁয়ের মেয়ে শাবনূরের পরিবর্তনটা এল ভালোবাসার স্পর্শে। সাপে কাটার পরে সালমান যখন বিষ তুলে ফেলল জ্ঞান ফেরার পর পুরো পরিস্থিতিটা বুঝতে দেরি করেনি শাবনূর। তারপর বাড়িভর্তি লোকের সামনেই জড়িয়ে ধরল সালমানকে। প্রথম পর্বের ঘটনা ততক্ষণ পর্যন্ত আনন্দের মধ্যেই থাকে।

ছবিতে ‘আনন্দ’-র থেকে ‘অশ্রু’ বেশি। বলতে গেলে রোমান্স থেকে স্যাড পার্ট বেশি। ঐ যে সালমানকে জড়িয়ে ধরেছিল শাবনূর সাপে কাটার পর তার জীবন যখন বাঁচায়। এ রোমান্টিক মুহূর্তে দানব হুমায়ুন ফরীদি হাজির। ভালোবাসা যার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয় সে যে ভালোবাসাকে গলাটিপে মারবে সে তো জানা কথা। অতঃপর, ‘অশ্রু’-র আয়োজন শুরু। টনিসাহেব মানে নানাশাহকে ডেকে সালমানকে পাগলের ইনজেকশন দিয়ে ঢাকা নিয়ে যাবার আয়োজন চলে। স্যাড পার্টের কিছু পর্যায় থাকে ছবিতে।

দেওয়ানগণ্জ জায়গাটি ছবিতে একটা zonal importance তুলে ধরে। সালমান শাহ-র প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি এর সাথে সংশ্লিষ্ট। যে দেওয়ানগণ্জে তার জীবনের রোমান্টিক সময়ে দোলার আগমন ঘটে আবার চিকিৎসার জন্য সেই দেওয়ানগণ্জেই তাকে আসতে হয়। দর্শকের কাছেও ‘দেওয়ানগণ্জ’ নামটি এ ছবিতে একটা কালজয়ী নামে পরিণত হয়েছে।

স্যাড পার্টে ‘অশ্রু’-র চূড়ান্ত পর্বটা শুরু হয় তখন যখন সালমানের চিকিৎসার দায়ভার শাবনূর বা দোলার হাতেই পড়ে। শাবনূরকে টাকা দিয়ে রাজি করাতে পারে না সালমানের বাবা সাদেক বাচ্চু। পরে কাঞ্চি আঁচল পেতে তার ভালোবাসার মানুষটিকে বাঁচাতে বলে। শাবনূর রাজি হয়। একসময় ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’ গানটির মাধ্যমেই সালমানের জ্ঞান ফিরে আসতে থাকলে দর্শক হিশেবে ‘আনন্দ’ আবার ফিরে পাবার বাসনা থাকলেও তা আর হয় না। ততক্ষণে হুমায়ুন ফরীদি তার দলবল নিয়ে হাজির। ভালোবাসার করুণ পরিণতি আসে ‘অশ্রু’তে আর দর্শক বুঝে যায় ভালোবাসায় ‘আনন্দ’-র থেকে ‘অশ্রু’ই দীর্ঘস্থায়ী হয়।

অভিনয়ে সালমান শাহ বরাবরই ক্লাসিক। তার প্রেমিক ও পাগল চরিত্র দুটিতে একশোতে একশো মিশে যেতে সে নিজেকে ঢেলে দিয়ে অভিনয় করেছে। সাপে কাটা শাবনূরের বিষ তুলে রক্তমাখা মুখে তার এক্সপ্রেশন যেমন মুগ্ধ করে, গান লেখার সময় প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ায় তার জুড়ি নেই, পাগল হয়ে পাগলামিতে ‘তুমি আমার এমনই একজন’ গানে মিশে যায় সহজাত অভিনয়ে যেখানে দর্শক হিশেবে আপনার/ আমার দুটি চোখ ছলছল করে তাঁর না থাকার শূন্যতায়। পাগল হবার পরে তাঁর অভিনয়ের সূক্ষ্ম বিষয়গুলোতে চোখ আটকে থাকে। যেমন- দেওয়ানগণ্জ যাবার বায়না ধরা, টাই দিয়ে কাঞ্চিকে জড়িয়ে নেবার চেষ্টা, গাছে ওঠার চেষ্টা, কাঞ্চির কোলে মাথা রেখে খুনসুটি করা এগুলো খালি চোখে দেখা দৃশ্যের মতো জীবন্ত। তাঁকে শাবনূর ও কাঞ্চি দুজনেরই প্রেমিক হতে হয়েছে পাশাপাশি রোমান্টিক ও স্যাড পার্টে অভিনয়ের সুযোগও তাঁর বেশি ছিল। স্পেশালি পাগলের অভিনয়টা বাকিদের ছিল না। তাঁর একসাথে অনেক ভূমিকায় নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলাটা ছিল ঈর্ষণীয়। ‘সময় কোথায় বালিকা সময় নষ্ট করিবার’ কাঞ্চিকে বলা সালমানের এ সংলাপটি ছবির কালজয়ী সংলাপ হয়ে গেছে।

শাবনূর তার ভূমিকায় অসাধারণ। তার চরিত্রেও দুটি দিক। প্রথমটা গাঁয়ের চঞ্চল মেয়ে পরেরটা সালমান পাগল হবার পরে হাসতে ভুলে যাওয়া কষ্টের মূর্তি। তার ‘উত্তরে ভয়ঙ্কর জঙ্গল’ গান যেমন আনন্দ দেয় তেমনি ‘থাকত যদি প্রেমের আদালত’ অশ্রু ঝরায় সে অশ্রুকে বাড়িয়ে দেয় ‘তুমি আমার এমনই একজন’ গানে যখন ভালোবাসাকে কাছে পেয়েও সে দু’হাতে জড়াতে পারে না।

কাঞ্চিও তার সাপোর্টিং রোলে অনবদ্য। ‘তুমি আমার এমনই একজন’ এই একটা গানই যথেষ্ট তাকে এ ছবিতে স্মরণীয় করে রাখতে এবং সেটাই হয়েছে। তাছাড়া ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’ গানের প্রথম ভার্সনে কাঞ্চি চমৎকার ছিল। হুমায়ুন ফরীদি মাস্টারক্লাস অভিনেতা। পুরো ছবিতে চষে বেড়াতে সেই অভিনয়ই দেখিয়েছে। শেষবার যখন বলে-’হয় রবিনকে সারাজীবন পাগল থাকতে হইব না হইলে মরতে হইব’ তার সে রুদ্রমূর্তি ভোলা যায় না। ডলি জহুর, খালেদা আক্তার কল্পনা নিজেদের চরিত্রে সেরা। ক্লিনিকের ডাক্তার সিরাজুল ইসলাম অনবদ্য অভিনয় করেছে। সাদেক বাচ্চুর অভিনয়ও মনে রাখার মতো। দিলদার তো তার চরিত্রে রাজত্ব করবেই।

‘director’s emotion’ এ ছবিকে শক্তিশালী করেছে। সালমান শাহ-শাবনূর-কাঞ্চি ত্রিভুজ প্রেমের সমীকরণটি পরিচালক শিবলি সাদিক এত নিখুঁতভাবে ভাগ করেছেন যে ভাষাহীন হতে হয় বলতে গেলে। সালমান পাগল হবার পর তার সুস্থতা দরকার, ভালোবাসা দরকার সেদিক থেকে সালমানের চরিত্রের আবেদন শতভাগ। শাবনূর তার নার্সের ভূমিকায় থেকে কাছে পেয়েও নিজের ভালোবাসাকে জড়াতে পারছে না বুকে সে বেদনাও অসামান্য। কাঞ্চি তো সালমানের জন্য পাগল। তিনজনের বাস্তবতাকে একই ফ্রেমে আনতে তাই ‘তুমি আমার এমনই একজন’ গানটি এতটা শক্তিমান হয়ে ওঠে। সব ইমোশন একখানে এসে থেমে যায় অনন্ত তৃষ্ণা হয়ে সালমান-শাবনূরকে শেষযাত্রায় যখন চাদরে ঢেকে দেয় কাঞ্চি। ভালোবাসা ‘আনন্দ’ থেকে ‘অশ্রু’ হয়ে যায় যেখানে অশ্রুর অধিকার বেশি হয় বাস্তবতায় পড়ে।

আর হ্যাঁ ছবি শেষ হলেও দর্শক হয়ে আপনার কানে লেগে থাকবে শাবনূরকে বলা কাঞ্চির দরদী সংলাপ- ‘বলিসনি কেন হতভাগী তুই-ই খসরুর দোলা!’…


মন্তব্য করুন