ভালো থেকো ভালো নয়!
ভালো থেকো
পরিচালনা : জাকির হোসেন রাজু
অভিনয় : আরিফিন শুভ, তানহা তাসনিয়া, রোজ, কাজী হায়াত, রেবেকা, অরুণা বিশ্বাস ও আমজাদ হোসেন।
রেটিং : ১.৫/ ৫
২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬-মহরতের দিন থেকেই অপেক্ষা করছিলাম ’ভালো থেকো’ চলচ্চিত্র দেখবার জন্য। গেল বছরের ঈদ, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮-এরকম বেশ কয়েকটি তারিখে চূড়ান্ত হয়েও ‘ভালো থেকো’ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে বিলম্ব হচ্ছিল। তর সইছিলো না। অবশেষে এ সপ্তাহে অপেক্ষার পালা শেষ হলো। মুক্তির আলো দেখলো ‘ভালো থেকো’।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র কিংবা রাজনৈতিক নেতা নই; পরিচালক জাকির হোসেন রাজু যাদের ছবিটি দেখতে নিষেধ করেছিলেন। আমি আমজনতা। শুধুমাত্র বিনোদন পাবার নিমিত্তে টিকেট কেটেছিলাম। কতটুকু বিনোদন আহোরণ করতে পেরেছি, সে কথায় পরে যাবো। তবে শুরুতে জাকির হোসেন রাজুকে সাধুবাদ জানাই, দীর্ঘদিন পর মৌলিক একটি কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য। সাম্প্রতিককালে চলচ্চিত্রের নামকরণেও অতি-বাণিজ্যিকরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সেই হিসেবে ‘ভালো থেকো’ নামটি স্বস্তি যোগায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সম্পূর্ণ মন ভালো করা আবেশে ‘ভালো থেকো’ মুক্তির প্রথম দিন প্রথম শো দেখেছি।
কবি চন্ডীদাস বলেছিলেন, ‘শোনো মানুষ হে ভাই, সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’-এক বাক্যে বললে ‘ভালো থেকো’ ছবির গল্প এই একটি চরণকে ঘিরেই আবর্তিত। গল্পের প্রথম ভাগে বিয়ে বাড়িতে মূল নায়ক-নায়িকার পরিচয়, খুনসুঁটি, অত:পর ভালো লাগা, মনের অজান্তে ভালোবাসা এবং দ্বিতীয়ভাগে নায়কের শেকড় খোঁজার পর্ব। কাহিনীকার তার গল্প ভাবনায় সৎ ছিলেন, সন্দেহ নেই। তবে এ গল্প বলতে গিয়ে বার বার তাল-লয় হারিয়ে ফেলেছেন নির্মাতা।
শুরুতেই ‘বিয়ে বাড়ি’র পর্বে জয় (আরিফিন শুভ) চরিত্রকে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা, আমুদে এক যুবক হিসেবে পরিচয় করাতে গিয়ে দর্শকদের রীতিমত বিরক্ত করা হয়েছে। হয়তো অবচেতন ভাবেই হয়েছে, তারপরও আরিফিন শুভ যখন ঢাকাইয়া ভাষায় সংলাপ দিচ্ছিলেন মনে হচ্ছিল তিনি যেন আনিসুর রহমান মিলনকে অনুসরণ করছিলেন। তাছাড়া কমেডি দৃশ্যগুলোতে শুভ’র অতি অভিনয় তার স্বভাব সুলভ ব্যক্তিত্বকে বার বার খর্ব করছিল। যাত্রা ঢংয়ে বলা শুভ’র সংলাপ বলার ভঙ্গি দেখে বিস্মিত হচ্ছিলাম-এই শুভই কি ঢাকা অ্যাটাক-এর সেই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শুভ? একজন অভিনেতার সব ধরনের চরিত্রেই অভিনয় করতে হয়। কিন্তু ‘ভালো থেকো’ ছবিতে আরিফিন শুভকে সমর্থন দেয়নি চিত্রনাট্য, সংলাপ ও দক্ষ পরিচালনা। ‘জয়’ চরিত্রকে যতবার জোর করে নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক, মায়াময় করে তোলার চেষ্টা হচ্ছিল, ততবার কৃত্রিম মনে হচ্ছিল। ছোটখাটো অনেক ভুল এড়িয়ে গিয়েছি। তবে বেশ কিছু ‘বড় অসঙ্গতি’ বিস্মিত করেছে। বিয়ে বাড়ির দৃশ্যে যেমন পাত্রীর বিয়ে পড়াবার সময় বর পক্ষ থেকে শুধুমাত্র শুভ-ই মেয়েদের ঘরে উপস্থিত থাকেন। বর পক্ষের অন্য কোনো পুরুষ, বিশেষ করে কোনো নারীর উপস্থিতি নেই কেন? বিয়ে পর্ব শেষ করে নীলা (তানহা তাসনিয়া) যখন বোনের বিরহে কাতর হয়ে এক দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে গান ছেড়ে নিজেকে হালকা করার আয়োজন করেন, ঠিক সেই মিনিট খানেক সময়ের মধ্যেই কোনো এক জাদুমন্ত্রবলে নীলার বাবা-মা (কাজী হায়াত ও রেবেকা) নিজেদের পোষাক ও চুলের সাজ পরিবর্তন করে ফেলেন।
শুধু তাই নয়, এ ছবিতে চীন দেশের নাগরিকদের গিলে ফেলবার কথাও সমস্বরে উচ্চারণ করেছেন অভিনয়শিল্পীরা। তাও ১ বার নয়, গুণে গুণে ১১ বার। তানহা, তানহার বোন, কাজী হায়াত, আরিফিন শুভ-সবার একটাই দাবী: চাইনীজ খাবো। ‘মা, আমি চাইনীজ খাবো/ বাবা, আমি চাইনীজ খাবো/ নীলা আজ চাইনীজ খাবে’। চলচ্চিত্র একটি বৃহৎ গণমাধ্যম। অন্তত আমরা সংলাপ লিখবার সময় আরেকটু সংবেদনীল হতেই পারি। এভাবে বলা যেতে পারতো: চাইনীজ রেস্টুরেন্টে যাবো কিংবা চাইনীজ ফুড খাবো। কিন্তু সরাসরি ১১ বার চাইনীজ খাবো বলাটা বেশ কানে লেগেছে। তাছাড়া এত যুদ্ধ যে চাইনীজ রেস্টুরেন্টে যাওয়া নিয়ে, সেই রেস্টুরেন্টের ভেতর কোনো দৃশ্য নেই। বাইরেই অহেতুক এক অ্যাকশন দৃশ্যের আয়োজন করে গল্প ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।
‘ভালো থেকো’র গল্প অবশ্য আরো বেশ কিছু জায়গায় ঝুলেছে। রোজ যেমন একবার তানহার পুরো পরিবারকে তার অফিসে দাওয়াত করে। সবাই সেজেগুজে দাওয়াতে যায় ঠিকই, তবে সেই দৃশ্যেও ছিলনা কোনো খাবারের আয়োজন অথবা ছিলনা তেমন কোনো উত্তেজনা। সবকিছু কেমন যেন পানসে। গল্পের একটা পর্যায়ে আরিফিন শুভ সবকিছু থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখেন। এই সময়কাল নিয়েও চলে বিতর্ক। কাজী হায়াত বলেন, দুই দিন ধরে শুভর ফোন বন্ধ। পরের দৃশ্যে তানহা বলেন, গতকাল থেকে শুভ’র কোনো হদিস নেই। প্রকৃত ইতিহাস আসলে কোনটি? তাছাড়া এই ২/১ দিনের বিরতিতে শুভ’র চুলের স্টাইলেরও আকাশ-পাতাল পরিবর্তন হয়ে যায়। বিএফডিসি’র ছাদ থেকে কাজী হায়াতকে দেখে শুভ একরকম স্টাইল করেন। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতেই তার চুল বড় হয়ে যায়। ম্যাজিক শো’টা মন্দ ছিলনা। তাছাড়া পরিচালক ভুলে গিয়েছিলেন, বিএফডিসি’র অলি-গলি, ছাদ এখন বাংলা সিনেমা প্রেমী সব দর্শকের মুখস্থ। এই ছাদকে শুভর আর্কিটেকচারাল ফার্মের অফিসের ছাদ বলে চালানোটা দৃষ্টিকটুই লেগেছে। তাছাড়া তানহার বোনের বিয়ের দিন বিশাল গেটের সামনে ‘১৫ আগষ্ট: জাতীয় শোক দিবস পালন করুন’ পোস্টারের একাংশ-ও দর্শকের চোখ এড়িয়ে যায়নি।
এসব দেখতে দেখতে বার বার ভাবছিলাম, বাজেটের স্বল্পতা নয়, এসব ভুলের পেছনে অবহেলা-অনাদরই মূল কারণ। খুব বেশি অযত্নে জন্ম নিয়েছে চলচ্চিত্র ‘ভালো থেকো’। প্রমাণস্বরূপ আরো বলা যায়: অরুণা বিশ্বাস যতবার তার ছেলে রোজকে নিয়ে তানহাদের বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামেন, ততবার মনে হয় গাড়ি সহ তারা মা-ছেলে যেন শূন্যে ভাসছেন। বিএফডিসি’তে সেট ফেলে এত অদ্ভুত ক্রোমায় দৃশ্যগুলো ধারণ করা হয়েছে, যে কোনো দর্শকই এই ‘ফাঁকিবাজি’ ধরতে পারবেন। কাজী হায়াতের ফাঁকিবাজি দেখে তো দুই বার আমার পাশের দর্শক হেসেছেন। ডায়াল না করেই তিনি দেদারসে মুঠোফোনে কথা বলেন। স্ক্রিনে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে ওপাশে কেউ নেই। এ ছবির টিভি রিপোর্টার আরেক ধাপ এগিয়ে। তিনি মাথায় রোদচশমা গুঁজে স্টাইল করে খবর পেশ করেন। এসব দৃশ্য দেখে একটা পর্যায়ে মনে হয়েছে, পরিচালক বলে বোধ হয় এ ছবিতে কেউ ছিলেন না। যেমন: তানহা-শুভর সাথে কথা কাটাকাটির পর রোজ তানহাদের বাড়িতে নালিশ করতে আসেন। কিন্তু রোজ কিছু বলবার আগেই ক্যামেরা প্যান করে দেখানো হয় বাবা-মা, তানহার বোন, দুলাভাই সবারই মন ভীষণ খারাপ। সংলাপ প্রক্ষেপণের আগেই মুখ ভার হয়ে থাকবার কারণ কি? এরকম অসংখ্য কৃত্রিমতায় পুষ্ট ছিল ‘ভালো থেকো’।
তানহা-শুভর প্রথম দেখা হবার দৃশ্যের অভিনয়ও ছিল বেশ কৃত্রিম। ‘বিয়ে’ গানে কাজী হায়াতের হঠাৎ ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ গান গাইতে গাইতে আগমন বেশ কৃত্রিম। হিন্দি ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ ছবিতে অমরেশপুরীকে ঠিক এভাবেই ‘ও মেরি জোহরা জাবিন’ গান গাইতে দেখা গিয়েছিল। দেশি-বিদেশি ছবিতে এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে। তবে ওই দৃশ্যগুলোতে চরিত্রগুলো বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়নি। এখানে যা হারিয়েছে। আরিফিন শুভ যেভাবে তানহার আঙুল চোষেন-সেটিও বেশ কৃত্রিম এবং মান্ধাতা আমলের দৃশ্য লেগেছে। হঠাৎ করে খাবার টেবিলে কথা নেই বার্তা নেই সমবেত কণ্ঠে ‘ও আমার দেশের মাটি’ গান গেয়ে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করার বিষয়টিও ছিল ভীষণ কৃত্রিম। আরিফিন শুভ দুই/এক দিন নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়াল করেছেন জেনে অফিসকর্মী মোহাম্মদ মনজুরের কান্না ছিল কৃত্রিম এবং হাস্যকর। শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রের দৃশ্য কিংবা আরিফিন শুভ’র ছেলেবেলার দৃশ্যে তার ওপর চায়ের দোকানদারের গরম পানি ঢেলে দেয়ার দৃশ্য, রোজের বলা নেই কওয়া নেই শুভর সামনে তানহার হঠাৎ হাত ধরা-সবকিছুই ছিল কৃত্রিম। এসব দৃশ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি তো দূরের কথা, বিরতির আগের দৃশ্যটিও ছিল বেশ নিরুত্তাপ। এতটা অপরিপক্ক চিত্রনাট্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত জাকির হোসেন রাজুর কাছ থেকে আশা করা যায়না।
ছবির শেষটা অন্যান্য বাংলা ছবি থেকে ব্যতিক্রম হলেও এর যৌক্তিকতা কিংবা বিশেষ কোনো বার্তা খুঁজে পাইনি। তার মানে কি যাদের শেকড়ের কোনো অস্তিত্ব নেই, তারা কখনো সংসারী হতে পারবে না? তানহার কি দোষ? সে তো ভালোবেসেছিল শুভকে। রোজকে ভালো না বেসেও কেন সে রোজকে বিয়ে করবে? তাছাড়া রোজ যদি সত্যি সত্যিই ‘স্যরি’ হয়, তাহলে কেন সে শুভ’কে চলে যেতে দিলো? কাহিনীকার আসলে কি বোঝাতে চেয়েছেন, স্পষ্ট নয়। অবশ্য শুধু কাহিনী কিংবা চিত্রনাট্যই নয়, জাকির হোসেন রাজু এবং দেলোয়ার হোসেইন দিল-এর সংলাপও যে কোনো যাত্রাপালাকে হার মানাবে। তানহা যখন আবেগী দৃশ্যে বলেন, সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই কিংবা ওপরে আকাশ, নিচে মাটি কিংবা আমার হৃদয়ের সবটুকু জায়গা জুড়ে আছো শুধু তুমি..আমি আর কিছু ভাবতে পারিনা-প্রতিটি সংলাপ প্রক্ষেপণই ছিল যাত্রার ঢংয়ে বলা। আরিফিন শুভ’র অনেকগুলো সংলাপও একই দোষে দুষ্ট। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যের আবেগী সংলাপগুলো আরো ক্ষুরধার হতে পারতো। রোজের বোধোদয়ের সংলাপগুলো আরো মর্মস্পর্শী হতে পারতো।
আরিফিন শুভ ‘ভালো থেকো’ চলচ্চিত্রটি না করলেও পারতেন। তার প্রসঙ্গে আগেই বলেছি। ২০১৮ সালে এসে দর্শক উচ্চকিত সংলাপ বলার ভঙ্গি পছন্দ করেন না। তাছাড়া দুর্বল কমেডি দৃশ্যগুলো শুভকে ডুবিয়েছে। এ ছবিটি শুভর ভক্তরা অবশ্যই ভুলে যেতে চাইবেন।
তানহা তাসনিয়া প্রথম দুই ছবির তুলনায় এ ছবিতে বেশ কিছু দৃশ্যে বিশেষ করে গানের দৃশ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন। তবে তানহার হয়ে যিনি ডাবিং করেছেন, তাকে ভয়েস মড্যুলেশনের নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে। বেশ কিছু দৃশ্যে তানহার মুখ থেকে সংলাপ শুনে মনে হচ্ছিল যেন রোবট ‘সোফিয়া’ কথা বলছে। আশা করছি পরবর্তী ছবিতে তানহা নিজেই নিজের ডাবিং করবেন। আরেকটি ক্ষেত্রে তানহার বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন: তার রূপসজ্জা। বেশ কিছু দৃশ্যে তাকে দেখতে ভালো লাগলেও বেশিরভাগ দৃশ্যে তানহার মেকআপ এত চড়া ছিল যে, চোখে লেগেছে। তানহার বোনের বিয়ের দৃশ্যে তো এক শিশুশিল্পীই বলে: এখানে বউ কি দুটি? অতিরিক্ত সাজ কমিয়ে অভিনয়ে আরো মনোযোগী হতে হবে তানহার। যদিও নাচের দৃশ্যে বেশ সাবলীল তিনি।
তবে ‘ভালো থেকো’ ছবিতে সবচেয়ে বেশি সাবলীল যিনি, তার নাম রোজ। ছবির ৫০তম মিনিটে তার আগমন। এটা সত্যি, যতটা দুর্বলভাবে তার চরিত্র লেখা হয়েছে, ততটাই দুর্বলভাবে তার চিত্রায়ণ হয়েছে। অথচ রোজ তার স্বতঃস্ফূর্ত ও সহজ-স্বাভাবিক অভিনয় দিয়ে এর মাঝেও নিজেকে বের করে এনেছেন। তার চরিত্রে উচ্চকিত ব্যাপারটি ছিল না। ভীষণ সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে তাকে। ২/১টি দৃশ্যে যদিও তার অতিরিক্ত লিপগ্লস চোখে লেগেছে। দু-একটি দৃশ্যে উচ্চারণেও সমস্যা ছিল। তবে এই সব ভুলই মার্জনীয়। কারণ রোজকে লুক, অভিনয় ও নাচে লেটার মার্কস দেয়া যায়। অভিনয়ে সাবলীল ছিলেন অরুণা বিশ্বাস-ও।
নির্মাতারা মায়ের চরিত্রগুলোকে আরো আকর্ষণীয় এবং চ্যলেঞ্জিংভাবে উপস্থাপন করতে পারেন ভবিষ্যতে। অরুণা বিশ্বাসের মত অভিনেত্রীরা খুব সহজেই কঠিন চরিত্রগুলোকে রাঙিয়ে দেবার যোগ্যতা রাখেন-তার প্রমাণ পাওয়া গেছে এ ছবিতে। রেবেকা এ ছবিতে তেমন কোনো সুযোগ পাননি। অতিথি চরিত্রে আমজাদ হোসেনের চরিত্রও দায়সারাভাবে লেখা হয়েছে। কাজী হায়াত সে তুলনায় বেশ ভালো সুযোগ পেয়েছেন এবং বরাবরের মত তার অভিনীত চরিত্রের বারোটা বাজিয়েছেন। আর কতদিন ইস্পাত কঠিন যন্ত্রমানবের মত করে সংলাপ বলবেন তিনি? অথচ একজন দক্ষ অভিনেতা এ চরিত্রটিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারতো।
‘ভালো থেকো’ ছবিতে গান রয়েছে ৪টি। এর মধ্যে স্যাভির সুর করা ‘বিয়ে’ গানটির ‘যায় না তবু মন পাওয়া, মেয়েদের মন পাওয়া’ কথার সুরে স্যাভি’র-ই সুর করা ‘আশিকি’ ছবির ‘মেয়েদের মন বোঝা’ গানের প্রভাব স্পষ্ট। তাছাড়া গানের চিত্রায়ণের মধ্যে হিন্দি ‘হাম তুম’ ছবির ‘গোরে গোরে’ গানের অনুপ্রেরণা রয়েছে, বোঝা যায়। এ গানটি স্যাভি এবং প্রস্মিতা গেয়েছেন। ‘হিল’ গানটি যেমন গেয়েছেন স্যাভি এবং গোপিকা। ভিনদেশী শিল্পীরা দেশের ছবিতে গাইতেই পারেন। তবে দেশের এত গুণী ও জনপ্রিয় শিল্পী থাকতে ভারতের স্যাভি, গোপিকা, প্রস্মিতারা এ ছবির গানে বাড়তি কি আবেদন যুক্ত করতে পারলেন, প্রযোজকের কাছে জানতে চাই। ‘হিল’ গানটির পর্দায় আগমন হঠাৎ করেই। বাড়তি ইফেক্ট দিয়ে আমাদের জানানো হয় রোজ একজন ‘লাভ গুরু’। তবে ঐ গানের পূর্বে কিংবা পরে এ ধরনের কোনো ইঙ্গিতই কিন্তু পাওয়া যায়নি। অহেতুক তাকে ‘লাভ গুরু’ বলবার কারণ কি? তাছাড়া এই গানের পূর্বে মাত্র একবার তানহাদের বাড়িতে তানহার সাথে রোজের দেখা হয়। অথচ রোজের কল্পনায় গানের কথা-‘হিলের ঐ টকাস টকাস, লাগে লাগে লাগে ঝাকাস/ আড়চোখে তুই তাকালে, বুকটা করে ঢকাস ঢকাস’। কল্পনার সঙ্গে যুক্তির সবসময় সংযোগ থাকবে, এমনটি আশা করিনা। তবে এমন যদি হতো ঐ গানের আগের দৃশ্যে নায়িকার হিল যুক্ত জুতোর শব্দে নায়ক বিমোহিত হয়েছেন, তাহলেও গানের কথা বিশ্বাসযোগ্য হতো। তাছাড়া একই গানে নায়িকা বলেন-‘ও পাগলা পোলা শোন, তুই পাবিনা এই মন/ করতে প্রপোজ, ম্যাসেজ করিস, যতই করিস ফোন’। জিজ্ঞাসু মন জানতে চায়, এনগেজমেন্টের পরের দৃশ্যে প্রপোজ করার প্রশ্ন আসছে কেন? স্যাভির সুর করা এ গানেও স্যাভির সুর করা ‘নিয়তি’ ছবির ‘ঢাকাই শাড়ি’ গানের কথার প্রভাব পাওয়া যায়। ‘ঢাকাই শাড়ি’ গানের কথা ‘বাংলাদেশের সব পোলাপান তোর প্রেমে মশগুল, ঢাকাই শাড়ি পড়ে তোকে লাগছে বিউটিফুল’। আর ‘হিল’ গানের কথা ‘তোকে নিয়ে ডেটিং যাবো বাইকে চড়ে, পোলাপান হবে জেলাস ঢাকা শহরে’। স্যাভির শুর করা ইমরানের গাওয়া ‘মন দিওয়ানা’ গানটি ইমরানের অন্য গানগুলোর মতই। গায়কীতে কোনো নতুনত্ব পাইনি। শফিক তুহিনের ‘চারপাশে এত আলো’ অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী হতে পারতো। গল্পে সে সুযোগ ছিল। তবে সব মিলিয়ে গানটি মন ছুঁয়ে যায়নি। অবশ্য তানজীল ও আরিফ রোহান এ ছবিতে নৃত্য পরিচালনা বেশ ভালো করেছেন।
ইমন সাহা বরাবরই আবহ সংগীতে তুষ্ট করলেও ‘ভালো থেকো’ চলচ্চিত্রে বেশ হতাশ করেছেন। তৌহিদ হোসেন চৌধুরী ও মোহাম্মদ কালামের সম্পাদনাও ছবির অন্যতম দুর্বল দিক। ছবির দৈর্ঘ্য আরো অন্তত ২০ মিনিট কমিয়ে আনা যেত। এম এইচ শপনের চিত্রগ্রহণ কিছু ক্ষেত্রে দৃষ্টিকটু লেগেছে। আপত্তিকর শটগুলো বেশি করে ধরবার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।
শিল্প নির্দেশনায় সাব্বির ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিএফডিসিতে নিম্নমানের কৃত্রিম সেট ছিল একই সাথে বাস্তবতা বিবর্জিত এবং শিল্পমানহীন। সবকিছুতে এত বেশি উজ্জল রং ব্যবহার করা হয়েছে, চোখে রীতিমত পীড়া দিয়েছে। তানহার ঘরে এমনভাবে রং করা হয়েছে যেন সেটি শিশুদের ঘর। তাছাড়া বাসর রাতে প্লাস্টিকের ফুল থেকে শুরু করে একটি বড় কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রোজের জ্বলজ্বলে সোনালী রঙের চেয়ার ছিল রীতিমত হাস্যকর। প্রোডাক্সন ডিজাইনে আমরা কবে আরো আধুনিক হবো? কবে প্রযোজকের অর্থ সঠিকভাবে পর্দায় ব্যবহার হতে দেখবো?-প্রেক্ষাগৃহে বসেই বার বার ভাবছিলাম।
জাকির হোসেন রাজু গুণী পরিচালক, কোনো সন্দেহ নেই। তবে ‘ভালো থেকো’ তার নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। প্রযোজক জাহিদ হোসেন অভি এবং পরিচালক জাকির হোসেন রাজু দর্শকদের একটি ভিন্ন স্বাদের মৌলিক, পারিবারিক গল্প উপহার দিতে চেয়েছেন। সেজন্য তাদের ধন্যবাদ। তবে গল্প বলায় দৈন্যতা, অবহেলায় সৃষ্ট সংলাপ, দুর্বল পরিচালনা-সব মিলিয়ে ‘ভালো থেকো’ ফুল হয়ে উঠতে পারেনি। মিষ্টি বকুল তো পরের কথা। আকাশের ঠিকানায় চিঠি না লিখে নির্মাতার উদ্দেশ্যে সরাসরিই বলতে চাই: আমরা কি ভবিষ্যতে আপনাদের কাছ থেকে আরো আধুনিক, আরো সংবেদনশীল, আরো বিনোদনমূলক ছবি পেতে পারিনা? ‘ভালো থেকো’র স্মৃতি ভুলে গিয়ে আমরা ভালো থাকতে চাই। দেশের মানসম্পন্ন ছবি দেখে আমরা ভালো থাকতে চাই। আমরা কি আপনাদের পরের ছবি দেখে ভালো থাকার সুযোগ পাবো?