Select Page

রিভিউ : মেড ইন বাংলাদেশ

রিভিউ : মেড ইন বাংলাদেশ

(সম্প্রতি কানাডার টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে (টিআইএফএফ) প্রিমিয়ার হয়েছে রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত ‘মেড ইন বাংলাদেশ’-এর। এটি তার তৃতীয় চলচ্চিত্র। প্রদর্শনীর পর ছবিটির রিভিউ প্রকাশ হয় হাই অন ফিল্মস সাইটে। লিখেছেন বিদিতা জামান। সেই রিভিউটির ভাষান্তর বিএমডিবি পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।)

প্রথমে দৃশ্যপট বর্ণনা করা যাক। শুরুতে দেখা যায়, একজন ২৩ বছর বয়সী বিবাহিত নারী তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে রেডিমেড গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছে। তার মদ্যপ স্বামী কাজ খুঁজছে, ফলে তাকে সংসার চালানোর সকল খরচ বহন করতে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। সে তার কর্মক্ষেত্রে অবহেলিত, ঠিক সময়ে তার অতিরিক্ত সময় কাজের পারিশ্রমিক পাচ্ছে না, কিন্তু তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে এই ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে হচ্ছে কারণ সে এই কাজটি ছাড়তে পারছে না। সে মৌখিক ও শারীরিকভাবে নিপীড়িত এবং তার আশেপাশের সমাজ মনে করে তাদের এই নিপীড়ন করার অধিকার রয়েছে। তাকে এই সবকিছুর মধ্য দিয়েই বাঁচতে হবে কারণ সে মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে। এই দৃশ্যপট থেকে আপনি যদি কোন চিত্র এঁকে থাকেন, তবে আপনি রুবাইয়াত হোসেনের তৃতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এর কেন্দ্রীয় চরিত্র “শিমু”র সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছেন।

শিমুর জীবন পরিচালনার একটি অনন্য উপায় রয়েছে। সে নিয়মিত নামাজ পড়ার পাশাপাশি নাচতে পছন্দ করে এবং গার্মেন্টস কর্মীদের একত্র করে সংগ্রাম করে। সে এই ভাবেই তার নারীত্বের প্রকৃতিকে বুনন করে চলেছে। শিমু ও তার বন্ধুদের মাধ্যমে পরিচালক আমাদের দেখিয়েছেন যুব সমাজের ক্ষমতা এবং শিমু কীভাবে কর্মীদের আইনগত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ইউনিয়ন লিডার হয়েছেন। শিমুর বান্ধবী ডালিয়া ও রেশমারাও বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। গণমাধ্যমে নারীদের হাইপার সেক্সুয়ালাইজেশন বা ধর্মীয় চরমপন্থীদের দ্বারা অতিমাত্রায় একঘরেকরণ, নারীদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ার কারণে শিমু ও অন্যান্য মেয়েরা তাদের নিজেদের এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে নিয়েছে। তারা সমাজের বাঁধা-বিপত্তি থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখছে না এবং এই বাঁধা-বিপত্তিকে ভয় করছে না।

এরপর আমরা পরিচিত হয় “নাসিমা আপা”র সঙ্গে, যিনি একটি নারী অধিকার সংস্থায় কাজ করছেন। তিনি শিমু ও তার সহকর্মীদের কাছে বোনের মতো। তার সংস্থা নারী কর্মীদের নিয়ে কর্মী হিসেবে তাদের আইনগত অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে মিটিঙের আয়োজন করে। এতে দেখানো হয় বাংলাদেশের সামাজিক শ্রেণির গঠন এতই মজবুত যে নারীরা তাদের মধ্যে শ্রেণিগত বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও একে অপরের সাহায্য করছে।

রুবাইয়াত হোসেন এই চলচ্চিত্র নির্মাণের পূর্বে দীর্ঘ তিন বছর গবেষণা করেন। গল্পটি কিছুটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। শিমু চরিত্রটি ডালিয়া নামক এক নারী থেকে অনুপ্রাণিত, যিনি এই চলচ্চিত্র নির্মাণের পুরো সময় জুড়ে এতে জড়িত ছিল। নাসিমা আপার অফিসে শিমুর কথোপকথন মূলত ডালিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকার অবলম্বনে রচিত। ১২ বছর বয়সে পরিবার থেকে বিয়ের জন্য বাধ্য করা হলে ডালিয়া বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ঢাকা চলে আসেন। যদি বাড়িতে থাকতেন ও ভাগ্যকে মেনে নিতেন তবে তার ভবিষ্যৎ ভিন্ন কিছু হতো। তিনি প্রমাণ করতে পেরেছেন নারীর ক্ষমতায়নে কর্মসংস্থান কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

এই চলচ্চিত্রের একাধিক নারী কলাকুশলী ছিল, তথা পরিচালক বুঝাতে চেয়েছেন ক্যামেরার পেছনেও তিনি নারীর ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছেন। তিনি ‘রোসেটা’ এবং ‘নর্মা রাই’ চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এবং তিনি রিকশার রঙিন চিত্রাঙ্কন থেকেও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। চলচ্চিত্রে শহরের ছায়া ও অন্ধকারের মাঝ থেকেও অনেক রঙ ছড়িয়েছে। রুবাইয়াত হোসেন বলেন তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই চলচ্চিত্রে রঙ ও অন্ধকারকে পাশাপাশি রেখেছেন। রঙের এই বলিষ্ঠ ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি দর্শকদের কাছে রঙ ও শব্দের ব্যবধান তুলে ধরতে চেয়েছেন। এবং তিনি যেভাবে চেয়েছেন ঠিক সেভাবেই তা চিত্রায়িত করেছেন। চলচ্চিত্রটি আপনার সামনে রাজধানী ঢাকার নিম্নবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রা তুলে ধরবে। এখানে সর্বত্র ধুলা ও আবর্জনা বিদ্যমান। রয়েছে কোলাহল। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এখানে জীবনের অস্তিত্ব বিদ্যমান। ঢাকায় গল্পসমৃদ্ধ লোকজন রয়েছে এবং তাদের গল্পগুলোতে রঙের পরিপূর্ণতা রয়েছে।

‘মেড ইন বাংলাদেশ’ চলচ্চিত্রটি এক নারীকে অপর নারীর শর্তহীনভাবে সাহায্য করার গল্প। এটি একতা, বহুত্ববাদ ও নারীর একত্রিত হওয়ার গল্প। যখন কোন আশাই অবশিষ্ট থাকে না তখন নারীরা তাদের আওয়াজ তুলে এবং তারা তাদের চাওয়া-পাওয়াকে অর্জন করতে দৃঢ়-সংকল্প হয়। চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়েছে একজন নারী কতটা গভীরভাবে ভালোবাসতে পারে, তারা অপরের কতটা খেয়াল রাখে, তারা বন্ধুত্বকে কতটা গুরুত্ব দেয় এবং তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে কতদূর যেতে পারে। অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীরা একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন এবং তারা অবশ্যই সর্বোচ্চটাই দিয়েছেন। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ কেবল বাংলাদেশের নারীদের চলচ্চিত্র না, এটি কেবল নারী কর্মীদের চলচ্চিত্র না, এটি বিশ্বের সকল নারীদের চলচ্চিত্র।

‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ২০১৯ সালে টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়।

মেড ইন বাংলাদেশ
পরিচালক: রুবাইয়াত হোসেন
অভিনয়শিল্পী: রিকিতা নন্দিনী শিমু, নভেরা রহমান, দীপান্বিতা মার্টিন, পারভিন পারু, মায়াবী, মোস্তফা মনোয়ার
চিত্রনাট্য: রুবাইয়াত হোসেন, ফিলিপ ব্যারিয়ার
দেশ: বাংলাদেশ, ফ্রান্স
ভাষা: বাংলা
দৈর্ঘ্য: ৯৫ মিনিট


Leave a reply