Select Page

মতিন রহমানের ‘রাঙা ভাবী’ : যে গল্পের ছবি আজ হয় না

মতিন রহমানের ‘রাঙা ভাবী’ : যে গল্পের ছবি আজ হয় না

Print Advertisement of Ranga Bhabi bangla film with Shabana Alamgir tappu released in 1989 (2)১৯৮৯ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের তালিকা যদি খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন সেই বছরে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের দারুন একটি বছর ছিল। পুরস্কারের তালিকায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু মূলধারার বাণিজ্যিক বিনোদনধর্মী ছবির জয় জয়কার। সেই বাণিজ্যিক ছবির জোয়ারে আলমগীরশাবানা’ দুই অভিনেতা অভিনেত্রীর সত্য মিথ্যা, ক্ষতিপূরণ,  রাঙাভাবী, ব্যথার দান’র মতো একাধিক জনপ্রিয় ও দর্শকনন্দিত ছবির লড়াই। আজ সেই ১৯৮৯ সালের একটি দর্শক নন্দিত ছবির কথা সংক্ষেপে বলছি।

১৯৮৯ সালের পুরো বছরটা পরিবারের সাথে দারুন দারুন সব চলচ্চিত্র সিনেমা হলে দেখেছিলাম যার মধ্যে ‘’রাঙাভাবী’’ ছবিটা ছিল স্মরণীয় ছবিগুলোর একটি। সিলেটের নন্দিতা সিনেমা হলে সপরিবারে পাড়া প্রতিবেশি সহ কুরবানির ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত মতিন রহমানের ‘’রাঙাভাবী’’ ছবিটা দেখেছিলাম। বছরের শুরুর দিকে যেমন আলমগীর শাবানা’র সুপারহিট ‘সত্য মিথ্যা’ ছবিটিকে দেখে দর্শকরা কেঁদেছিলেন তেমনি ‘রাঙাভাবী’ ছবিটা দেখে আবারও কাঁদলেন আর দুটো ছবির মাঝে কোনটাকে এগিয়ে রাখবেন সেটা নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলা মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের গুণী নির্মাতা মতিন রহমান এর ‘রাঙাভাবী’ ছবিটি ছিল শাবানা’র প্রযোজনা সংস্থা ‘এসএস প্রোডাকশনস’ এর ছবি যার প্রযোজক ছিলেন শাবানার স্বামী ওয়াহিদ সাদিক।

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী কাহিনীকার ও গীতিকার প্রয়াত আহমেদ জামান চৌধুরীর লিখা গল্পটি ছিল এমন – শহরে ছাত্রবস্থায় থাকাকালিন আলমগীর তাঁর বাবার মৃত্যুর জন্য সৎ মা মিনু রহমানকে ভুল বুঝে তাড়িয়ে দেয়। কয়েক বছর পর আলমগির তাঁর বাবার ভিটেয় ফিরে এসে একটি চাকরি নেয়। মা-বাবাহীন শাবানা কোটিপতি মামা সিরাজুল ইসলামের কাছে বড় হয়। সিরাজুল ইসলাম শাবানার পছন্দে আলমগীরের সাথে বিয়ে দেয়। নিসন্তান আলমগীর শাবানা’র সংসারে একদিন হাজির হয় ১০/১২ বছরের এক কিশোর (তাপ্পু) যে আলমগীরের সৎ ভাই। আলমগীরের সৎ মা মারা যাওয়ার সময় তাপ্পুকে তাঁর সৎ ভাইয়ের কথা বলে যায় এবং বংশের শেষ চিহ্ন হিসেবে দুটি সোনার বালা দেয় যা তাঁর ভাবীকে পেলে যেন দেয় এই আদেশ করে যায়। তাপ্পুকে আলমগীর সহ্য করতে পারেনা অন্য দিকে শাবানা তাপ্পুকে নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করে আর তাপ্পুও ভাবীকে ‘মা’ বলে ডাকে। শাবানা তাপ্পুকে স্কুলে পাঠায় কিন্তু পথে বড় ভাই আলমগীর তাপ্পুকে পাথর ভাঙ্গার কাজে লাগায় যা বাড়ি এসে শাবানাকে গোপন করে তাপ্পু। এভাবে সবসময় তাপ্পু হয়ে থাকে আলমগীরের কাছে অবাঞ্ছিত একজন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী আলমগীর যে কোম্পানিতে চাকরি করে সেই কোমাপ্নির মালিকের (গোলাম মোস্তফা) মেয়ে নতুনের প্রেমে সাড়া দেয় এবং গোলাম মোস্তফা তাঁদের বিয়ে দেন। বিয়ের আসরে তাপ্পু ও শাবানা উপস্থিত হলে গোলাম মোস্তফা হৃদরোগে আক্রান্ত হোন। আলমগীর তাপ্পু ও শাবানাকে অস্বীকার করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। তাপ্পুর দেয়া সেই সোনার বালা দুটো আলমগীর শাবানার কাছ থেকে চুরি করে এনে নতুনকে দেয় যা তাপ্পু কিছুতেই মানতে পারে না। শুরু হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী আলমগীর সংসার সাজায় রাজ প্রাসাদসম বিশাল অট্টালিকায় এবং শাবানা ও তাপ্পু রয়ে যায় কুঁড়ে ঘরে । তাপ্পুকে আলমগীর তাঁর সম্পত্তির ভাগ দিয়ে আলাদা করে দেয়। তাপ্পু তাঁর ভাবী শাবানার কাছে প্রতিজ্ঞা করে আলমগীরকে নতুনের কাছ থেকে শাবানার কাছে ফিরিয়ে আনার এবং শাবানার সেই বালা দুটো (যা তাপ্পু দিয়েছিল) শাবানার হাতে আবার ফিরিয়ে দেয়ার। একদিন তাপ্পু দেয়াল টপকিয়ে রাতের আঁধারে নতুনের ঘরে বালা দুটো চুরি করতে যায় এবং বালা দুটো নিয়ে ফিরে আসার সময় নতুনকে গুলি করে হত্যা করে। অবশেষে তাপ্পু তাঁর সৎ ভাই আলমগীর ও ভাবী শাবানা’র জন্য জীবন দেয়ার মধ্যে দিয়ে ছবিটি সমাপ্ত হয়।

পুরো ছবিটা জুড়ে আলমগীর, শাবানা আর বোম্বের মাস্টার তাপ্পু নামের এক কিশোরের (শিশুশিল্পী) পাল্লা দিয়ে অনবদ্য অভিনয় করে দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখলেন পুরোটা সময়। মাস্টার তাপ্পু যাকে আমরা প্রথম দেখেছিলাম যৌথ প্রযোজনার বিগবাজেটের ছবি রাজেশ খান্না ও শাবানা’র সাথে ‘বিরোধ’ ছবিতে। সেই ‘বিরোধ’ ছবির দুর্দান্ত অভিনয় করা দর্শকদের কাছে পিচ্চি তাপ্পু যেন ‘’রাঙাভাবী’’ ছবির প্রান হয়ে গেলো। বোম্বের এই কিশোরটি ‘’বিরোধ’’ ছবিতে যেভাবে দর্শকদের কাঁদিয়েছিলেন এবার তারচেয়ে বেশী কাঁদিয়ে দর্শকদের মনে চিরদিনের জন্য ঠাই করে নিয়েছিল । আজো আমার সমবয়সী/সমসাময়িক সিনেমা হলে ছবি দেখা দর্শকদের যদি ‘রাঙাভাবী’ ছবির কথা জিজ্ঞেস করেন সবার আলমগীর শাবানা’র সাথে যে নামটি উচ্চারিত হবে তাঁর নাম তাপ্পু। শাবানা’র কথা বলতে গেলে এক কথায় বলতে হবে একজন অভিনেত্রী জীবনে কতগুলো অভিনয় সমৃদ্ধ ছবি দর্শকদের দিতে পারেন সেটা শাবানা’র ছবিগুলো না দেখলে পৃথিবীর কেউ বিশ্বাস করবে না। শাবানা’র অভিনয় সমৃদ্ধ সেরা ছবিগুলোর তালিকায় ‘’রাঙ্গাভাবী’’ ছবিটা চিরদিন থাকবে। শাবানার মতো অভিনয় সমৃদ্ধ এতগুলো ছবি বিশ্বের আর কোন অভিনেত্রীর কপালে জুটেনি ও জুটবেও না। পারিবারিক গল্পে আলমগীর অনন্য, অসাধারন।

আহমেদ জামান চৌধুরীগাজী মাজহারুল আনোয়ারের লিখা ও সুবল দাসের সুর করা ছবির গানগুলো যেন ক্লাসিক। ছবির প্রথম গান ‘’আমার যা কি কিছু সবই তো তোমারই জন্য ‘’ যেমন রোমান্টিক তেমনই ক্লাসিক যা শুনলে মনে হবে কোন আধুনিক ডুয়েট গান। ছবির টাইটেল গান বা থিম সং ‘‘রাঙা ভাবী মা/ বাঁধন খুলো না’’ গানটিও দারুন এবং তাপ্পুর ঠোঁটে রুনা লায়লার গাওয়া ‘’তোমাদের এই খুশির আসর গানে ভরে ভরেছে/আড়ালে এক অভাগীনির অশ্রু ঝরেছে ‘’ গানটি মাস্টারপিস একটি গান যে গানটি আজকের কোন তথাকথিত জনপ্রিয় কোন শিল্পী গাওয়ার চেষ্টা করলে নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলবে তবুও বিশুদ্ধ ভাবে গানটি গাইতে পারবে না। এমন কথা ও সুরের গান গত ১ যুগের নতুন কোন ধারার কোন ছবিতে পাওয়া যায়নি আর যাবেও না কোনদিন। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সঙ্গীতশিল্পী অন্বেষণ করে যারা তাঁদের কাউকে দেখলাম মেধাবী কোন প্রতিযোগীকে এমন একটি গান গাওয়ার জন্য একটা শক্ত পরীক্ষা নেয়ার। বিশেষ করে ‘’ক্ষুদে গানরাজ’’ অনুষ্ঠানে বাচ্চাদের কণ্ঠে বড়দের রোমান্টিক গান তুলে না দিয়ে রাঙ্গাভাবী ছবির শেষ গানটি তুলে দিলে আমাদের শিশুরা অন্তত নিজেকে আরও শাণিত করার সুযোগ পাবে।

Print Advertisement of Ranga Bhabi bangla film with Shabana Alamgir tappu released in 1989 (1)

আহমেদ জামান চৌধুরী পাকিস্তানের ইকবাল কাশ্মিরির একটি গল্প থেকে অনুপ্রানিত হয়ে ‘’রাঙ্গাভাবী’’ ছবিটির গল্প তৈরি করেন যার সাথে মতিন রহমানের চিত্রনাট্য ও পরিচালনা মিলে অসাধারন একটি পারিবারিক ছবি হয়ে দর্শকদের প্রশংসা কুঁড়ায় ‘’রাঙাভাবী ‘’ ছবিটি। পুরো ছবিটার শুটিং হয়েছিল নেপালে। নেপালের বিভিন্ন লোকেশনে ছবিটির চিত্রায়ন খুবই দারুন ছিল । এই ছবির জন্য শাবানা শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। পুরো ছবিতে তিনটি চরিত্র বারবার ঘুরেফিরে কিন্তু একটিবারও ছবিটির গল্প থেকে দর্শক বের হয়নি। একবারও দর্শকদের কাছে ছবিটি বিরক্ত তো লাগেনি বরং দর্শক একটি দৃশ্যর পর আরেকটি দৃশ্য কি ঘটে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করেছিল। এর মূল কারন আহমেদ জামান চৌধুরীর গল্প, মতিন রহমানের চিত্রনাট্য ও পরিচালনা এবং চরিত্রগুলোর সাথে মিশে যাওয়া অভিনেতা অভিনেত্রীদের দুর্দান্ত অভিনয় যা একই সূতায় গাঁথা ফুলের মালা হয়ে গিয়েছে আর দর্শকরা সেই মালার ঘ্রান মন ভরে উপভোগ করছে। তিনটি চরিত্রের সাথে গোলাম মোস্তফা, নতুন, সিরাজুল ইসলাম এমন ভাবে এসেছেন শুধু কাহিনীর প্রয়োজনে। পুরো ছবিটা আলমগীর, শাবানা ও তাপ্পু’র সম্পর্কের টানাপোড়ন, দ্বন্দ্ব সংঘাতের গল্প যা শেষ দৃশ্য পর্যন্ত দর্শক সিনেমা হলের সীটে বসে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। অথচ এর চেয়েও বেশী চরিত্র পেয়েও আজকের নতুনধারার পরিচালক’রা আড়াইঘণ্টা’ ব্যাপি একটি গল্পকে উপস্থাপন করতে পারে না যার কারন হলো ঐ তথাকথিত মেধাবীরা এখনও শিখে নাই বড় পর্দায় কিভাবে গল্প বলতে হয় বা কিভাবে গল্পকে প্রানবন্ত করতে হয়। বাণিজ্যিক ছবির জমজমাট যুগে এক চিমটি প্রেম, ৫ চিমটি অযাচিত গান, ৩ চিমটি অ্যাকশন, ২ চিমটি নাটকীয়তার গতানুগতিক ফর্মুলার নির্ভর বিনোদনধর্মী ছবির বাহিরে যে কত উপভোগ্য একটি ছবি হতে পারে ‘রাঙ্গাভাবী’ ছবিটা তার অন্যতম একটা উদাহরন। ‘রাঙ্গাভাবী’ ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য ও দর্শকদের প্রশংসায় অনেকে ভেবেছিলেন ‘’রাঙ্গাভাবি’’ ছবিটা একাধিক শাখায় জাতীয় পুরস্কার পেতে যাচ্ছে। অথচ দর্শকদের এতো দারুন একটি ছবি উপহার দিয়েও মতিন রহমান জাতীয় চলচ্চিত্র পেলেন না। কারন যে শাবানা ছাড়াও অন্য যে শাখাগুলোয় পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল সেগুলো পেয়ে যায় একই বছরের শুরুতে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মাস্টার মেকার’ এ জে মিন্টু’র ‘সত্য মিথ্যা’ ছবিটি আর আলমগীর পেয়েছিলেন মালেক আফসারির ‘’ক্ষতিপূরণ’’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার।তবে শিশুশিল্পী মাস্টার তাপ্পু যদি ভারতীয় না হতেন তাহলে হয়তো শাবানা’র পর তাপ্পু শিশুশিল্পীর শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটা পেয়ে যেতো। তবে জাতীয় চলচ্চিত্রে একাধিক শাখায় পুরস্কার না পেলেও সব শ্রেণীর লাখো দর্শকদের ভালোবাসার মতো বড় পুরস্কার মতিন রহমান ও তাঁর ‘’রাঙাভাবী’’ ছবিটা অর্জন করেছিল এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

আমাদের আজকের তথাকথিত মেধাবী তরুন চলচ্চিত্রকার যারা বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমাকে বারবার গতানুগতিক ফর্মুলার ছবি বলে নেতিবাচক প্রচারনা করে তাঁদের ‘’রাঙাভাবী’’ ছবিটা দেখা অবশ্যই প্রয়োজন। গতানুগতিক ফর্মুলার বাহিরে গিয়ে সব শ্রেণীর দর্শকদের জন্য মূলধারায় থেকে যে ভালো ছবি নির্মাণ করা যায় সেটার অসংখ্য অসংখ্য উদাহরনের মধ্যে ‘রাঙাভাবী’ ছবিটা অন্যতম । প্রেম , ভালোবাসা ও দ্বন্দ্ব সংঘাতের মানবিক সম্পর্কের এমন গল্পের বাণিজ্যিক ছবি দেখার মতো যেমন সব শ্রেণীর দর্শক আজ নেই তেমনি এমন একটি উপভোগ্য ছবি নির্মাণ করার মতো পরিচালকও আজ নেই।

১৯৮৯ সালের চিত্রালি পত্রিকায় প্রকাশিত ‘রাঙাভাবী’ ছবির বিজ্ঞাপনটি সংগ্রহ করে দিয়ে আমার সোনালি দিনগুলোকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ফাহাদ বিন শামস ভাইয়ের অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা।।

ফজলে এলাহী (কবি ও কাব্য)
২৬/০৮/১৫


মন্তব্য করুন