Select Page

মৌসুমীর সেরা লেডি অ্যাকশন ছবি ‘বিদ্রোহী বধূ’

মৌসুমীর সেরা লেডি অ্যাকশন ছবি ‘বিদ্রোহী বধূ’

বিদ্রোহী বধূ; পরিচালক – ইস্পাহানি আরিফ জাহান; শ্রেষ্ঠাংশে – শাবানা, আলমগীর, মৌসুমী, বাপ্পারাজ, দিলদার, রীনা খান, দুলারী, সুষমা, হুমায়ুন ফরীদি প্রমুখ; উল্লেখযোগ্য গান – বুকে ধরে রাখব ছবি আঁকব, আষাঢ়-শ্রাবণে।

আমাদের সিনেমায় সমাজ-সংসার উঠে এসেছে প্রায়ই।প্রতিশোধের গল্প যে সিনেমায় থাকে সমাজের বাস্তব অংশকে অস্বীকার করে না সে সিনেমা।লেডি অ্যাকশন সিনেমাতেও social application থাকে।সমাজের একটা গল্প থেকেই তৈরি হয়।

‘বিদ্রোহী বধূ’ নব্বই দশকে মৌসুমীর ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য সিনেমা।বিশেষ করে লেডি অ্যাকশন ঘরানার সিনেমায় অন্যতম প্রধান তার জন্য।বাংলার পরিবারগুলোতে যেমন বন্ধন থাকে তেমনি অপরাধও থাকে আড়ালে।বন্ধন ও অপরাধের গল্প থেকেই তৈরি ‘বিদ্রোহী বধূ’।

গল্পটা সরল। মৌসুমীর বিয়ে হয় বাপ্পারাজের সাথে যেখানে বাপ্পার বাবা হুমায়ুন ফরীদির বিজনেস পার্টনারের মেয়ের সাথে বাপ্পার বিয়ে হবার কথা ছিল। তা না হওয়াতে ফরীদিকে হুমকি দেয়া হয় নিঃস্ব করে দেয়ার তাই বাড়ির সবাই মৌসুমীকে সরিয়ে দিতে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় মৌসুমী তারপর শুরু হয় প্রতিশোধপর্ব। মা শাবানাও অংশ নেয় মেয়ের প্রতিশোধপর্বে।

যে কোনো মানুষই খুব সহজে বিদ্রোহী হয় না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বিদ্রোহী হয়। পারিবারিক অপরাধ থেকে সামাজিক অপরাধ বাড়ে। পরিবারই প্রতীক সমাজ ও রাষ্ট্রের। নারী নির্যাতনের অনেক পর্যায়ের মধ্যে পারিবারিক নারী নির্যাতন অন্যতম। এর মধ্যে বাড়ির কর্তার অসৎ উদ্দেশ্য এবং সেটির প্রয়োগ অনেক বেশি দায়ী। যে মেয়েরা অনেক আশা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসে তাদের স্বপ্নকে মিথ্যে হতে দেখে, আপন মানুষগুলোকে শত্রুরূপে দেখে তখন তাদের জীবনে যে অন্ধকারটা শুরু হয় সেটির প্রতিক্রিয়া বিদ্রোহের দিকে যাওয়াই স্বাভাবিক। মৌসুমী সেই চরিত্রটি ধারণ করেছে। বাপ্পানাজকে বিদেশে ব্যবসার কাজে পাঠানোর সময় বাপ্পা যেতে রাজি না হলে মৌসুমীই তাকে যেতে বলে। ফ্যামিলি সেন্টিমেন্টকে গুরুত্ব দিয়েছে।কিন্তু মৌসুমীকে তার অধিকারটি দেয়া হয়নি। ফরীদির বন্ধুর মেয়েটি যখন কতৃর্ত্ব করতে চেয়েছে মৌসুমী প্রতিবাদ করেছে

– ‘আমার বাড়িতে আমি কথা বলব না তো তুই কথা বলবি?

এ কথার জবাবে মেয়েটি গালি দিলে মৌসুমীও দেয়। শ্বাশুড়ি ঐ গালিটার মানে জানতে চায় তারপর সবাই মিলে মৌসুমীকে চেপে ধরে এবং মেয়েটি পিঠে ঘুষি মারতে থাকে মৌসুমীকে। এ সিকোয়েন্স থেকে শুরু হয় অত্যাচার তারপর চলতে থাকে।

গল্প এগিয়ে যেতে যেতে এ সিকোয়েন্সগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে-

* মৌসুমীর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে রীনা খানের স্বামী মৌসুমীকে অসম্মান করতে চায়।দিলদার বাঁচায়।

* ফরীদির বন্ধু নতুন করে হুমকি দেয় ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে বলে। ফরীদি মৌসুমীকে বিষ খাইয়ে মারার ব্যবস্থা করে।দুলারী, রীনা খান, রীনার জামাই সবাই মিলে মৌসুমীকে চেপে ধরে। বিষ খেতে না চাইলে মৌসুমীর মুখে কাঠি গুঁজে বিষ ঢেলে দেয় ফরীদি। মর্মান্তিক সিকোয়েন্স।তারপর বিষের জ্বালায় ছটফট করতে থাকা মৌসুমী অজ্ঞান হয়।

এ পর্যন্ত সিনেমা একটা অবস্থানে থাকার পরে পরে প্রতিশোধের পালা যখন শুরু হয় মৌসুমী নতুন রূপে হাজির হয়।শুরুটা হয় ফরীদির বন্ধুর মেয়েকে দিয়ে।তখনকার অ্যাকশন সিকোয়েন্সগুলোতে মৌসুমীকে অনবদ্য লাগে। যেমন-

* মেয়েটি যখন বাপ্পাদের বাড়িতে আসে কেউ ছিল না।সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল আর মেয়েটি ভয়ে কাঁপছিল।পায়ের আওয়াজটা সিঁড়ির সাথে লাউড করে এমনভাবে করা হয়েছে যেখানে ভয় পাবার মত পরিবেশ তৈরি হয়।আর সিঁড়িটা অনেক দীর্ঘ হওয়াতে ক্যামেরা রাউন্ড করে যখন দেখানো হচ্ছিল সেটা ছিল আরো ভয় পাবার মত।অ্যাকশনের সাথে একটা হরর অনুভূতিও আসে ঐ সিকোয়েন্সে ভয়ঙ্কর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কারণে।তারপরই মেয়েটি মৌসুমীকে দেখতে পেয়ে ভয়ে কেঁপে ওঠে।গুলি করার আগেই মেয়েটা মারা যায়।মৌসুমী অবাক হয়।

* রীনা খানের স্বামী ভয়ে নিজেকে বাঁচাতে যখন দৌড়াচ্ছিল রাস্তায়।রাতের ভয়াল পরিবেশে মোটর সাইকেলে এক পা তুলে হাতে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মৌসুমী।ব্যাকগ্রাউন্ডে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়।অ্যাকশন ফুটিয়ে তুলতে ডিরেক্টরের চেষ্টা এখানে প্রশংসনীয়।মোটর সাইকেলের পেছনে বেঁধে নিয়ে যায়।গুলি করার আগে সেও মারা যায়।কিন্তু এমন কেন হচ্ছে মৌসুমী বুঝতে পারে না।

* দুলারীকে মৌসুমী মারার সময় অটোরিকশা থেকে গুলি করে শাবানা।

শেষে আদালতে জানা যায় মৌসুমীর সাথে তার মা শাবানাও প্রতিশোধের মিশনে অংশ নিয়েছিল আড়াল থেকে। শেষ গুলিটা হুমায়ুন ফরীদির জন্য রাখে এবং আদালত চত্বরের বাইরে ফরীদিকে গুলি করে মেরে ফেলে শাবানা। আদালত মৌসুমীকে পরিস্থিতির শিকার হওয়ার কারণে মুক্তি এবং শাবানাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।পরে উচ্চ আদালতে মুক্তি হয়।

শাবানা-আলমগীর, মৌসুমী-বাপ্পারাজ জুটির সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত ফ্যামিলি ড্রামার সাথে লেডি অ্যাকশনে দেখার মতো সিনেমা।অভিনয়সমৃদ্ধ তো বটেই।সাথে রেয়ার গান হিশাবে দর্শক পেয়ে যেতে পারে ‘বুকে ধরে রাখব ছবি আঁকব’ গানটি যেটি রেডিওতে বাজানো হত অনুরোধের আসর গানের ডালি-তে।

বাণিজ্যিক সিনেমার সাধারণ গল্পই অভিনয় ও নির্মাণের গুণে রোমান্স, স্যাডনেস, অ্যাকশন এসবের সমন্বয়ে একটা টোটাল বাণিজ্যিক সিনেমা হয়ে ওঠে। তখন নির্মাতারা জানতেন বাণিজ্যিক সিনেমা এভাবেই দর্শক খায় গ্রহণ করে।দর্শকের সেই ক্ষুধাটা আজো আছে কিন্ত বাণিজ্যিক সিনেমার সেই টোটালিটি দেবার মত নির্মাতার অভাব আছে প্রচণ্ড রকমের।


About The Author

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

Leave a reply