Select Page

মাটি ও ফুলের ভালোবাসা

মাটি ও ফুলের ভালোবাসা

মাটির ফুল; পরিচালক – মতিন রহমান; শ্রেষ্ঠাংশে – রিয়াজ, শাবনূর, শর্মিলী আহমেদ, আরিফুল হক, আহমেদ শরীফ, জাম্বু, ডন প্রমুখ; উল্লেখযোগ্য গান – সোনা দানা দামি গহনা, এই মাটি, ভালোবাসা সর্বনাশা, তুমি বলো না; মুক্তি – ২৩ আগস্ট ২০০২

‘বাগানে ফুল ফোটে গোলাপ, রজনীগন্ধা। মনের বাগানে যে ফুল ফোটে সে ফুল মাটির ফুল।’

ছবি শুরুর আগে শাবনূর এ সংলাপটি বলে। মনের বাগানের ফুল মাটির ফুল কথাটা গভীর। মাটি ও ফুল তখন দুটি সত্তা হয়ে যায়। গল্পটা তাদের এক হবার, ভালোবাসার গল্প।

ছবির নাম তখনকার দিনে অনেকটাই ব্যতিক্রমী ছিল। ছবির নাম শুনে ছেলেপেলে প্রথমে মজাই করেছিল। এ আবার কেমন নাম! কিন্তু ছবি দেখতে গিয়ে ভুলটা ভাঙে। ছবি দেখার পর মনে হত এ ছবির নাম ‘মাটির ফুল’ না রাখলে হতই না। ‘মাটি’ একটা মানুষের নাম যার জীবনে ফুল নামের একটি মেয়ে আসে। তাদের ভালোবাসার গল্পে হাসি, কান্না, মিলন সবই ছিল। মাটির মানুষ আমরা, মাটিতেই মিশে যাব। সে যুক্তিতে ভাবলে মাটি নাম মানুষের হওয়াটা খুব স্বাভাবিক।

ছবির গল্পে যা আছে বাণিজ্যিক ছবির জন্য সেটা দুর্দান্ত। সিনেমার মধ্যে সিনেমাকেন্দ্রিক ঘটনা দেখতে ভালোই লাগে। রিয়াজের বয়ানেই চলে ছবির starting sequence-‘ঢাকা শহরের দুটি অভিজাত সিনেমাহল অভিসার সিনেমাহল, রাজমনি সিনেমাহল। তার পাশাপাশি আর একটি সোমা সিনেমাহল। এ সিনেমাহলকে ঘিরেই গল্পের শুরু।’ সোমা সিনেমাহলে ছবি চালানোর জন্য পরিচালক মতিন রহমান-কেই দেখা হলো প্রিন্ট আনার জন্য গেছেন। বেশ উপভোগ্য ছিল। প্রিন্ট হলে ঢোকানোর আগেই মাস্তানের আগমন। মাস্তান প্রিন্ট ছিনিয়ে নেয় তাদের হলে চলবে বলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রিয়াজ মাটি হাজির। এই মাটিই রিয়াজ। তার মাস্তানি দিয়েই ছবির সূচনা।

রিয়াজকে নিয়ে যাদের ফাঁকা আওয়াজ চলে যে সে অ্যাকশন পারে না তাদের জন্য ‘মাটির ফুল’ রোমান্টিক ড্রামাতেও অ্যাকশনের স্বাদ দেবে। অ্যাকশন এ ছবির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল। রিয়াজের ক্লোজ শটে নেয়া অনেকগুলো শটের এক্সপ্রেশন খেয়াল করলে দেখা যায় অসাধারণ অ্যাকশনেবল ছিল তার অভিনয়।

বাণিজ্যিক ছবিতে রোমান্টিক গল্প যেভাবে নায়ক-নায়িকার ধাক্কা খাওয়াতে শুরু হত বেশিরভাগ এ ছবিতে তার কিছুই ঘটেনি। শাবনূরের সাথে রিয়াজের বিরোধ দিয়ে শুরু আর সেটা শুরু হয় রিয়াজের ‘ছেমরি’ শব্দ ব্যবহারে। ছবির একটা রিল ফাইটিং-এর সময় শাবনূরের গাড়ির উপরে পড়ে। রিয়াজ শাবনূরকে বলে-‘ঐ ছেমরি, তোর গাড়ির উপর থাইকা ছবির রিলটা দিয়া যা।’ শাবনূর তখন বেঁকে বসে। ঘটনা অনেকদূর গড়ায়। রিয়াজ শাবনূরকে আহত করে তার বাড়ি থেকে রিলটা নিয়ে আসে। রিয়াজকে পরে সারেন্ডার করতে হয় শাবনূরের বাবা আরিফুল হক ও ভাই ডন পুলিশের লোক বলে। বিরোধ তখন পর্যন্ত ছিল।

ছবির রোমান্টিক যাত্রার আগেই রোমান্টিক ড্রামা দিয়ে শুরু। পরিচালক পরের পার্টটাকে আগে রেখেছেন। পরে আবারো এনেছেন। শাবনূরকে কিডন্যাপের পরে রিয়াজ সম্পর্কে শাবনূরের ধারণা পাল্টায়। পরে ভালোবাসতে গিয়ে আরো একবার ভুল ধারণা হয় কারণ রিয়াজ ভালোবাসতে চায় না। সিনেমাহলের ভেতরে চলে আর এক ড্রামা। তাদের কথোপকথন অসাধারণ-

রিয়াজ – তুই? সাথে পুলিশ আনছোস?

শাবনূর – না আমি এসেছি তোমাকে দেখতে।

রিয়াজ – ক্যান আমি কি সার্কাসের বান্দর নাকি?

শাবনূর – আচ্ছা সুন্দর করে কথা বলতে পারো না তুমি?

রিয়াজ – সুন্দর করে কথা বললে কি হইব?

শাবনূর – দশটা লোক তো ভালো বলবে।

কথা বাড়তে থাকলে রিয়াজ ক্ষেপে যায়। শাবনূরকে বের করে দেয়। শাবনূর কেঁদে চলে যেতে যেতে বলে-‘তুমি বুঝলে না আমার মন আজ তোমাকে কি বলতে এসেছিল। আমাকে শুধু কাঁদালে আর কাঁদালে।’

রোমান্টিক পার্টটা শুরু হয় রিয়াজ ভুল বুঝে যখন শাবনূরের জন্য ফুল নিয়ে যায়। বলে-‘ঐ যে সেদিন সিনেমাহলে, আপনাকে বেশ কিছু কথা বলে ফেলেছি। উচিত হয়নি।’ ‘উচিত হয়নি’ কথাটাই শাবনূরের জন্য যথেষ্ট ছিল তাই ঘুরে তাকাতেই শাবনূরের এক্সপ্রেশনে যে প্রশান্তি ছিল সেটা ছিল ভালোবাসার প্রথম দৃষ্টি।

রিয়াজ-আহমেদ শরীফ ছবির ড্রামা বাড়ানোর কারিগর ছিল। দুজনের দুইরকম কষ্টের গল্প। রিয়াজের নিজের একটা গল্প থাকে ছোট থেকে বড় হবার। পিঠে ছ্যাঁক খেতে হয়েছিল যার দাগ রয়ে গেছে। পদে পদে ঠোকর খেয়ে কঠিন হয়ে গেছে তার হৃদয়। রিয়াজের গল্পটা শোনার পাশাপাশি আহমেদ শরীফও বলে তার কষ্টের গল্প। শাবনূর যে তারই মেয়ে জানত না প্রথমে, একটা সময় আরিফুল হকের কাছে জানতে পারে। রিয়াজকে কাজে লাগানো আহমেদ শরীফ তখন রিয়াজেরই শত্রু হয়ে যায়। তাকে সরিয়ে দিতে চাইলে রিয়াজ সতর্ক করে-‘দাউদ, মুখে লাগাম দিয়ে কথা বল।’ আহমেদ শরীফের সাথে রিয়াজের শত্রুতাকে কাজে লাগায় জাম্বু। নিজের দলে নিতে চায়। টাকার লোভ দেখালে রিয়াজ বলে-‘লোভ দেখাইবা না। কুত্তা চেনো কুত্তা? ওদের মতো খাবার পাইলেই আমার চইলা যায়।’

ডায়লগ বেসিস ড্রামা ও অ্যাকশন ছবির পুরোটা জুড়েই ছিল। আবার টাচি বিষয়ও ছিল। শুধু রোমান্টিক দিয়েই ছবি শেষ করতে হবে তা নয়। বৈচিত্র্য ছিল গল্পে। কয়েকটা সিকোয়েন্স এ সূত্রে বলা যায়-

১. শাবনূর একটা জায়গায় বান্ধবীদের সাথে বসে থাকে। একজন মহিলা মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য চায় নয়তো বিয়ে হবে না। শাবনূর নিজের হাতের বালা খুলে দেয়। মহিলা অবাক হলে শাবনূর বলে-‘মনে করো এক বোন তার আর  বোনকে উপহার দিচ্ছে।’

২. সেই বিয়েবাড়িতে শাবনূর গেলে মাস্তান ধাওয়া করে রিয়াজ সব তছনছ করে দেয়। বিয়ের বেনারসি শাড়ি, মালা এসব মাটিতে লুটিয়ে যায়। অতিথিরা চলে গেলে শাবনূর রিয়াজকে কটাক্ষ করে। বলে-‘কারো স্বপ্ন গড়ে দিতে না পারো নষ্ট করার অধিকার তোমার নেই।’

৩. রিয়াজ সেই মেয়ের প্রেমিককে বাড়ি থেকে তুলে আনে বিয়ে দেবার জন্য। এজন্য হাতে কোপ খায়। শাবনূর নিঃশব্দে রিয়াজের মহত্ত্ব দেখে।

৪. রিয়াজ শাবনূরের কলেজের সামনে দাঁড়ায়। তার হাতের পরশ নেয়। সবাই তাকিয়ে দেখতে থাকে। চলে যাবার সময় শাবনূর হাতটা ধরতেই কষ্ট পায় কারণ কোপ খেয়েছিল। সেটা জানার পর শাবনূরও রিয়াজের পকেটে থাকা ছুরি দিয়ে নিজের হাত কাটে। রিয়াজ বলে-‘এ আপনি কি করলেন?’ শাবনূরের জবাব-‘আপনাকে কষ্ট দিয়েছি।’ সিকোয়েন্সটিতে স্পেশালিটি হচ্ছে রিয়াজ-শাবনূর দুজনকে ‘আপনি’ ডাকে অথচ দুজন দুজনকে ভালোবাসে। দূরত্ব ছিল কিন্তু ভালোবাসাও ছিল।

৫. বাবা সম্পর্কে রিয়াজের মনে শুধু ঘৃণা ছিল। হলমালিক কথাপ্রসঙ্গে নিজেকে রিয়াজের বাবার মতো বললে রিয়াজ ক্ষেপে যায়। দুনিয়ার সব বাবার মুখে সে থু থু ছিটাতে চায়। হলমালিকের শার্ট চিরে বলে-‘তোর বুকটা আমি চিরে দেখতে চাই। আমারে দেখতে দে।’ আহমেদ শরীফকে লক্ষ করে বলে-‘বাবা দেখতে কি এইরকম?’ অভিনয় তখন লাজবাব।

‘আমি কিন্তু আবার নষ্ট হয়ে যাব ফুল। ভালোবেসে এই মাটির পোড়া বুকে কেউ ফুল ফোটায়নি।’ সংলাপটি দুর্দান্ত। রিয়াজের অসাধারণ এ সংলাপেও শাবনূর কথা শোনেনি যখন একটা চরম সত্য সে জানতে পারে। বিচ্ছেদ ঘটলেও তা ছিল সাময়িক। ছবি ফিনিশিং-এর দিকে এগোতে থাকলে রিয়াজের প্রতি শাবনূরের ভালোবাসা কমেনি, বেড়েছে।

ছবির গানের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় ছিল ‘সোনা দানা দামি গহনা।’ আলম আরা মিনু এ একটা গানেই সুপারহিট হয়ে যায়। গানে কাব্যিক সৌন্দর্য আছে। উপমার ব্যবহারে দুটি লাইন অসাধারণ-

১. ‘তুমি গাছের পাতা ছিঁড়ে কোরো আমার গহনা।’

২. ‘আমি ধুলো দিয়ে বাঁধি বাসা কিছুই লাগে না।’

‘এই মাটি’ গানটিতে রিয়াজের সুপার অভিনয়, শাবনূরের কান্নাজড়িত ভয় ভয় অভিনয় আর বিপ্লবের বলিষ্ঠ গায়কী অসাধারণ। ‘ভালোবাসা সর্বনাশা’ গানটি সিনেমাহলে ক্রাউড তৈরি করেছিল। গানটির নির্মাণ আলাদা। মদ মুখে নিয়ে রিয়াজ বারের মধ্যে অন্যদের ভিড়ে শাবনূরকে দেখে। গানে গানে রিয়াজ প্রেমকে অস্বীকার করে আর শাবনূর প্রেমকে তুলে ধরে মহৎভাবে। গানের এ লাইন দুটি দারুণ-

‘শোনো শোনো ও দিলদিবানা

কাউকে যে মন দিও না।’

এছাড়া ‘তুমি বলো না’ গানটাও রোমান্টিক।

‘মাটির ফুল’ ছবি সুন্দরভাবে গল্প বলে যাওয়া ছবি যে ছবিতে কোনো অতিরন্জন নেই। গল্প চলতে থাকে আর ছবির রোমান্স, ড্রামা, অ্যাকশন, স্যাডনেস, ফিনিশিং সব ধারাবাহিকভাবে সৌন্দর্য তৈরি করে। ফুল প্যাকেজ অভিনয়সমৃদ্ধ ছবি। মাটি ও ফুলের গল্পে জমজমাট এ ছবি যা দেখতে গেলে কোনো ক্লান্তি আসে না।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন