Select Page

শাবানার আত্মকথন ‘আমার কিছু কথা’

শাবানার আত্মকথন ‘আমার কিছু কথা’

১৯৯৩ সালের ঈদসংখ্যা বিচিত্রায় শাবানার আত্মকথনধর্মী ‘আমার কিছু কথা’ লেখাটি প্রকাশ হয়। অনুলিখনে ছিলেন মারুফ তুষার।

পুরনো ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা গেন্ডারিয়া। মেইন রাস্তা থেকে একটু ভিতরে গিয়ে বিশাল গেন্ডারিয়া পুকুর। পুকুরের পাড়ে একটি ছোট ঘরে আমরা থাকতাম। বাবা ফয়েজ চৌধুরী ছিলেন হাইকোর্টে টাইপিস্ট। সারাদিন ধরে পরিশ্রম করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন। মা ফাজিলেতুন্নেসা ঘরেই থাকতেন সারাদিন। রিজভী, শাহীন ও আমরা দু’বোন মিলে আমাদের সংসার। বাবার আয় খুব বেশি না থাকায় সংসারে সব সময় একটা টানাপোড়েন লেগে থাকতো। খুব স্বাচ্ছন্দে বড় না হলেও অসুখী ছিলাম না। সবাইকে নিয়ে আনন্দেই ছিলাম। বাবা-মায়ের ঘরে আমি আসি ১৯৫২ সালের ১৫ জুন। বাসার ওদিকটা খুব ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। খেলাধূলার জন্য খোলামেলা জায়গার অভাব ছিল। তাই বোনদের সঙ্গে সারাক্ষণ দুষ্টুমী করে কাটতো। ভর্তি হয়েছিলাম গেন্ডারিয়া গার্লস স্কুলে। পড়াশোনাতে মন বসতো না একদমই। সব সময় চেষ্টা করতাম ফাঁকি দেয়ার। মাঝে মাঝে বাবা খুব বকা দিতেন। তারপর আবার তিনিই আদর করে টেনে নিতেন কোলে। শৈশবে বাবা-মায়ের সঙ্গে কিছুদিন চট্টগ্রামেও কাটিয়েছি। তবে সে সময়কার স্মৃতি খুব বেশি মনে নেই।

স্কুলটা ছিল বাড়ির কাছাকাছি, হেঁটে হেঁটে যেতাম। স্কুল সম্পর্কে স্মৃতিগুলো এখন আর তেমন মনে নেই। মা মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়লে স্কুল ফাঁকি দিতে সুবিধা হতো। স্কুল সম্পর্কে একটা করুণ স্মৃতি এখনো মনে আছে। আমার এক বান্ধবী জিন্নাত আরা বেগম। ও হেঁটে স্কুলে আসছিল। এমন সময় তার পাশের এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দেয়া বোমা গিয়ে লাগে জিনাতের পারে। সঙ্গে সঙ্গে তার পা দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সেই শরীর থেকে। আমরা সবাই ছুটে যাই দেখতে। সেই বীভৎস দৃশ্য আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না।

মানুষের মন যদি সব স্মৃতি মনে রাখতে পারতো তবে তাকে পাগল হয়ে যেতে হতো। আমরা ভুলে থাকতে চাই আমাদের কষ্টের স্মৃতিগুলো। তারপরও প্রায়ই এসে হানা দেয় সেই সব পুরনো দিনের কথা। বাড়ির পাশেই ছিল পুকুর। ওখানে সাঁতার কাটা ছিল আমার একটা প্রিয় শখ। সে সময় আমার ডাক নাম ছিল রত্না, ভালো নাম আফরোজা। এ দুটো নামের কোনটাই শেষ পর্যন্ত থাকেনি। এখন আমি শাবানা। তবে সেই রত্নাকেও তুলে থাকতে চাই না। রত্না প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পায়নি বটে তবে রত্না শিখেছিল জীবন থেকে। আর এ জন্যই রত্নার শিক্ষা আজকের শাবানার ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। আমার নিজের কাছেই অবাক লাগে মায়ের আঁচলে মুখমোছা রত্না কীভাবে আজকের শাবানায় রূপান্তরিত হলো।

আমি যখন ছবিতে আসি ছবির জগৎটাই অন্যরকম ছিল। মাত্র নয় বছর বয়সে আমি প্রথম পর্দায় আসি। ছবিটা ছিল ‘নতুন সুর’। তখন সময়টা ১৯৬২ সাল হবে। একটা শিশু চরিত্রে অভিনয় করি। কেমন করেছিলাম মনে নেই। তবে আগে থেকে কোন কিছু জানাশোনা ছিল না। হঠাৎ করে সুযোগ পেয়ে যাই। আমার বাবা কোর্টে চাকরি করলেও বরাবরই তার মধ্যে একটা শিল্পীসুলভ মন কাজ করতো। এজন্যই মুসলমান মেয়েদের জন্য নিষিদ্ধ হলেও বাবা আমাকে অভিনয় করতে নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তো তিনি নিজেও পরিচালক হন।

শৈশবের কৌতূহলই আমার জন্য বিপদজ্জনক হয়ে ওঠে। অভিনয় তখন আমার কাছে নেশায় পরিণত হতে চলেছে। ভালো লাগতো। কেন লাগতো বলতে পারবো না। আমি অভিনয় সম্পর্কে কোন শিক্ষা কারো কাছ থেকে পাইনি। আমার সব শিক্ষা আমার চারপাশের জগৎ থেকে আর বিভিন্ন পরিচালকদের কাছ থেকে পেয়েছি। ‘নতুন সুর’ মুক্তি পাওয়ার পর আমি ‘তালাশে’ কাজ করি। এটা সম্ভবত ১৯৬৩ হবে। তালাশে একটা ‘গ্রুপ ড্যান্সে’ অংশ নিয়েছিলেন। ওসময় আমার নাম রত্নাই ছিল।

এরপর এসময় আরো কয়েকটি ছবিতে কাজ করি। এ চরিত্রগুলোও অনুল্লেখযোগ্য। ফিল্মের ভাষায় ‘এক্সটা’। এর জন্য অবশ্য আমার এখন খারাপ লাগে না। বরং গৌরব বোধ করি যে একদম ছোট থেকে নিজের ক্ষমতা বলে আজ আমি এই অবস্থানে এসেছি।

১৯৬৩-৬৫ সময়ে আমি ক্রমশঃ ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তোলার চেষ্টা করছিলাম। তখন বনবাসে রূপবান, ডাকবাবু ও ভাইয়া ছবিতে ‘সহ-নায়িকা’র সুযোগ পাই। সে সময়ের প্রেক্ষিতে তখন এটা ছিল আমার জন্য বিরাট সুযোগ। আসলে তখন ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনয়টা এখনকার মত এত ব্যবসায়িক হয়নি। কাজ করলে শিল্পীমূল্যটা পাওয়া যেত। এখন হয়তো শিল্পীরা তখনের চেয়ে অনেক বেশি টাকা পান কিন্তু সেই আন্তরিকতা আর সম্মান পাওয়া খুব কঠিন।

পরিচালক এহতেশামের সঙ্গে শাবানা

আমার প্রথম পরিচালক এহতেশাম হলেও ইবনে মিজান আমাকে নায়িকা হিসেবে কাস্ট করেন। তার ছবি ‘জংলী মেয়ে’তে। ইবনে মিজানের সঙ্গে পরিচয় হয় ‌‘আবার বনবাসে রূপবান’ ছবিতে কাজ করার সময়। ঐ সময় তিনি আমার কাজ দেখে সন্তুষ্ট হন, এবং আশ্বাস দেন তার পরের কোন এক ছবিতে নায়িকা করবেন। তবে এই ডাক যে এত তাড়াতাড়ি পাব ভাবতে পারিনি। সে সময় দাপুটে পরিচালক ছিলেন এহতেশাম, মোস্তাফিজ। এদের ছবিতে কাজ করা সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল। ‘জংলী মেয়ে’তে কাজ করার সময় একদিন ডাক পাই এহতেশামের ‘চকোরী’তে। তরুণী রত্নার কাছে এটা ছিল চাঁদ হাতে পাওয়া। আর এই ছবি থেকেই আমার নতুন সময়ের শুরু হয়। এহতেশাম আমার রত্না নাম পাল্টে নতুন নাম দেন শাবানা। আমি এখন শাবানা হলেও সেই রত্নাকেও ভুলিনি।

আসলে ‘চকোরী’ ছিল আমার নতুন জীবনের প্রথম মাইলস্টোন। ছবিটি আশাতীত ব্যবসা করে। আগের সময়টা কষ্টকর হলেও মনে হয় না তাতে আমার কোন ক্ষতি হয়েছে। আমি জীবনকে তখন যত কাছে থেকে দেখেছি, এখন আর অতটা সম্ভব হয় না। ঐ সময়টা আমার আজকের অবস্থানের ভিত্তিভূমি। ‘চকোরী’ হিট হয় সত্য তবে তার মানে এই নয় যে তখন আমার হাতে গন্ডার পর গন্ডা ছবি আসতে থাকে। পরিচিতি বেড়েছিল। জনপ্রিয়তাও।

তবে বিশেষ করে যে ঘটনাটি ঘটে তা হলো আশপাশের পরিচিতরা তখন আমার দিকে নতুন দৃষ্টিতে তাকানো শুরু করে। সবার মধ্যে একটা আগ্রহ জন্ম দিতে পেরেছিলাম। আশাতীত প্রচারও জুটে যায়। তারকা কথাটা আমাদের এখানে যেভাবে ব্যবহৃত হয়, তার শিকার আমিও। তারপরও আমার মনে হয় শুধু জনপ্রিয় হলেই একজন তারকা হয়ে যায় না। এখনকার ‘তারকা’ ধারণার সঙ্গে অভিনয়ের যোগ খুব কমই। আর এজন্য তারকার শ্রেণী বিভাগ করা বিভিন্নভাবে— বাণিজ্যিক তারকা, আর্টফিল্ম তারকা, ড্যান্স তারকা ইত্যাদি। তবে প্রকৃত তারকা তারকাই। তাকে কোন সীমা টেনে বোঝাতে হয় না।

‘ভাত দে’ সিনেমায় শাবানা-আলমগীর

ষাটের দশকে আমার সমসাময়িক অভিনেত্রীদের মধ্যে দাপটে কাজ করতেন শবনম, সুমিতা দেবী, সুচন্দা ও কবরী। সে সময় বাংলা ছবিকে উর্দু ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হতো। আমাদের কেউ কেউ চলে যান শুধু উর্দু এবং কেউ কেউ শুধু বাংলায়। আমি উর্দু এবং বাংলা দু’ধরনের ছবিতেই কাজ করতাম। তবে বাংলা ছবিতে আমার সাফল্য আসতে অনেক দেরী হয়। বাণিজ্যিক ছবিগুলোতে কাজ করলেও তেমন কোন শক্ত ভিত তখনো তৈরি হয়নি। আসলে অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেয়া ঠিক হবে কিনা এটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগেছি দীর্ঘদিন। তবে একটা জিনিস বুঝেছিলাম যে ছবিতে থাকতে হলে পুরোপুরি পেশাদার হতে হবে। সম্পূর্ণ চেষ্টা, শ্রম ছবির পেছনে দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই সে সময় চরিত্র নিয়ে বাছ-বিচার করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমি চাচ্ছিলাম যেকোনভাবে প্রাথমিক স্বীকৃতি। এ সময় আরো একটা ব্যাপারেও আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে আমি উর্দু ছবিতে টিকতে চাই না, বাংলা ছবিতে টিকতে চাই। খুব সঙ্গত কারণেই আমি বাংলা ছবির পক্ষে সিদ্ধান্ত নেই। এ সময় বাংলা ছবিতে পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করার ক্ষেত্রে ‘অবুঝ মন’ ও ‘মধু মিলন’ আমাকে সাহায্য করে। এবং যারা আমার সমালোচনা করতো তাদের কথার জবাবও খানিকটা হয়ে যায় ‘অবুঝ মন’ থেকে। ‘অবুঝ মন’ কোন আর্টফিল্ম না হলেও সামাজিক, প্রেমের ছবি ছিল। সেখানে অভিনয়ের সুযোগও ছিল বেশ। আমিও চেষ্টা করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত ভালোই হয়ে যায়। আর এ ছবি থেকেই রাজ্জাক-শাবানা জুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে যায়।

বাংলা ছবির ইতিহাসে শাবানা-রাজ্জাক জুটি একটা অধ্যায় বলেই মনে হয়। আমাদের নিয়ে সে সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রচুর ছবি তৈরি হয়েছে। দর্শক চাহিদা এখনো আছে। অবশ্য এটাও ঠিক যে আমরা যদি ‘অবুঝ মনের’ মতো প্রেমিক-প্রেমিকা সেজে পর্দায় আসি তাহলে হয়তো মানাবে না, তবে দর্শকরা আমাদের এক সঙ্গে দেখতে চায়, এখনো।

আমার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল ছবি প্রযোজনা সংস্থা গড়ে তোলা। এটা ছিল তৎকালীন বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। আমি দেখেছি ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচুর প্যাঁচ রয়েছে, রাজনীতি রয়েছে। এজন্য শক্তিশালী অভিনয় ক্ষমতা ও দর্শক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ফিল্মী রাজনীতির কবলে পড়ে সরে যেতে হয়েছে, আমার নিয়তিও এমন হোক এটা আমি চাইনি। যেহেতু বেশ আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ছবিতে আমি থাকবো এ কারণে আমার অবস্থানকে নিশ্চিত করার জন্য নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা ছিল অত্যন্ত জরুরি। আমার বাবাও ছবি পরিচালনায় আসতে চাচ্ছিলেন। পরিচালক হিসেবে তিনিও খুব বেশি অভিজ্ঞ ছিলেন না। এ কারণে আমার সংস্থা থেকে বাবাকে নিয়ে ছবি পরিচালনা করা হয়। ছবিটি ছিল ‘মুক্তি’— এটা ১৯৬৯ সালে রিলিজ পায়। এরপর কিছুদিন কাটে অস্থিরতায়। কিছু ব্যক্তিগত এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্যও।

স্বামী ওয়াহিদ সাদিকের সঙ্গে শাবানা

তারপরও অভিনয় অব্যাহত থাকে। এবং আমি বুঝতে পারি এতোদিনে সাধারণ দর্শকদের মাঝে আমার একটা শক্ত অবস্থান তৈরি হয়ে গেছে। হতে পারে দর্শকদের আমি মোহিত করতে পেরেছিলাম অথবা দর্শকরা আমার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। যে কারণেই হোক নির্মাতারা আমার প্রতি আগ্রহ বজায় রেখেছিল। অবশ্য একটা বিষয় বুঝতে পারছিলাম যে আমি শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ছবিতেই বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পড়ছি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার তেমন কিছু করার ছিল না। দর্শকরা আমাকে যেভাবে চাচ্ছিলেন নির্মাতারা সেভাবে তৈরি করছিলেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি ঢাকাতেই থাকি। যে কোন কারণেই হোক আমাদের পরিবারের কাউকে এ যুদ্ধ থেকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়নি। তবে সময়টা ছিল শ্বাসরুদ্ধকর। প্রায় সব সময়ই শহরে কার্ফ্যু থাকার জন্য বাইরে যাওয়া যেত না। ছবির কাজকর্ম বন্ধ। ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছি এক একটা দিন।

স্বাধীনতার পর আবার ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে সবাই ফিরে আসে ঢাকায়। তবে মারাত্মক একটা পরিবর্তন হয়ে যায় সব জায়গায়। মানুষের রুচি, আচরণ সব কিছুতে বিরাট পরিবর্তন চলে আসে। স্বাভাবিকভাবেই আমাকেও বদলে নিতে হয় ভিতরে ভিতরে। নতুন করে ভাবতে হয় সামনের সময়কে।

বিয়ে আমার জীবনে অসাধারণ একটা ঘটনা। যেহেতু আমি একজন মেয়ে, তাই স্বাভাবিক ক্ষেত্রে বিয়েটা তেমন অসাধারণ কিছু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে একজন তারকার জন্য বিয়ের সিদ্ধান্ত অনেক ভেবে-চিন্তে নিতে হয়। কেরিয়ারের উপর বিয়ের প্রভাব মারাত্মক। সাদিককে আমি বিয়ে করি ১৯৭৩ এ। সময়টা খুব অস্থিরতার, চার পাশে ভাঙাচোরা। সে সময় আমার জন্য জরুরী সার্বক্ষণিক গাইড এবং ব্যক্তিগত বন্ধু। সাদিককে পেয়ে আমার এ অভাব দুটো মিটে যায়। আসলেই সে আমার প্রকৃত বন্ধু। আমার জীবনে সাদিক আসার পর অনেক বিষয় আমি ওর উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত বোধ করি। আমার প্রযোজনা সংস্থা পুরো ছেড়ে দিই সাদিকের উপর। সাদিক প্রথমে সরকারী কর্মকর্তা ছিল। কিন্তু ব্যবসা ও চাকরি এক সঙ্গে করা সম্ভব না হওয়ায়, ও চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরিভাবে চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী বনে যায়। এতে আমার সুবিধাই হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে বিভিন্ন রকম গ্রুপিং-লবিং কাজ করে। এ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য আমাকেও জড়াতে হয় গ্রুপিং-এ। এক্ষেত্রে সাদিক আমার সার্বক্ষণিক পরামর্শদাতার কাজ করে।

৭৩-৭৪ এর পর আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ততদিনে আমার কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠা আমি পেয়ে গিয়েছি। দরকার ছিল শুধু এই অবস্থানটা বজায় রাখা। বাণিজ্যিক ছবিতে আমার রমরমা চাহিদা থাকলেও এক শ্রেণীর দর্শক ও নির্মাতা আমাকে এড়িয়ে চলতেন। আমার বিরুদ্ধে তাদের সমালোচনার অন্ত ছিল না, আমি বেটে, আমার কণ্ঠ ভালো না, আমার হাসি-কান্না আলাদা করা যায় না ইত্যাদি। এসব সমালোচনার একটা মোক্ষম জবাব দেয়ার সুযোগ খুঁজছিলাম। এটা এসে যায় ‘জননী’ ছবিতে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর। এটা ছিল আমার প্রথম জাতীয় পুরস্কার। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার। খুব স্পষ্ট মনে আছে, ঘোষণা শুনে আমার চোখে পানি এসে পড়েছিল। এতদিনে আমার কাজের স্বীকৃতি পেলাম। অবশ্য কোন শিল্পীর জন্য পুরস্কারটাই প্রধান হতে পারে না। তার জন্য বড় পুরস্কার দর্শকদের ভালোবাসা। সে পুরস্কার আমি অনেক আগেই পেয়েছিলাম। তারপরও পুরস্কার শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করে। কাজ করে যেতে উৎসাহ দেয়। এটা ছিল ১৯৭৯ এর ঘটনা। ১৯৮০ এর জাতীয় পুরস্কারও নেয়া হয় আমাকে। ‘সখি তুমি কার’ ছবিতে শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের জন্য।

অভিনয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছি তিন দশক ধরে। এর প্রতিটা দিনই আমার কাছে নতুন করে এসেছে। অসংখ্য টুকরো স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করে। চলচ্চিত্র শিল্পের সেই আগের পরিবেশ এখন নেই। থাকার কথাও নয়। সময়ের সঙ্গে বদলে যায় সব কিছু। মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। সে সময় ইন্ডাস্ট্রিতে সবাই একটা পরিবার হয়ে কাজ করতো। সহশিল্পীদের মধ্যে ছিল আন্তরিকতা। ইউনিটের একজন কেউ অসুস্থ হলে সবাই তার খোঁজ দিতো। পরিচালক ছিলেন পরিবারের বাবার মতো। খুঁটিনাটি সব কিছু তিনিই তদারক করতেন। আমরা কেউ অভিনয়ে খারাপ করলে পরিচালক নিজে সে অংশ দেখিয়ে দিতেন। এ প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় পরিচালক এহতেশাম ও মোস্তাফিজের কথা মনে পড়ে। মোস্তাফিজ ভাইয়ের কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। তার সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি। বাংলাদেশে তার মত পরিচালক খুব কমই আছে। গত বছর যেদিন এই মহান মানুষটার মৃত্যুর সংবাদটা শুনলাম, সেদিন বুঝলাম ইন্ডাস্ট্রি থেকে আমার একজন একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী চলে গেলেন।

আমার অভিনয় জীবনে পরিচালকদের ভূমিকাটা প্রথম। অভিনয়ে আসার আগে আমার এ সম্পর্কে কোন পড়াশোনা বা ব্যবহারিক জ্ঞান কিছুই ছিল না। আমি যা শিখেছি তার সবটুকুই শিখেছি বিভিন্ন পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করে। তারা আমাকে হাত ধরে শিখিয়েছেন। আর এক্ষেত্রে আমি এহতেশাম ও মরহুম মোস্তাফিজ ভাইয়ের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।

একজন শিল্পীর কাছে তার অভিনীত সব চরিত্রই প্রিয়, গুরুত্বপূর্ণ। এ পর্যন্ত আমার অভিনীত ছবির সংখ্যা প্রায় আড়াইশো। অসংখ্য চরিত্রে আমাকে কাজ করতে হয়েছে। এক একটা চরিত্র এক এক ধরনের। তারপরও আমজাদ হোসেনের ‘ভাত দে’ ছবির চরিত্রটি আমার কাছে এখনো প্রিয়। এই চরিত্রে কাজ করে আমি প্রকৃত আনন্দ পেয়েছি। তাছাড়া ‘মাটির ঘর’ ছবিতেও আমি প্রাণ খুলে কাজ করতে পেরেছি। অভিনয়ের দিক থেকে কেমন হয়েছে বলতে পারবো না, তবে আমি কাজ করে তৃপ্ত ছিলাম। মনে হয়েছিলো এখানে কিছু করা যাবে।

বিয়ের আসরে শাবানা ও ওয়াহিদ সাদিক

আমার কেরিয়ারের প্রথম দিকে চরিত্র বেছে ছবি নেয়াটা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি সত্য, তার মানে এই নয় যে যা পেয়েছি তাতেই সই করেছি। আমি সব সময়ই চেষ্টা করেছি ভালো ছবিতে কাজ করতে, অভিনয়ের সুযোগ আছে এমন চরিত্র নিতে। কিন্তু সব সময় এটা হয় না। আমি অভিনয়ে এসেছিলাম বড় বড় পুরস্কার জেতার জন্য নয়। প্রথম থেকেই আমার কেরিয়ার নিয়ে উচ্চাভিলারী পরিকল্পনা ছিল না, ছিল না তেমন কোন কমিটমেন্ট। প্রথমে অভিনয় সম্পর্কে কৌতূহল থাকলেও অচিরেই তা পরিণত হয় পেশায়। এবং যেদিন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এটা আমার পেশা সেদিনই বুঝেছি, সৌখিনতা করে পেশা ঠিক রাখা যাবে না। এ কারণে আমার সম্পর্কে এমন কথা হয় যে আমি অভিনয় যন্ত্র। সন্দেহ নেই আমি অভিনয় যন্ত্র। তবে যাকে ভালোভাবে চালাতে পারলে ভালো জিনিসও বের হয়। তাছাড়া পরিচালকরাও এ ব্যাপারে খানিকটা দায়ী। আমাদের এখানে কোন শিল্পী এক ধরনের চরিত্রে ভালো করলে তাকে নিয়ে শুধু ঐ ধরনের চরিত্র করানোর চেষ্টা করা হয়। এর ফলে ঐ শিল্পীর ইচ্ছা থাকলেও অন্য বৃত্তে যেতে পারে না। তবে তারপরও আমি ভালো করার অনবরত চেষ্টা করেছি। আর একটা ব্যাপার, আমি খুব সাধারণ মানুষ। একেবারে অন্যরকম হওয়ার কোন পরিকল্পনা ছিল না। সাদামাটা, বিষয়ী চিন্তা ভাবনার মাঝে থেকে কিছু করতে চেয়েছি। আমার লক্ষ্য বোদ্ধা সমালোচকরা নয়, সাধারণ দর্শক। আর এই শ্রেণীর দর্শকদের কাছে আমি এখনও সমান জনপ্রিয়। এই হিসেবে আমি আমার লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি। এবং অনেক ক্ষেত্রে সমালোচকদের প্রশংসাও কুড়িয়েছি। এই প্রশংসা ছিল আমার জন্য বোনাস। একটা জিনিস আমি বিশ্বাস করি যে, আমার যদি ক্ষমতা থাকে, আন্তরিকতা থাকে, তবে তার স্বীকৃতি একদিন না একদিন পাবোই।

এদেশে বাংলা চলচ্চিত্রের বয়সের প্রায় সমান আমার বয়স। এই লম্বা সময়ে অনেক পেয়েছি এখান থেকে। একবার মনে আছে খুলনায় যাচ্ছিলাম পারিবারিক কাজে। এক রেলক্রসিংয়ে গাড়ি আটকে গেলে মানুষের চোখে পড়ে যাই। দেখতে দেখতে চারপাশে লোকজন জড় হয়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ এসে সবাইকে সরিয়ে দেয়। এই জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বও এসে পড়ে। সমাজের জন্য, মানুষের জন্য দায়িত্ব। আমাদের ক্ষমতা সীমিত সীমাবদ্ধ, এর মধ্যেও কিছু করা উচিত। সব সময় পেরে উঠি না। এর জন্য একটা অপরাধবোধও কাজ করে। রাজনীতির ঘোর আমি বুঝি না। জানি না কোন মত-পথ আমাদের জন্য দরকার। তবে একটা বিষয় করে বুঝি যে সব মত-পথের উপরে মানুষ। মানুষের ভালো করা যায় এমন তন্ত্রই দরকার। তবে একথা নিঃসন্দেহে ঠিক যে সুষ্ঠু শিল্পের বিকাশে অবশ্যই সাংস্কৃতিক জগতে মুক্ত পরিবেশ থাকা দরকার। যে কোন প্রতিবন্ধকতাই শিল্পের জন্য ক্ষতিকর। আমার কাছে চলচ্চিত্র একটি বিনোদন এবং শিক্ষামুলক মাধ্যম। একটি ছবি মানুষের মনের সুখ-দুঃখের খোরাক দেয় এবং পাশাপাশি শিক্ষা নেয়। আর রাজনীতি শিক্ষা দেয় অর্থনৈতিক মুক্তি, জনগণের সামগ্রিক কল্যাণ। এই দুইয়ের সম্মিলনে ভালো কিছু করলে সবার কাজে লাগবে। আমাদের এখানে রাজনৈতিক ছবি নির্মিত হয় না, এর জন্য সাহসী ও মেধাবী পরিচালকের সংকটও রয়েছে এবং রয়েছে সরকারী নীতিমালার সমস্যা। আমি বরাবর চেষ্টা করি দুঃস্থদের জন্য কিছু করার। দেশে যখনই বন্যা দেখা নিয়েছে সে সময়টা ছুটে গিয়েছি দুর্গতদের কাছে। শিল্পী সমিতির পক্ষে এবং ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করেছি দূর্গত মানুষকে সাহায্য করার।

আমি মনে করি চলচ্চিত্র শিল্পীদের কার্যক্রম ইন্ডাস্ট্রি নির্ভর হওয়া উচিত। এর মাধ্যমেই তার চিন্তা ভাবনা উপস্থাপন, সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পারে। আমাদের দেশে পরিচালকরা ভিন্ন ধরনের ছবি করার সাহস করেন না। আমার মনে হয় না আমাদের দেশে মেধাবী শিল্পীর অভাব আছে, ভালো নির্মাতা আর পৃষ্ঠপোষক পেলে এখানেও শিল্পোত্তীর্ণ ছবি তৈরি হতে পারে। তবে ভালো ছবি তৈরির জন্য অবশ্যই সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। কারণ আর্টফিল্ম ব্যবসায়িকভাবে মার খাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় এমন ছবি প্রযোজনা করতে কোন ব্যক্তি রাজি না হতে পারে।

মিথুন রাশির জাতিকা আমি। এই রাশির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো দ্বৈততা। সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হওয়া, পেশা বদল করা ইত্যাদি। জীবনের প্রথম দিকে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বৈততা অনুভব করলেও পরবর্তীতে আর এমন হয়নি। পেশা বদল করা সম্ভব নয়। চলচ্চিত্রের সঙ্গে আমার সম্পর্কচ্ছেদ শুধুমাত্র মৃত্যুর মাধ্যমে সম্ভব। তবে এখন অভিনয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হয়েছে। আর এ প্রতিদ্বন্দ্বী হলো আমার সন্তান, সংসার। প্রতিদিনের মোট সময়ের একটা বড় অংশ নিতে হয় সাদিক, উর্দি-শমীদের। আমার দুই মেয়ে ছেলে আমার প্রাণের। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এদেরকে নিয়ে। ওরা বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে দুশ্চিন্তাও বাড়ছে। আমার নিজের বাচ্চারা তো বটেই, সব শিশুরাই আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। সব সময় চেষ্টা করি এদের জন্য কিছু করা যায় কি না।

দীর্ঘদিন ঢাকার ছবির সঙ্গে জড়িত থাকলেও একথা স্বীকার করতে আমার বাধা নেই যে আমাদের ছবির মান আসলেই তেমন উন্নত নয়। ব্যাপারটা বোঝা যায় আন্তর্জাতিক উৎসবে গেলে। উৎসবে অংশগ্রহণ শিল্পীদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সরকারী ডেলিগেট হয়ে গিয়েছি মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, রুমানিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। আন্তর্জাতিক উৎসবে গেলে দেখা যায় আমাদের শিল্পীদের অনেকেই চিনতে পারেন না। তখন খুব খারাপ লাগে। রাশিয়ায় যেয়ে একটা মজার ব্যাপার ঘটে। মস্কোতে একটা রেস্টুরেন্টে বসে খুব মজা করে একটা স্যুপ খেলাম। উঠে ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলাম এটা তৈরি হয় কি দিয়ে, ওয়েটার নির্বিকারভাবে উত্তর দিলো ঘোড়ার লেজ নিয়ে। শোনার পর আমার অবস্থা তো খারাপ। এরপর যতদিন ছিলাম না শুনে আর কিছু খাইনি।

বিদেশে আমাদের ছবির বাজার তৈরির জন্য সরকারীভাবে চেষ্টা করা দরকার। আর যত না আমরা আমাদের বাজার তৈরি করতে পারছি ততদিন শিল্পীদের কাজের ক্ষেত্র বাড়ছে না। বিদেশী শিল্পীদের মধ্যে শিল্পীদের মধ্যে স্মিতা পাতিল, শাবানা আজমী, সোফিয়া লোরেন, লিজ টেলর ও গ্রেগরী পেক আমার প্রিয়। সোফিয়া লোরেনের সানফ্লাওয়ারের অভিনয় আমার দেখা স্মরণীয় অভিনয়।

শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে জরুরীভাবে যে গুণটা থাকা দরকার বলে আমার মনে হয় তা হলো, সহনশীলতা ও পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়া। আমরা যখন প্রথম এসেছি তখন চলচ্চিত্রে কাজ করাটা একটা দুঃসাহসের কাজ। সমাজ বিচ্ছিন্নতার একটা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হতো। এখনকার মেয়েদের জন্য তো ফিল্মে আসা কোন ব্যাপারই নয়। সব কিছু সহজ হয়ে গেছে। এখন যারা নতুন আসছে তাদেরকে আমি সানন্দে স্বাগতম জানাই। এক সময় আমাদের সবাইকে এ জায়গা ছেড়ে নিতে হবে। নতুন কোন শাবানার জন্ম হবে।

কাজ করতে আমার আপত্তি নেই। অক্লান্ত পরিশ্রম করে যেতে পারি। তবে অবশ্যই আমার কাজকে মূল্যায়ন করতে হবে। অবশ্য মাঝে মাঝে ক্লান্তি যে আসে না তা নয়। তখন কাজকর্ম ছেড়ে সম্পূর্ণ ডুব দিতে ইচ্ছে করে। চলে যেতে ইচ্ছা করে দূরের অচেনা কোন দেশে। বিদেশ ভ্রমণ আমার একটা প্রিয় সখ। অনেক দেশ ঘোরা হয়েছে, তবে একটা জায়গায় এখনো যায়নি। এটা হলো সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। টোকিও, হিরোশিমা, নাগাসাকি, বিখ্যাত ফুজী টাওয়ারের মোহময় দৃশ্য দেখার খুব ইচ্ছে আছে।

মানুষের জীবনটা খুবই সীমিত। মাত্র ক’টা দিন এই জীবনে। যেভাবে পারা যায় ভালোভাবে কাটাতে চাই সময়টা, এ জন্য জীবনের কাছে আমার প্রত্যাশাও সীমিত। কোন না পাওয়ার কষ্ট নেই। আসলে না পাওয়ার কষ্ট রাখতে নেই। থাকলে কষ্ট বাড়ে। জীবন আমাকে যা দিয়েছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাই। যতদিন বেঁচে আছি অভিনয় নিয়ে থাকতে চাই। চলচ্চিত্রের কাছে আমার একটা চাওয়া আছে, আমার, মৃত্যুর দিন পর্যন্ত আমি যেন দর্শকদের ভালোবাসা পাই।

না-খাওয়ার কোন কষ্ট নেই বটে, তবে একটা অতৃপ্তি কাজ করে মনের মধ্যে সব সময়। অনেক ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছি, অনেক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু আমার মনের মত একটা চরিত্র এখনো পাইনি যেখানে আমার সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে অভিনয় করতে পারি। এবং এই অভিনয় দিয়ে আমার দর্শকদের মাঝে চিরদিনের জন্য একটা আসন তৈরি করে রেখে যেতে চাই। অভিনয় ছেড়ে দিলেও চলচ্চিত্র শিল্প ছেড়ে দেবো না, ছবি নির্মাণে আসার ইচ্ছা আছে। আমার মনে হয় ছবি পরিচালনা করা অভিনয় থেকে অনেক বেশি কঠিন। এ কারণে নিজেকে আরো প্রস্তুত করার অবকাশ রয়ে গেছে, সম্পূর্ণ তৈরি না হয়ে ছবি পরিচালনায় আসবো না। এখন পরিচালকদের অনেক বেশি সচেতন হওয়া দরকার। ভিসিআর তো রয়েছেই, সম্প্রতি যোগ হয়েছে ডিশ এ্যান্টেনা। এর ফলে দর্শকরা ভিনদেশের চলচ্চিত্রের কৌশল, অভিনয় সম্পর্কে অনেক বেশি জানতে পারছে। ফলে দর্শক আমাদের ফাঁকটা খুব সহজে ধরে ফেলতে পারবে। আমাদের শিল্পীদের উচিত দর্শকদের এই পরিবর্তিত মেজাজ সম্পর্কে ধারণা নেয়া এবং নির্মাতারাও যেন দর্শক রুচির ‘পালস বীট’টা ঠিকমত টের পান। আমি ছবি পরিচালনায় আসলে এসব কিছু বিবেচনা করে আসতে চাই। এবং আমি ছবি পরিচালনায় আসলে বাণিজ্যিক ছবি তৈরি করবো না, আমার সময়ে যে ধরনের ছবি তৈরি কঠিন, অর্থাৎ শিল্পসম্মত ছবি তৈরি করতে চাই।

আমার সম্পর্কে অনেক সমালোচনা রয়েছে। আমি আমার সীমাবদ্ধতাগুলি সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানি। আর জানি বলেই এইসব সমালোচনায় আমার তেমন কিছু আসে যায় না। তবে অনেক সময় সমালোচনা শুনে আমার লাভই হয়েছে, আমার ত্রুটিগুলি শুধরে নিতে পেরেছি। আমার আগে পরে অভিনয় জীবন শুরু করেছিলেন অনেকে— কবরী, সুচন্দা, শবনম আরো অনেকে। এক সময় তারা দাপটের সঙ্গে পর্দা কাঁপাতেন, কিন্তু এখন চলচ্চিত্রের প্রধান স্রোতে তাদের অবস্থান অনুল্লেখযোগ্য। কিন্তু আমি তো টিকে রয়েছি। এবং নিঃসন্দেহে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছি। অভিনয় এখনো কতদিন করবো জানি না। তবে যতদিন দর্শকরা আমাকে পর্দায় দেখতে চাইবেনই ততদিন পর্দায় থাকবো। তারপর ছবি পরিচালনায়। আর যদি দর্শকরা তাও না চান তবে সেখান থেকেও পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলবো। আসলেই আমি খুব সাধারণ চাওয়া-পাওয়া নিয়ে একজন সাধারণ মানুষ, আর এই ইমেজেই বাকী জীবনটা পার করে দিতে চাই।


মন্তব্য করুন