Select Page

যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ও বাংলাদেশ

যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ও বাংলাদেশ

বিশ্বের যেকোন দেশের সিনেমা দেখতে এখন ভাষাটা মুখ্য ব্যাপার নয়। কারন সিনেমা নিজেই একটা ভাষা। তাই বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশের দর্শকরাই নিজ দেশের বা নিজ ভাষার সিনেমার পাশাপাশি ভিন্ন দেশ বা ভাষার সিনেমাকেও আপন করে নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় উঠে এসেছে “যৌথ প্রযোজনার সিনেমা” প্রপঞ্চটি। সাম্প্রতিককালে এটা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সবচেয়ে পরিচিত, আলোচিত ও সমালোচিত শব্দ।

যৌথ প্রযোজনার সিনেমা

একজন সাধারণ দর্শক যৌথ প্রযোজনার সিনেমা বলতে দুইটি দেশের অর্থায়নে নির্মিত সিনেমাকে বোঝে। আসলে এই ধারণা অসম্পূর্ণ। যৌথ প্রযোজনা তিনটি বা তার বেশি দেশের যৌথ অর্থায়নেও হতে পারে। এমনকি একই দেশের একাধিক প্রোডাকশন হাউজের যৌথ অর্থায়নেও হতে পারে। যেমন বাংলাদেশ+ভারত+কানাডার যৌথ অর্থায়নে নির্মিত ১৯৮৩ সালের ছবি “দূরদেশ (Gehri Chot)” যেমন যৌথ প্রযোজনার সিনেমা, তেমনি ভারতেরই শাহরুখ খানের Red Chillies Entertainment ও করন জোহরের Dream Productions এর যৌথ অর্থায়নে নির্মিত Kaal (2005) সিনেমাটিও যৌথ প্রযোজনার সিনেমা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র The Story of the Kelly Gang (1906) মুভিটিও ৪ ব্যবসায়ী বন্ধুর যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছিল।

যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশের একজন সাধারণ দর্শক যৌথ প্রযোজনার সিনেমা বলতে বাংলাদেশের সাথে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের যৌথ অর্থায়নে নির্মিত সিনেমাকে বোঝেন। কারণ বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি যৌথ প্রযোজনার সিনেমা করেছে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের সাথে। ১৯৭৩ সালে আলমগীর কবিরের “ধীরে বহে মেঘনা” সিনেমার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার সিনেমার যাত্রা শুরু হয়। নব্বই দশকের পর থেকে যৌথ প্রযোজনায় সিনেমা নির্মাণ কিছুটা কমে এলেও ২০১৪ সাল থেকে এর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও তুরস্কের সাথেও যৌথ প্রযোজনায় সিনেমা করে। ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত মিল এবং নিকটবর্তী ভৌগলিক অবস্থান ও শিল্পীদের পরিচিতিই ভারতের সাথে বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা বেশি যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণের অন্যতম কারণ।

যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা

শুধু দুই দেশের দুইটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান একটি সিনেমার জন্য সমপরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করলেই যৌথ প্রযোজনা হয়ে যায়না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশ সরকারও ১৯৮৬ সালে যৌথ প্রযোজনায় সিনেমা নির্মাণের ব্যাপারে কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করেন। এই নীতিমালা অনুযায়ী “যৌথ প্রযোজনায় সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে উভয় দেশের নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলী, কারিগরি প্রপঞ্চের ব্যবহার, লোকেশন (শুটিং এর সময়) ইত্যাদি সমহারে থাকতে হবে”। এককথায় উভয় দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করে সিনেমাটি সংশ্লিষ্ট সবকিছুতেই দুদেশের 50-50 অংশীদার থাকতে হবে। সে সময় নির্মাতারা এই নীতিমালা মাথায় রেখেই যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণ করতেন। তাই সেসময় যৌথ প্রযোজনার সিনেমায় অনিয়ম হয়েছে এমন কোন বিষয় নিয়ে সমালোচনা শোনা যায়নি। তবে ২০১২ সালে এই নীতিমালা পরিবর্তন করে সমানুপাতের ব্যাপারটি শিথিল করে উল্লেখ করা হয় “যৌথ প্রযোজনায় সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে, সিনেমাটি নির্মাণগত বিষয়াবলী দুই দেশের নির্মাতাগণ আলোচনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত করবেন।” মূলত ২০১২ সালের এই সংশোধিত নীতিমালার কারণেই “যৌথ প্রযোজনা” প্রত্যয়টি সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়।

যৌথ প্রযোজনার মানদণ্ড

লেখার এই অংশটা একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। একটি আদর্শ যৌথ প্রযোজনার সিনেমা বলতে যদি কোন সিনেমাতে দুই দেশের গল্প, নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলী, লোকেশন ও শুটিং টাইমের সমানুপাতকে বোঝায়, তাহলে আমি বলবো “আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোন আদর্শ যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মিত হয়নি”।

এবার আমি আমার মন্তব্যের ব্যাখা করছি। এটা চরম সত্য যে বিশ্বের যেকোন দেশের যৌথ প্রযোজনার সিনেমায় এগিয়ে থাকে অপেক্ষাকৃত ভাল টেকনোলজি ও সিনেমার ভাল বাজার আছে এমন দেশটি। যেমন ফ্রান্স, ইটালি বা জার্মানিই হোক না কেন, আমেরিকার সাথে যে দেশই যৌথ প্রযোজনার সিনেমা করবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমেরিকাই এগিয়ে থাকবে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ২০০০ সাল পর্যন্ত আমাদের সিনেমার বাজার, নির্মাণশৈলী ও টেকনোলজি পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। এজন্য স্বাভাবিকভাবেই যৌথ প্রযোজনার সিনেমার ক্ষেত্রে আমরা পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে একটু বেশিই সুবিধা পেতাম আর সেটা আরো সহজ করে দিত সিনেমার গল্প।

একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করে দিচ্ছি। যেমন যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ধীরে বহে মেঘনা, তিতাস একটি নদীর নাম, পদ্মা নদীর মাঝি; এগুলোর নাম বা গল্পের কারণেই বাংলাদেশের যথাক্রমে মেঘনা, তিতাস ও পদ্মা নদীর পার্শ্ববর্তী লোকেশনে শুটিং করা হয়েছে, যার ফলে বাজেট বা অন্যান্য সুবিধার জন্য বাংলাদেশী শিল্পী, কলাকুশলী ও প্রযুক্তি বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। আর এর অন্যতম কারণ এটাও ছিল যে তৎকালীন বাংলাদেশী সিনেমার বাজার পশ্চিমবঙ্গের বাজারের চেয়ে অনেক ভাল ছিল। তবে মুম্বাই বা বলিউডের চেয়ে ভাল ছিল না, তাইতো “দূরদেশ” নামক যৌথ প্রযোজনার ছবিটিতে প্রধাণ চরিত্রগুলোর মধ্যে মুম্বাইয়ের বাঘা বাঘা চারজন শিল্পীর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে ছিলেন শুধু ববিতা ম্যাডাম।

২০০৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ কারিগরি দিক থেকে অনেক উন্নত হলেও সেখানে তেমন উল্লেখযোগ্য নায়ক-নায়িকা ছিল না। তাই রিয়াজ-পূর্ণিমা জুটিকে প্রধান চরিত্রে রেখে প্রায় সম্পূর্ণ ভারতের লোকেশনে ও পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী ও কলাকুশলীদের নিয়ে “মনের মাঝে তুমি” নির্মিত হলেও, শুধু মূল চরিত্রে রিয়াজ-পূর্ণিমাকে বাংলাদেশীদের এবং পুরো সিনেমায় ভারত আর ভারতীয়দের পেয়ে ভারতের দর্শকদের মনে হয়নি তাদের দেশ ঠকেছে। অর্থাৎ সে সময় বাজার, প্রযুক্তি ও গল্পগত কারণে যৌথ প্রযোজনার সিনেমাগুলোতে বাংলাদেশ কিছুটা এগিয়ে থাকলেও, সবধরনের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত বা অন্যকোন দেশ ঠকেছিল এমন কোন নজির নেই। এক জায়গায় একটু কম পেলে অন্যত্র একটু বেশি পেয়ে পুষিয়ে গিয়েছিল।

তবে ২০১৪ সাল থেকে একের পর এক যে সকল বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মিত হয়েছে বা হচ্ছে তার প্রায় সবগুলোই (দক্ষিণ) ভারতীয় সিনেমার রিমেক। তাই মূল সিনেমার “বিশুদ্ধতা” বজায় রেখে সহজে শুটিং করতে ব্যবহার করা হচ্ছে সেই মূল ভারতীয় সিনেমার ভারতীয় লোকেশন ও প্রযুক্তি। যার ফলে সেই সিনেমায় এগিয়ে থাকছেন ভারতীয় শিল্পী কলাকুশলীরা। যেখানে বাংলাদেশী প্রযুক্তি ও কলাকুশলী অনুপস্থিত, বাংলাদেশী শিল্পী ও বাংলাদেশ হচ্ছে অতিথি শিল্পী। মূলত এই গল্প ঠিক করছে দিনেমার লোকেশন, লোকেশন ঠিক করছে টেকনোলজি ও কলাকুশলীদের সহজলভ্যতা। আর তাতেই অবহেলিত হচ্ছে বাংলাদেশ। ধরুন, দুই কোটি বাজেটের একটি যৌথ প্রযোজনার সিনেমাতে বাংলাদেশ থেকে ১ কোটি ও ভারত থেকে ১ কোটি বিনিয়োগ করার ব্যাপারটা নিশ্চিত করা গেল। কিন্তু গল্পটা হচ্ছে কাশ্মীরের বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ে বেড়ে উঠা এক নায়কের গল্প নিয়ে। এখন যেহেতু বাংলাদেশে এই ধরণের লোকেশন পাওয়া যাবেনা, সেহেতু বাধ্য হয়ে পর্যাপ্ত কারিগরি ও কলাকুশলীগত সহযোগিতা নিয়ে শুটিংটা ভারতেই করতে হবে। এক্ষেত্রে বেশকিছু দিক থেকে ভারত এগিয়ে থাকবে, যেমনটা “পদ্মা নদীর মাঝি” সিনেমায় পদ্মা তথা বাংলাদেশ এগিয়ে ছিল। অর্থাৎ, সিনেমার A to Z সব জায়গায় সমানুপাতের যৌথ প্রযোজনা বা সবক্ষেত্রে দুই দেশের কাটায় কাটায় 50-50 অংশীদারি হওয়া প্রায় অসম্ভব হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটু কম-বেশি করে হয়তো পুষিয়ে দেওয়া সম্ভব।

যদিও বাংলাদেশে আদর্শ বা মানদণ্ড হতে পারে এমন কোন যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নেই। তারপরও যৌথ প্রযোজনার সিনেমা কিভাবে নির্মাণ করা উচিৎ সেটা জানার জন্য নির্মাতাদের এম এ কাসেম পরিচালিত “সাধনা” সিনেমাটি দেখা উচিৎ। সাধনা কোন যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নয়, তবে এই সিনেমার একটি দৃশ্যে দেখানো হয় একজন নির্মাতারারা কত স্বচ্ছভাবে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার একটি সিনেমা বানাচ্ছেন। যা কাল্পনিক হলেও বর্তমান নির্মাতাদের চোখ খোলার জন্য যথেষ্ট।

যৌথ প্রতারণা

বর্তমানে বাংলাদেশে সম্ভবত “যৌথ প্রযোজনা” শব্দগুলোর চেয়ে “যৌথ প্রতারণা” শব্দগুলোই বেশি উচ্চারিত হয়। যেন শব্দগুলো একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর কারণ হল, ২০১৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশে বেশকিছু যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মিত হয় যেগুলোতে বাংলাদেশ ও দেশের শিল্পী ও কলাকুশলীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে দেশের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। এধরণের যৌথ প্রযোজনার ছবিগুলো থেকেই “যৌথ প্রতারণা” শব্দটির উৎপত্তি হয়।

আমি আগেই বলেছি দুইটি দেশের মধ্যে যে দেশের প্রযুক্তিগত ও বাজারগত অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভাল, যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে সে দেশ কিছুটা বেশি সুবিধা পায় এটাই স্বাভাবিক। এটা অনস্বীকার্য যে, ২০০৬ এর পর থেকে আজ পর্যন্ত নির্মাণশৈলী ও প্রযুক্তিগত মানের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় বাংলা সিনেমা ইন্ড্রাস্ট্রি আমাদের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে আছে, তাই যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে তারা কিছুটা বেশি সুযোগসুবিধা পেতেই পারে। সেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের অনুপাত ৪৫:৫৫ বা সর্বোচ্চ ৪০:৬০ পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু ২০১৪ থেকে আজ পর্যন্ত নির্মিত যৌথ প্রযোজনার সিনেমাগুলোতে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের অংশ খুবই কম এবং কোনটাতে সব মিলিয়ে ১০% এরও কম।

১৯৮৬ সালের যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা কড়াকড়ি থাকায় নির্মাতারা সেটা কড়াকড়িভাবে পালন করতেই বাধ্য ছিলেন। কিন্তু ২০১২ তে এই নীতিমালা শিথিল ও দুর্বল হয়ে গেলে কিছু অসাধু নির্মাতা সেই সুযোগটা নিয়ে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে একের পর এক যৌথ প্রতারণার সিনেমা নির্মাণ করতে থাকেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন পরিচালক অনন্য মামুন। মূলত তারই হাত ধরে দেশীয় সিনেমায় যৌথ প্রতারণার অনুপ্রবেশ ঘটে বলে তাকে অনেকেই “যৌথ প্রতারণার জনক” বলে থাকেন। ২০১৪ সালে তিনি একটি জনপ্রিয় দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা নকল করে “আমি শুধু চেয়েছি তোমায়” নামের একটি তথাকথিত যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণ করেন। যেখানে গল্পের মূল তিনটিসহ প্রায় ৯০% ক্যারেক্টারের শিল্পী ছিলেন ভারতের, শুটিংও ৯০% এর বেশি ভারতে হয়েছে। এমন প্রতারণার শাস্তিস্বরূপ বাংলাদেশ পরিচালক সমিতি অনন্য মামুনকে নিষিদ্ধ করলেও, তার এই সাফল্যে “অনুপ্রাণিত” হয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রোডাকশন হাউজ জাজ মাল্টিমিডিয়া একের পর এক যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণ করে যাচ্ছেন যার বেশিরভাগই “যৌথ প্রতারণার” অভিযোগে অভিযুক্ত।

যৌথ প্রতারণা ও অভিযোগসমূহ

যৌথ প্রতারণা নিয়ে সিনেমা বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ দর্শকদের বেশকিছু জোরালো অভিযোগ আছে। নিচে সেগুলো পয়েন্ট আকারে তুলে ধরলাম।

১. এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে যৌথ প্রযোজনার নাম ভাঙ্গিয়ে কলকাতার সিনেমার বাজার ধরার নাম করে বাংলাদেশের সিনেমার বাজারে কলকাতার শিল্পীদের বাজার সৃষ্টি করে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের সিনেমার বাজার ও এদেশের টাকা তুলে দেওয়া হচ্ছে ভারতীয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে।

২. খোদ তথ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে যৌথ প্রতারণার সিনেমার সমর্থন ও ছাড় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

৩. কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিনেমা হলগুলো জিম্মি করে বাংলাদেশ, এদেশের শিল্পী, কলাকুশলী ও সংস্কৃতিকে অবহেলা করা হয় এমন সব সিনেমাকে জেনেশুনে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।

৪. বেশিরভাগ যৌথ প্রযোজনার সিনেমারই ভারতে লোকাল প্রোডাকশনের সিনেমা হিসেবে শুটিং হয় এবং সেভাবেই সেখানে মুক্তি পায়। এমনকি তাদের দেশের পোস্টার, টাইটেল কিংবা ট্রেলারে বাংলাদেশ অংশের বিষয়টি উল্লেখ থাকে না।

৫. পুরো সিনেমার শুটিং ভারতীয় পরিচালকের নির্দেশেই হয়, তারপরও কোটা পূরণের জন্য এমন কয়েকজন বাংলাদেশী পরিচালকের নাম ব্যবহার করা হয় যারা কবে-কোথায় শুটিং হয়েছে সেটাই জানেন না বা জীবনে কোনদিন লাইট-ক্যামেরা-এ্যাকশনও উচ্চারণ করেন নি!!!

৬. এই ধরণের সিনেমাগুলোতে “দয়া করে” কয়েকজন বাংলাদেশী শিল্পীদের কাজ করতে “সুযোগ” দেওয়া হলেও তাদের বেশিরভাগ ক্যারেক্টার থাকে সামান্য ও গুরুত্বহীন।

৭. বাংলাদেশে অনেক ভাল মানের সংগীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী থাকলেও প্রায় সব ছবিতেই ভারতের শিল্পীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়।

৮. নিয়মানুযায়ী যৌথ প্রযোজনার সিনেমা দুই দেশে একই সময় মুক্তি পাবে। কিন্তু যে ছবিগুলোতে প্রধান চরিত্রে বাংলাদেশের কোন বড় শিল্পী থাকেন, ঈদ বা বড় উৎসবে বাংলাদেশে সে ছবি যথাসময়ে মুক্তি পেলেও তার অনেক পরে কলকাতায় মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। অনেকের ধারণা এতে ঠান্ডা মাথায় ভারতীয় প্রযোজকরা প্রমাণ করতে চাইছেন বাংলাদেশের তারকা শিল্পীদের মার্কেট ভ্যালু কলকাতার শিল্পীদের চেয়ে অনেক কম এবং বড় উৎসবে তাদের ছবি চালানো ঝুঁকিপূর্ণ।

৯. ভারতীয় অভিনেত্রীদের চেয়ে বাংলাদেশী অভিনেত্রীদের তুলনামূলক আপত্তিকর দৃশ্য বা চরিত্রে কাস্ট করা হচ্ছে। এবং অপেক্ষাকৃত খোলামেলা দৃশ্য বা পোশাকে কাজ করানো হচ্ছে।

১০. বেশকিছু সিনেমায় বাংলাদেশী নাগরিকদের ভাষা, ধর্মীয় ভাবাবেগ বা সংস্কৃতিকে ভুল বা বিকৃতভাবে তুলে ধরা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যা বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য আপত্তিকর ও লজ্জার ব্যাপার।

সমাধানের উপায়

কোন বিবেকবান লোক যৌথ প্রযোজনার নামে যৌথ প্রতারণা মেনে নেবেন না এটা যেমন সত্য, তেমনি এই বিশ্বায়নের যুগে আমার মত নগণ্য সিনেমাপ্রেমী থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের সিনেমা বিশেষজ্ঞরাও যৌথ প্রযোজনাকে অগ্রাহ্য করবে না এটাও সত্য। কারণ যৌথ প্রযোজনা অভিশাপ নয়, সঠিক নিয়মনীতি মেনে যৌথ প্রযোজনায় সিনেমা করলে উভয় দেশের জন্যই সেটা আশীর্বাদ। সমস্যা যেহেতু যৌথ প্রতারণা নিয়ে, আসুন দেখি সেটা কিভাবে নির্মূল করা যায়।

১. ২০১২ সালের সংশোধিত নীতিমালা বাতিল করে ১৯৮৬ সালের যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা পুনঃপ্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

২. বাংলাদেশী সিনেমার স্বার্থে সরকার তথা তথ্য মন্ত্রনালয়কে আরো তৎপর, নিরপেক্ষ ও যুগোপযোগী হতে হবে।

৩. শুধু যৌথ প্রযোজনার সিনেমার জন্য স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী প্রিভিউ ও রিভিউ কমিটি গঠন করতে হবে। যারা দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ বা নীতিমালা ভঙ্গের নজির পেলে উক্ত সিনেমার মুক্তি বাতিল বা স্থগিত রাখার ক্ষমতা রাখবে।

৪. রিমেক প্রথা বাদ দিয়ে মৌলিক গল্পে সিনেমা নির্মাণের প্রবণতা চালু করতে হবে। যাতে নিয়মের প্রয়োজনে নয় গল্পের প্রয়োজনে উভয় দেশের লোকেশন, শিল্পী ও কলাকুশলীদের নিয়ে সমহারে শুটিং হয়।

৫. বিশেষ কোন প্রোডাকশন হাউজ যেন বিপুল সংখ্যক সিনেমা হল নিজেদের জিম্মি করে রাখতে না পারে সে ব্যাপারে মনিটরিং করতে হবে।

৬. সরকারি ব্যবস্থাপনায় পার্শ্ববর্তী দেশের মত উন্নত ও যুগোপযোগী প্রযুক্তির যন্ত্রাদির যোগান, ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

৭. দেশ ও দেশের জনগণের ভাবমূর্তি বা ধর্মীয় চেতনায় আঘাত করে এমন সিনেমার জন্য কঠোর শাস্তিমূলক আইনের বিধান রাখতে হবে।

৮. শুধু খাতা-কলমে আইন মেনে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে কেউ যেন প্রভাব খাটিয়ে প্রতারণা করতে না পারে সে ব্যাপারে সাধারণ দর্শকদের মত সরকারকেও সোচ্চার থাকতে হবে।

৯. পশ্চিমবঙ্গের সাথে যৌথ প্রযোজনার বিকল্প হিসেবে বলিউড ও হলিউডের মত বাংলাদেশের দুই বা ততোধিক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নিজেদের মধ্যে যৌথ প্রযোজনায় বিগ বাজেটের আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা নির্মাণ করে বহির্বিশ্বে মুক্তি দিয়ে ভাল সফলতা ও বাজার পাবে বলে আশা করা যায়।

১০. সবচেয়ে বড় সমাধান মানুষের নৈতিকতা। আপনাকে দেশপ্রেমিক হওয়ার জন্য যুদ্ধের ময়দানেই যেতে হবে এমন কোন কথা নেই। নিজের স্বার্থকে ত্যাগ করে জেনেশুনে দেশের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকার নামও দেশপ্রেম। তাই কিছু টাকার জন্য দেশের সিনেমা তথা দেশের সম্মানের সাথে খেলা না করলেই একই সাথে আমাদের দুটো লাভ হবে। দেশপ্রেম ও দেশের সিনেমা রক্ষা।

শেষ কথা

শুধু এতটুকুই চাইবো যৌথ প্রযোজনা আমাদের দেশীয় সিনেমার দুই আনা লাভ করাতে না পারুক, এক আনা ক্ষতি যেন করতে না পারে; সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। আসুন ভালোবাসি নিজের দেশকে, দেশের মানুষ, দেশের সিনেমা ও সিনেমার সকল শিল্পী-কলাকুশলীদের। আপনার আমার হাত ধরেই পূর্ণতা পাক প্রাণের বাংলাদেশী সিনেমা।


মন্তব্য করুন