মিসির আলির সাথে অন্য ভুবনে
সময়টা আশির দশক। হুমায়ূন আহমেদ তখন সপরিবারে বাস করছেন অ্যামেরিকায়। গাড়ি করে যাচ্ছিলেন ফার্গো থেকে মন্টানাতে, ড্রাইভিং সিটে গুলতেকিন আহমেদ। রেডিওতে একটা গানের লাইন শুনে হুমায়ূন চমকে গেলেন : “close your eyes and try to see”। তার নিশ্চিত বিশ্বাস, মিসির আলি চরিত্রটির ধারণা সেদিনই তিনি পেয়ে যান। যদিও এর অনেক পরে, ১৯৮৫ সালে দেবী প্রকাশিত হয়। দেবী সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম মৌলিক উপন্যাস, যেটা পেপারব্যাকে ছাপা হয়েছিল।
দেবী শুধুমাত্র মিসির আলি কিংবা হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিসেবেই নয়, বাংলা সাহিত্যের বিচারে এক অনন্য সৃষ্টি। সেই উপন্যাস থেকে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। সব ঠিক থাকলে, দেবী মুক্তি পেতে আর হপ্তাখানেকও বাকি নেই। তার আগে মিসির আলিকে নিয়ে আমার এলোমেলো কিছু কথামালা (দেবী ও নিশীথিনী পড়া না থাকলে, কড়া করে একটা স্পয়লার অ্যালার্ট)।
হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, “মিসির আলি এমন একজন মানুষ, যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। যে পৃথিবীতে চোখ খুলেই কেউ দেখে না, সেখানে চোখ বন্ধ করে দেখার এক আশ্চর্য ফলবতী চেষ্টা”। ধারণা করা হয়, মিসির আলি’র নামকরণ করা হয়েছে তৎকালীন সময়ের প্রখ্যাত সাংবাদিক আজিজ মিসিরের নামানুসারে। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রির শিক্ষক মিসির আলিকে হুমায়ূন একটু অন্যভাবে লেখায় তুলে ধরেছেন। খেয়াল করলে দেখবেন, প্রথম দিককার বেশিরভাগ গল্পে মিসির আলি মুখ্য চরিত্র নন। এমনকি গল্পের পট পরিবর্তনেও তার কোন ভূমিকা নেই। মিসির আলি স্রেফ তথ্য সংগ্রহ করছেন, দারুণ সব পর্যবেক্ষণ করছেন, বিশ্লেষণ করছেন; কিন্তু চরিত্রগুলোর অন্তিম পরিণতি পাল্টাতে পারছেন না। সুপার ন্যাচারাল ধাঁচের এসব গল্পে মিসির আলি যেন একজন মিডিয়াম, যার মারফত চরিত্রগুলোর কথা আমরা জানতে পারি।
পরবর্তীতে অবশ্য অতি-প্রাকৃতিক গল্পের বদলে ক্রাইম-মিস্ট্রিতেই মিসির আলিকে বেশি দেখা যায়। ক্রাইম স্টোরির ন্যারেটিভ প্রধানত দুই প্রকার। প্রথম ধরণটি হলো, যেখানে দর্শক শেষ মুহূর্তে জানবে অপরাধীর পরিচয় (whodunit)। আরেক প্রকার হলো, যেখানে দর্শক প্রথম থেকেই জানবে কে মূল অপরাধী। গোয়েন্দাপ্রবর কিভাবে সুতো গুটিয়ে অপরাধী পর্যন্ত পৌঁছে গেলো, সেটাই হলো এমন গল্পের আকর্ষণ (howcatchem)। হুমায়ূন আহমেদ অ্যামেরিকায় থাকাকালীন সময়ে এই দ্বিতীয় ধরণের এক টিভি সিরিজের ভক্ত হয়ে পড়েন। কলম্বো নামের সেই টিভি সিরিজটির প্রথম পর্ব (Murder by the Book) নির্মাণ করেছিলেন স্টিভেন স্পিলবার্গ, যেটাকে বর্তমানে টিভি ইতিহাসের অন্যতম সেরা এপিসোড হিসেবে গণ্য করা হয়। এক সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম, সত্যজিৎ রায় নিজেও দ্বিতীয় ধারার ন্যারেটিভ পছন্দ করতেন। দেখবেন, তার নির্মিত সোনার কেল্লার শুরুতেই কিন্তু অপরাধীর পরিচয় প্রকাশ করা হয়।
এই লেখাগুলো হুমায়ূন আহমেদ তার এলিফ্যান্ট পার্ক নামের বাসায় বসে লিখেছিলেন। আমি হুমায়ূন আহমেদের এমনই ভক্ত ছিলাম যে, “বাসা ভাড়া করবো” অজুহাত দেখিয়ে একবার সেই বিল্ডিংটায় ঢুকে পড়েছিলাম (ততদিনে হুমায়ূন ধানমণ্ডির দখিন হাওয়ায় উঠে পড়েছেন)। উদ্দেশ্য আর কিছু না, যেখানটায় বসে হুমায়ূন হিমু-মিসির আলি কিংবা কোথাও কেউ নেই লিখেছেন, সেই জায়গাটা একবার স্পর্শ করে আসলাম। বাটা সিগন্যাল থেকে একটু সামনে এগোলে এখনো সেই বিল্ডিংটার দেখা মিলবে।
পর্দায় মিসির আলি’র প্রথম আত্মপ্রকাশ ১৯৮৭ সালে। সেখানে আবুল হায়াত মিসির আলি’র চরিত্র করেছেন। শুনেছি আবুল খায়ের সাহেবও করেছেন, যদিও তার নাটকটি দেখিনি। আবুল হায়াতেরটা দেখেছি এবং আমার ভালোই লেগেছে। অবশ্য হুমায়ূন আহমেদের টেকো মিসির আলিকে একদম পছন্দ হয়নি। এছাড়া অনিমেষ আইচ ভিন্ন ভিন্ন মানুষকে দিয়ে মিসির আলির চরিত্রে অভিনয় করিয়েছেন (যার মাঝে হুমায়ূন ফরিদীও আছেন)। হুমায়ূন আহমেদ তাই অনিমেষের নাম দিয়েছিলেন, “মিসির আলি সন্ধানেষু”।
মঞ্চেও দেবী নিয়ে নাটক হয়েছে। বিশালবপু, সাসপেন্ডার প্যান্ট (gallace pant) পড়া চকচকে মিসির আলিকে আমার একদমই ভালো লাগেনি। নাটকটাও তেমন একটা জমেনি। জানি না দেবী সিনেমাটি কেমন হবে। চঞ্চল চৌধুরী অভিনেতা হিসেবে দুর্দান্ত, কিন্তু পরিচালক অনম বিশ্বাস সম্পর্কে আমার ধারণা অত্যন্ত সীমিত। অনম আয়নাবাজির চিত্রনাট্য করেছেন (আর বছর পনেরো আগে, চ্যানেল আইতে তন্দ্রা নামের এক মেয়ের সাথে তাকে প্রতিদিন গানের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে দেখেছি)। এটা বাদে তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। অবশ্য দর্শক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশার পারদটাও সামলে রাখা দরকার। দেবী কিন্তু পেডোফিলিয়া, রিপ্রেসড চাইল্ডহুড ট্রমা, সেক্সুয়াল প্রেডেটর ও অ্যাস্ট্রাল প্রোজেকশনের মতো বিষয় তুলে এনেছে; যা আমরা সচরাচর পর্দায় দেখে অভ্যস্ত নই। তাই দেবী যতটা না মিসির আলি কেন্দ্রীক থ্রিলার, তার চে অনেক বেশি রানুর অন্তরমহলের কথকতা।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, এটাই কিন্তু মিসির আলির কোন গল্পের প্রথম চলচ্চিত্রায়ন নয়। ওপার বাংলার শেখর দাস পরিচালিত “ইএসপি-একটি রহস্য গল্প” সিনেমাটির কাহিনী দেবী উপন্যাসের সাথে মিলে যায়। তবে আমি সেটার কথা বলছি না। খোদ বাংলাদেশের এক সিনেমাতে মিসির আলি সিরিজের একটা সাবপ্লট ব্যবহৃত হয়েছে। নিশীথিনী-তে মিসির আলি’র হানিফা নামে এক কাজের মেয়ে ছিলো। একদিন জ্বরের ঘোরে মেয়েটা বলে বসে, “মামি, ইট হার্টস!” সেখান থেকে মিসির আলি তদন্ত শুরু করেন। পরিশেষে জানা যায়, মেয়েটা হুলুস্থুল পর্যায়ের এক ধনী লোকের মেয়ে। দবির সাহেবের সংসার সিনেমায় মাহিয়া মাহি একজন গৃহকর্মীর চরিত্রে অভিনয় করেন। ক্লাইম্যাক্সে এসে দেখা গেলো, মাহির হার্টে সমস্যা রয়েছে এবং হাসপাতালে অর্ধচেতন অবস্থায় সে বলে ওঠে, “ড্যাডি, ইট হার্টস”। সেখান থেকে আবিষ্কার হয়, মাহি আসলে বাড়ির মালিক আলীরাজের মেয়ে। দর্শকরাও “ইট হার্টস” বলে উঠেছিলো সেদিন।
জয়া আহ্সান মানুষটার চিন্তাধারা খুব অন্য রকম। গতানুগতিক গল্প “বিসর্জন” দিয়ে তিনি দেবীকে বেছে নিয়েছেন। দর্শক-খরার এই অসময়ে প্রযোজনা করছেন সাইকোলজিক্যাল হরর। সাহস আছে এই মেয়ের! আর দেবী’র টি-ব্যাগ কাণ্ডের পর; বাংলাদেশের কতজন মানুষ এই ঘরানার চলচ্চিত্র উপভোগ করার মতো মানসিক পরিপক্বতা রাখে, সেটাও ভাবনার বিষয়। তারপরও মনে-প্রাণে চাইবো ছবিটি সফল হোক। দেবী উপন্যাসের শেষে নীলুর চেহারা অবিকল রানুর মতো হয়ে যায়। এই সিনেমা দর্শকপ্রিয় হলে, সিক্যুয়েলেও আশা করি জয়াকে পাবো। দেবী’র আবির্ভাবে বাংলা চলচ্চিত্রের দুর্গতি বিনাশ হোক, সে প্রত্যাশাই থাকলো।
: মুখ ও মুখোশ ডটকমে লেখাটি পূর্ব প্রকাশিত।