Select Page

তারকাবহুল ফুল কমার্শিয়াল প্যাকেজ ‘যোদ্ধা’

তারকাবহুল ফুল কমার্শিয়াল প্যাকেজ ‘যোদ্ধা’

ফরীদি-রাজিবের দ্বৈরথ ‘যোদ্ধা’র আকর্ষণ দ্বিগুণ করেছে

একটা সিনেমা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই তার অফিসিয়াল পোস্টার নিয়ে কথা বলতে হয়। অফিসিয়াল পোস্টার লঞ্চ করতে আজকের ডিজিটাল ঢালিউডে অনেক পলিসি আছে। শুধু পোস্টারই বা কেন! এখন টিজার, ট্রেলার আরো অনেক পলিসি আছে। ৩৫ মিলিমিটারের সিনেমার সময় নিকট অতীতে ‘যোদ্ধা’ সিনেমার অফিসিয়াল পোস্টারে একটা বিশেষ বুদ্ধিদীপ্ত টেকনিক অ্যাপ্লাই করেছিলেন সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকন। লাল আবরণের পোস্টারের গায়ে লেখা ‘এটি একটি সিনেমার পোস্টার”। ‘যোদ্ধা’ নামটি লাল অক্ষরের এবং তার প্রতীকী অর্থ আসে যুদ্ধ থেকে যোদ্ধা হতে হয় তাই রক্তের লাল রং একটা সূক্ষ্ম চিন্তা এখানে। সমাজ ও রাজনীতির সে যোদ্ধা লড়াকু নায়ক রুবেল।

খোকনের সিনেমায় মাল্টিস্টার হরহামেশাই থাকে। এ সিনেমাকে খোকন তাঁর মেজাজ মর্জিতে খানিকটা আলাদা করে সাজিয়েছেন। এক সিনেমায় হুমায়ুন ফরীদি, রাজিব, খলিল, এটিএম শামসুজ্জামান, মিজু আহমেদ এ লিজেন্ডদের সমারোহ দর্শককে আলাদা পরিতৃপ্তি দেবে। সাথে রুবেলের অ্যাকশন তো আছেই। পূর্ণিমা তখন নতুন ছিল ইন্ডাস্ট্রিতে। তার ইনোসেন্ট মিষ্টি লুক দারুণ। এসবকে একসাথে একটা প্যাকেজের মধ্যে আনতে খোকন স্ট্রং স্টোরি টেলিং, অভিনয়, অ্যাকশন, পারফেক্ট ফিনিশিং, গান সবই রেখেছেন। খোকন জানতেন ফুল প্যাকেজ কমার্শিয়াল সিনেমা কীভাবে বানাতে হয়।

সিনেমার স্টোরি টেলিং বেশ ফ্লোর পেয়েছে। কোনো বিরক্তি আসে না। রাজিবের ভণ্ডামিতে তার দলের মিজু আহমেদ আলাদা হয়।রাজিব চাল খাটিয়ে বিয়ে করে শারমিনকে। খুন করে মিঠুনকে। মিজু আহমেদ ডকুমেন্ট রাখতে ক্যামেরায় ছবি তুলে রাখে। রাজিব এলাকার আধিপত্য রাখতে খুন করাতে ব্যবহার করে হুমায়ুন ফরীদিকে যে তারই সন্তান মানে শারমিনের ছেলে। রুবেল থাকে পুলিশ অফিসার এই এলাকাতেই। পূর্ণিমার সাথে প্রেম। রাজিবকে মারার জন্য একসময় মিজু আহমেদই ঠিক করে ফরীদিকে কারণ ফরীদির পিতৃপরিচয় জানে সে এবং লোকটি রাজিব স্বয়ং। ফরীদি-রাজিব বাবা ছেলের নতুন দ্বন্দ্ব এবং পরিণতিতে মৃত্যু রাজিবের। এটিএম শামসুজ্জামান অসৎ পুলিশ থেকে ভালো হয়। খলিল পূর্ণিমার বাবা। রুবেলের অপারেশন আর ফরীদি-রাজিব শত্রুতা ও প্রতিশোধের নেশা নিয়ে জমে ওঠে সিনেমা।

কমার্শিয়াল সিনেমা শুধু নাচ-গানের ধুন্দুমার অহেতুক মেলা না। টান টান উত্তেজনা ছাড়া কমার্শিয়াল সিনেমা জমে না। ফরীদি-রাজিবকে দিয়ে সিনেমার আকর্ষণকে দ্বিগুণ করা হয়েছে। ফরীদির লুক ব্যতিক্রমী। হিন্দু জাতে। মাথার মাঝে চুল ঝুঁটি হয়ে উঠে গেছে উপরের দিকে। রাজিব ফরীদিকে আশ্রয় দিয়ে বড় করেছে। সুখনারায়ণ নাম দেয় তার। রাজিবের কথামতো খুন করে। তার খুনের নীতি হলো মাথা কেটে ফেলা। স্ট্রং ডায়লগ বেইসড অ্যাকশন ছিল এ দুজনের সিকোয়েন্সে।রাজিব কাউকে খুন করতে হবে ভাবলে বলে- ‘আহ, মুখটা কেমন যেন আমটি আমটি করছে।পান খাব।’ পান খাওয়ার অর্থ খুন করা। সুখ নারায়ণের পানের দোকানটা ফরীদির। ফরীদি বলে-‘তা কর্তা পান খাবেন সুপারি দেবো?’ এখানে ‘সুপারি’ অর্থ যাকে খুন করতে হবে তার নাম জানতে চাওয়া হচ্ছে। কী ক্রিয়েটিভিটি!  একটা সিকোয়েন্সে ফরীদি-রাজিব গল্প করে দুজনে।রাজিব সোফায় বসে, ফরীদি মেঝেতে। কথোপকথনটি অসাধারণ-

রাজিব – তা তোর নাম সুখনারায়ণ হলো কীভাবে রে?

ফরীদি – আজ্ঞে কর্তা একটা মন্দিরে ঘুমিয়ে ছিলাম। কে জানি বলেছিল, আহা নারায়ণ নারায়ণ ছেলেটা কী সুখে ঘুমাচ্ছে! সেই থেকে সুখ নারায়ণ।

ফরীদি যখন মিজু আহমেদের সাথে চুক্তি করে রাজিবকে খুন করতে আসে রাজিব অবাক হয়। বলে-‘তুই তো পাগলা কুত্তা হয়ে গেছিস রে।পাগলা কুত্তাকে বাঁচিয়ে রাখা ঠিক না। মরার আগে তোর শেষ ইচ্ছা বল।’ ফরীদি মরার আগে বুকে টেনে নিতে বলে রাজিবকে। রাজিব বুকে টেনে নেয় আর বলে- ‘তোকে মারতে অনেক কষ্ট হবে রে।’ শহীদুল ইসলাম খোকন নায়কের পাশাপাশি খলনায়কের সাথে দর্শকের অ্যাটাচমেন্ট এখানে গভীর করে দেন ফরীদি-রাজিব কম্বিনেশনে। তাদের সিকোয়েন্সগুলোতে দর্শকের রাগ হবে, ক্ষোভ হবে, কষ্ট হবে। তাদের নৃশংসতা ঘৃণা ধরাবে আবার ইমোশনাল পার্টগুলো খারাপ লাগাবে। তাঁদের অভিনয় তুলনাহীন।

রুবেলের পুরো সিনেমায় ব্যক্তিত্ববান লুক। আইনের সমস্যা ও নেতার ভণ্ডামি মিলিয়ে তার যুদ্ধ অনেক বেশি।পূর্ণিমা তাকে সাহায্য করে। শেষের গান ‘ওরে হায়েনা’ আজকের যে কোনো আইটেম সং এর থেকে শতগুণ এগিয়ে। পূর্ণিমার প্রথমদিকের সিনেমা হিশেবে যথেষ্ট ভালো পারফরম্যান্স। অসৎ থেকে সৎ পুলিশ এটিএম শামসুজ্জামান ঐ গানে অসাধারণ এক্সপ্রেশন দেন। মিজু আহমেদ মারা যায় রাজিবের চালে।রাজিব মারা যায় ফরীদির হাতে।বাপকে খুন করল কেন জানতে চাইলে ফরীদি বলে-‘পৃথিবীতে তোর মতো বাবা যেন না থাকে। ‘ডায়লগটা কমন কিন্তু সিনেমার ঐ সিচুয়েশনে পারফেক্ট। ফিনিশিং এ এসে সোশাল মেসেজ দেন পরিচালক যেখানে রুবেলকে দেখানো হয় তার নতুন অধ্যায়ের যুদ্ধে ‘যোদ্ধা’ রূপে। মুকুট পরার থেকে রক্ষা করা কঠিন সে কথাই বলে।

প্রত্যেক ক্যারেক্টারকে তার বিকশিত হবার স্পেস দিয়ে স্টোরি, অভিনয়, অ্যাকশন, রোমান্স, পারফেক্ট ফিনিশিং সবকিছু মিলিয়ে ‘যোদ্ধা’ তারকাবহুল অনবদ্য এনজয়অ্যাবল সিনেমা। যে সিনেমা আজকের ডিজিটাল যন্ত্রপাতির ঝনঝনানি তোলা নির্মাতারা পারেন না বানাতে। তাদের কাছে ফুল প্যাকেজ কমার্শিয়াল সিনেমার আদর্শ শিক্ষক হতে পারেন নিকট অতীতের আধুনিক নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন আর ‘যোদ্ধা’ সিনেমা হতে পারে তার একটা পাঠ।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন