Select Page

‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ ঠেকাতে মিডিয়ার ওপর খবরদারির আবদার

‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ ঠেকাতে মিডিয়ার ওপর খবরদারির আবদার

‘আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি। সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একটা লোকের উত্থান হয়েছে। যে উত্থান কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির উত্থান। এই উত্থান কীভাবে রোধ করা যাবে, এটা যেমন রাজনৈতিক সমস্যা, তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক সমস্যাও’— সম্প্রতি অভিনয় শিল্পী সংঘের একটি অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন নাট্য অভিনেতা ও নির্মাতা মামুনুর রশীদ বলেছেন।

পরে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মুক্তচিন্তার জন্য হুমায়ূন আজাদ প্রাণ দিয়েছিলেন। মুক্তচিন্তার আরও অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের মিডিয়া মুক্ত হওয়ার ফলে আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি। সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একটা লোকের উত্থান হয়েছে। যে উত্থান কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতি দ্বারা উত্থান। আজ আমাদের অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। কী সুন্দর রাস্তাঘাট হচ্ছে, মেট্রোরেল হচ্ছে, আমরা খুব মুগ্ধ। দেশের মানুষের কষ্টের অবসান হবে। কিন্তু দেশের মানুষের সংস্কৃতি ও রুচিই যদি ঠিক না করা যায়, এসব কে ব্যবহার করবে, তাই সংস্কৃতি ও রুচির উন্নয়নে কাজ করতে হবে।’

প্রসঙ্গটি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় টক অব দ্য টাউন। এক পক্ষ ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ নিয়ে মামুনুর রশীদের মন্তব্যের পক্ষে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ হিরো আলমকে উপলক্ষ্য করে এই বর্ষীয়ান নাট্য ব্যক্তিত্বের অবস্থানের সমালোচনা করছেন। এ প্রসঙ্গে নাট্যাঙ্গনের পরিচিত মুখদের অবস্থান মামুনুর রশীদের পক্ষে। তারাও অনেকটা মিডিয়ায় লাগাম পরানোর পক্ষে।

এমন তর্ক-বিতর্কের মাঝে জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীও বিশাল স্ট্যাটাস দিয়েছেন ফেসবুকে। সেখানে কারও নাম উল্লেখ না করেই বিষয়টি নিয়ে নিজের ভাবনা তুলে ধরেছেন তিনি। বলেছেন, ‘তথাকথিত কিছু অসৎ রাজনীতিবিদের কারণে যেমন রাজনীতি কলুষিত, তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনার বা আমার সমর্থনে গজিয়ে ওঠা ভাইরাল ব্যক্তিদের কারণে সংস্কৃতি কলুষিত হচ্ছে। এর জন্য অন্য কেউ দায়ী নয়। দায়ী আপনি বা আমি, দায়ী আমাদের নিম্ন মানসিকতা। আপনি কাকে অনুসরণ করবেন বা সমর্থন দেবেন বা কে হবে এই দেশে আপনার রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক আদর্শ, চূড়ান্ত ভাবনার এই সময়টুকুও বোধ করি পেরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো অবজ্ঞা করার মতো হলেও, আমাদের সন্তানেরা ভবিষ্যতে অনুসরণ বা শ্রদ্ধা করার মতো কাউকে পাবে না। পরিচিত হতে হবে আপনার রুচিতে জন্ম দেয়া কোনো ভাইরাল বিনোদন ব্যক্তির উত্তরসূরি হিসেবে। কারণ আপনি বা আমি ঠিক-বেঠিক বা উচিত-অনুচিতের পার্থক্য ভুলে সস্তা বিনোদন প্রিয় জাতিতে পরিণত হয়ে গেছি। বুঝতে পারছেন কি, সামনে কতটা অন্ধকার?’

টেলিভিশনের কমেডি নাটক থেকে জনপ্রিয় হওয়া এই অভিনেতাও এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের সাফাই গাইলেন তার পোস্টে। চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ঘাড়ে চেপে যখন অবাধে অসামাজিক কার্যকলাপ চলতে থাকে, তখন আমরা অধিকাংশ মানুষই শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করি। এটি এখন আমাদের ব্রেনের ওপর বিষফোঁড়াসম সমস্যায় পরিণত হয়েছে। আমরা বাক্‌স্বাধীনতার কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলি, অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অধিকাংশ মানুষ স্বেচ্ছাচারীর মতো যা খুশি করছেন, যা ইচ্ছা, বলছেন। প্রশ্নটা এখানেই…

আধুনিকতা আর সম–অধিকারের ঝান্ডা তুলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপনি কি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার করছেন না? আপনার অরক্ষিত এই কার্যকলাপে সমাজ বা নতুন প্রজন্ম কতটুকু প্রভাবিত হচ্ছে, সেটুকু ভাবার অবকাশ কি আপনার আছে? আপনি কি সত্যিই সমাজের জন্য মঙ্গলজনক কিছু করছেন? ছোটবেলায় পড়তাম বিজ্ঞান “আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ? ” বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারই এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঠিক ব্যবহারই হয়তো জাতির জন্য ভালো ভূমিকা রাখতে পারত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো রাখেও। কঠিন সত্য এটাই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বর্তমানে যতটা না সামাজিক কর্মক্ষেত্র, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ব্যক্তিগত বাণিজ্য ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ফেসবুকে “রিল” নামক একটি বিষয় আছে। এখানে অধিকাংশই যে কতটা অশ্লীল, ভাবতেও অবাক লাগে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এসব অশ্লীলতার বিরুদ্ধাচরণ করি। সেন্সরবিহীন এসব অশ্লীল কার্যকলাপ কে বন্ধ করবে?

এখানে রাষ্ট্রের যথাযথ কর্তৃপক্ষের বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা কি আমরা আশা করতে পারি না? সেই সঙ্গে আপনার বা আমার অসচেতনতা অথবা সমর্থনের ভেতর দিয়ে তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জন্ম নিচ্ছে বিতর্কিত কিছু ভাইরাল ব্যক্তি। তিনি যখন আপনার কাছে পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব দাবি করবেন, আপনি কি অস্বীকার করতে পারবেন? পারবেন না…কারণ আপনার বালখিল্য আচরণ, উদাসীনতা আর সস্তা বিনোদনপ্রিয়তায় আপনি সেই সন্তানকে জন্ম দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আপনার অরক্ষিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারই এর জন্য দায়ী।’

টিভি নাটকের সিরিয়াস নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল বলেছেন, “রুচির দুর্ভিক্ষ’ নিয়ে মন্তব্য করায় কিছু মানুষ দেখলাম শ্রদ্ধেয় মামুনুর রশীদের ওপর বেজায় চটেছেন। তবে এই দুর্ভিক্ষের দায় মামুনুর রশীদের মতো সামনের সারিতে থাকা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ কতটা এড়াতে পারেন, সেটাও এক বিরাট প্রশ্ন! ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ কথাটা প্রথম বলেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সেই ৭০-এর দশকে। সেই সময়ে বসে তিনি এটা অনুভব করতে পেরেছিলেন, এখন বেঁচে থাকলে এই সময় নিয়ে তিনি কী ভাবতেন কে জানে!”

এই নির্মাতার মতে, ‘যারা এমন নায়ক তৈরি করে নিয়েছেন; তার এবং পরবর্তী প্রজন্মের পথ প্রদর্শক কিন্তু এরাই। কারণ বিষয়টা নিছক বিনোদনে আর আটকে নেই। এই ব্যক্তি কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলে তাকে নিয়ে মির্জা ফখরুল আর ওবায়দুল কাদেরকে পাল্টাপাল্টি মন্তব্য করতে দেখা যায়! ফলে নিশ্চিতভাবেই এই সময়ের একটা বিরাট জনগোষ্ঠী এই ব্যক্তিকে নায়ক হিসেবে বেছে নিয়েছে। আমার সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য জানি না- আমি নায়ক হিসাবে পেয়েছি মাস্টার দা সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম, জহির রায়হান, জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতান, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মত অসংখ্য বাতিঘরকে।’

নির্মাতা এস এ হক অলিকের আক্ষেপ, বিষয়টি নিয়ে নাট্য অঙ্গনের সংগঠনগুলো কেন কিছু করছে না। তার ভাষ্য, “রুচির দুর্ভিক্ষ’ উল্লেখ করায় এফটিপিও-এর সভাপতি, নাট্যজন মামুনুর রশীদ আঙ্কেলকে নিয়ে নানা ধরনের কথা হচ্ছে, সমালোচনা হচ্ছে, ট্রল হচ্ছে। অথচ সংগঠনগুলো থেকে কোনও বিবৃতি নেই! (আমার চোখে পড়েনি)। হায়রে… রুচির দুর্ভিক্ষ!’’

এ সময় রুচি-কুরুচি নিয়ে আক্রমণের শিকার নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বিষয়টিকে কৌতুকে রূপ দিলেন। বললেন, ‘আপনারা কি নিশ্চিত এটা স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানির একটা সিডিং মার্কেটিংয়ের অংশ না? আমার তো মনে হয় স্কয়ার তার রুচি ব্র্যান্ডের জন্য একটা সাকসেসফুল সিডিং মার্কেটিং করিয়ে নিলো আপনাদের সবাইকে দিয়ে।’

চিত্রনায়ক ওমর সানীও মামুনুর রশীদকে খোঁচা মারলেন। তার বক্তব্য, ‘শুধু আলমের নাম নিলেন বড় ভাই মামুনুর রশীদ। এরকম তো সংগীতে আছে, অভিনয়ে আছে, কলাতে আছে, লেখনীতে আছে, রাজনীতির মঞ্চে আছে; ওনাদের নাম নিতে ভয় লাগে। শুধু পেয়েছেন মাটির গন্ধওয়ালা হিরো আলমকে। আর ওনারা আতর মাখে তাই নাম নেননি বড় ভাই (স্যার)।’

নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিনও মন্তব্য করতে ছাড়লেন না। তিনি বলেছেন, ‘রুচির দুর্ভিক্ষ আচমকা আকাশ থেকে পড়ে না। প্রথমে খরায় বা বন্যায় রুচির উৎপাদন নষ্ট হয়। তারপর শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। খরা এবং বন্যা মূলত তৈরি করে তারাই, যারা রুচির চাষ করে। তাদের তখন যথেষ্ট সময় নেই রুচি উৎপাদনের জমিকে উর্বর রাখার, তারা ব্যক্তিগত গোলার ফসল নিয়েই বা সাফল্য নিয়েই তখন তৃপ্ত।’

এদিকে লেখক সৈয়দ ফয়েজ আহমেদের বক্তব্য, ‘মামুনুর রশীদ যেটা বুঝেন নাই তা হচ্ছে উনারা আর রুচির সোল এজেন্ট নাই।

টেলিভিশন চ্যানেল আর পত্রিকার পাতায় সময় ও স্পেস সীমিত। সেইটা কার দখলে থাকবে এই নিয়েই চলতো কালচারের পলিটিক্স। সেই আদিকাল থেকেই।

অনলাইন সে সীমাবদ্ধতা ঘুচায়ে দিসে। রশীদরা সেই স্পেস ডমিনেট করতে পারেন না। কালচারাল ওয়ারের খোলনলচে পাল্টায়ে গেছে।

আলম অভিয়াসলি একটা গিমিক। বেসুরো গলায় ভাড়ামি করাকে যতোই মহিমান্বিত করা হোক একে শিল্প হিসেবে দেখার সুযোগ নাই।

তবে মজাটা অন্য।  গত তিন দশকে বাংলাদেশে কালচারাল এলিটরা জনগণের পক্ষে কথা বলেন নাই। একাত্তর ও এর পরের অর্জন বেচে সেফ সাইডে থেকে বিলাসবহুল জীবন কাটাইসে। ইন্ডিভিজুয়ালী শিল্পের এস্থেটিক্স যাই হোক, কালচারাল পলিটিক্সে ডমিনেন্স রাখতে জনতার শ্রদ্ধা লাগবেই। রশিদরা সেইটা হারাইসেন। ফলে, উনার আলাপ আগের মতো শ্রদ্ধা পায়না।

শুধু তাইনা, গ্রাজে থাকা পাবলিক স্পেস পেয়ে তাদের নিয়ে মক করবেই।এইখানে আলম কোন ইসুই না। ইনফ্যক্ট ব্যাক্তি রশীদও না। পাবলিকের ক্ষোভ শিল্পের নামে ধামাধরাদের বিরুদ্ধে।‘

কবি ও চিন্তক ব্রাত্য রাইসু তার দীর্ঘ লেখায় বলেন, “মামুনুর রশীদ সাহেবের হিরো আলম বিরক্তি অথবা সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ কাকে বলে ~

রবিবার ২৬ মার্চ দুপুর বেলায় সুরুচি ও সুসংস্কৃতির পত্রিকা প্রথম আলোরে নাটকের পারসোনালিটি মামুনুর রশীদ জানাইছেন তিনি হিরো আলমরে নিয়া বিরক্ত।

অনেক দিন ধইরাই বিরক্ত। তার কথায়, “এই হিরো আলম নিয়ে আমি অনেক দিনই বিরক্ত ছিলাম। বিরক্ত ছিলাম এই কারণেও, আমাদের দেশের মানুষের তো রুচির দুর্ভিক্ষ হয়ে গেছে।”

তিনি পিআলোকে বলেন:

আমাদের মিডিয়া মুক্ত হওয়ার ফলে আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি। সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একটা লোকের উত্থান হয়েছে। যে উত্থান কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতি দ্বারা উত্থান।”

তিনি আরো বলেন:

“আমাদের রাষ্ট্র তো কোনোভাবে রুচির উন্নয়নে কাজ করছে না। তাই এখন আমার আর রাজনীতির কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, সংস্কৃতির কাছে, কোথাও আবেদন-নিবেদন নেই। আমার আবেদন, যে মানুষগুলো সামাজিক কাজের প্রতি দায়বদ্ধ, তাঁদের প্রতি।”

এইখানে মামুনুর রশীদ সততার পরিচয় দিছেন। রুচি যেহেতু আপেক্ষিক তাই তার কাছে হিরো আলম ধরনের লোকেদের রুচিকে কুরুচি ও অপসংস্কৃতি মনে হইতে পারে। সেইটা মামনুর রশিদ সাহেবরে বলতে দিতে হবে।

আবার কারো কাছে মনে হইতে পারে, সেইটা হিরো আলমের কাছেও মনে হইতে পারে, মামুনুর রশীদের যেই রুচি ওইটাই কুরুচি ও অপসংস্কৃতি। হিরো আলমরেও সেইটা বলতে দিতে হইবে।

বাক স্বাধীনতার চর্চা এইভাবেই হয়। এইটা স্বাস্থ্যকর।

কিন্তু এতে একটা কিন্তু আছে।

২.

কিন্তুটা হইল এই যে, দুই পক্ষের বলাবলির মান সমান নয়। একটা বলায় সমস্যা আছে।

সমস্যা এই জায়গায় যে একপক্ষ, মামুনুর রশীদদের পক্ষের এই বলাটা জাস্ট বলা নয়। এইটা নালিশ।

সরকার ও প্রশাসনের সাহায্য লইয়া অপর পক্ষের কথিত কুরুচি ও অপসংস্কৃতি বন্ধ করার নালিশ এইটা।

মামুনুর রশীদ সাহেবের “আমাদের মিডিয়া মুক্ত হওয়ার ফলে আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি” নামক বাক স্বাধীনতাটি কীভাবে ফ্যাসিবাদ কায়েমের রাজনীতি সেইটা বরং বলি।

৩.

রশীদ সাহেব মিডিয়ার “মুক্তি”রে দোষারোপ করতে শুরু করলেন। মিডিয়ার সরকার তোষণ বা বাকহীনতা নিয়া তার কোনো আলাপ নাই। তিনি পইড়া আছেন হিরো আলমরে নিয়া!

হিরো আলমের নিউজ ছাপানোরেই তিনি মিডিয়ার মুক্তি ধইরা এরে হিরো আলমদের উত্থানের জন্যে দায়ী করতেছেন। এর মাধ্যমে এক ঢিলে দুই পাখি মারতেছেন তিনি।

প্রথম পাখিটি: এই দেশের মিডিয়া যে আসলে মুক্ত না সেই সত্যরে চাপা দিতেছেন। তিনি দেখাইতেছেন মিডিয়া মুক্ত।

দ্বিতীয় পাখিটি: হিরো আলমদের নিউজ ছাপানো বন্ধ করতে চাইতেছেন তিনি।

অর্থাৎ মিডিয়ার উপরে রাজনৈতিক যে সেন্সরশিপ তা তার জন্যে যথেষ্ট না, এখন দরকার সংস্কৃতি বিষয়ক সেন্সরশিপ। হাঃ হাঃ।

ভাবা যায়?

৪.

ফ্যাসিবাদ এইভাবেই কাজ করে। সাংস্কৃতিক খবরদারি ফ্যাসিবাদী নর্দমাগুলির একটা। মামুনুর রশীদ সাহেব সরসরি সেই খবরদারির আহ্বান জানাইলেন প্রথম আলোর ফ্যাসিবাদী সাংবাদিকতার মারফতে।

মামুনুর রশীদের মারফতে প্রথম আলো পত্রিকার কুরুচি ও অপসংস্কৃতি ঠেকানোর আহ্বান মূলত একটা হুমকি, এই হুমকি তথাকথিত ‘কুরুচি’ ও ‘অপসংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে সরকার ও তাঁবেদার বাহিনী ব্যবহারের হুমকি।

দেখতে হবে কখন এই হুমকি গলা বড় করতে শুরু করল?

তা ঠিক এই সময়টায়ই বা কেন?

৫.

এতদিন সাংস্কৃতিক জগতের মোড়লিপনা কিছুটা অফ আছিল। তাদের গরম গরম আওয়াজ তেমন চোখে পড়ে নাই।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বগণের আওয়ামী রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত না হওয়ার নিরপেক্ষতাগিরির কারণে সরকার তাদেরকে সম্ভবত পাত্তা দিত কম।

কিন্তু সরকারের জন্যে সুখের কথা হইল, তারা এখন রাজনৈতিক ভাবে সাড়া দিতে শুরু করছেন!

আপনারা জানেন সম্প্রতি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি লইয়া মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট একটা প্রতিবেদন দিছে। এই প্রতিবেদন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’কে “বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ” করছে। তারা এই প্রতিবেদনের নিন্দা জানাইছেন।

এই নিন্দায় কিছু হউক না হউক সরকারের সুনজরে তারা আরো বেশি কইরা আসতে শুরু করছেন। এবং নিন্দাকারীদের সিংহভাগই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তারা কালচার করেন।

যতদূর বুঝি, রাজনৈতিক সমর্থন দানের কাজ জোরেশোরে শুরু করার কারণে সামনে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের মালিকানা পাইতে যাইতেছে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’।

কালচারওয়ালারা এই সুযোগ হেলায় হারাইতে রাজি হবে কি?

হবে না।

মালিকানা হস্তগত হইলে কালচারাল অঙ্গনের বেশ কিছু পয়েন্টে নিজেদের পছন্দ মাফিক বদল ঘটাইতে পারবেন তারা। আওয়ামী সরকার তাদের অনুরোধগুলিরে কাজে পরিণত করতে রাজি হবে। তাতে রুচি ও সংস্কৃতি বিষয়ে নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে সরকার!

যেহেতু “সরকার এখন তাদের কথা শুনবে” ধরনের একটা মিষ্টি পরিবেশ তৈরি হইতে শুরু করছে তাই তারাও সরকারের কাছে তাদের সুন্দর সুন্দর দাবিগুলি তুইলা ধরতে শুরু করছেন।

বেশ একটা বিয়েবাড়ি ধরনের অবস্থা।

সুরুচি ও সুসংস্কৃতিরা হয়ত ভাবছেন তাদের কালচারাল দুর্দশার কারণ হিরো আলম। নাইলে তারা কত কিছু করতে পারতেন!

আমরাও সানন্দে দেখতে থাকি, তারা কী কী কিছু করতে পারেন?”

জয়নুল আবেদীর সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ তুলে ধরে লেখক তুহিন খান ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন’ শিরোনামে লেখেন—

১.

রুচির দুর্ভিক্ষে হিরো আলমের উত্থান’ কথাটা বলে বেশ বেকায়দায় আছেন ‘নাট্যজন’ (ওনার নামের আগে এই টাইটেলটা বেশ যায়, খেয়াল করলাম) মামুনুর রশীদ। কিন্তু ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’র আইডিয়াটা বা এই শব্দবন্ধটা আসল কোত্থেকে?

তখন ১৯৭৪ সাল। যুদ্ধপরবর্তী বাঙলাদেশে চলছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। তো, এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চলাকালীন ১৯৭৪ এর ১০ মার্চ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম একটা ইন্টার্ভিউ নেন আমাদের একজন জাতীয় অধ্যাপক (১৯৭৫-এ হইছেন) শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের। সেই ইন্টার্ভিউতে জয়নুল বলতেছেন: ‘আমি বারবার বলি, আমাদের বর্তমান দুর্ভিক্ষ ততটা নয়, যতটা রুচির দুর্ভিক্ষ। একে দূর করতেই হবে।’

২.

কথাটা ঠিক কোন প্রেক্ষাপট সামনে রাইখা বলছিলেন জয়নুল, তা কিছুটা অস্ফুট, আবছা। জয়নুল বৃটিশ ভারতেই নাম করছিলেন ছবি আঁইকা। স্বাধীন বাঙলাদেশে জয়নুল কেন ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ দেখলেন? সেটা কি আগে, পাকিস্তান বা বৃটিশ আমলে ছিল না বা কম ছিল? বা তখন জয়নুল নিজেরে পাকিস্তানি বা বৃটিশ ভারতীয় ভাবতে পারতেন, তাই ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ কম কম লাগত; কিন্তু স্বাধীন বাঙলাদেশে যেহেতু তার শিল্পসত্তা অনেক সীমিত হয়ে গেল, মহাভারতীয় বা পাকিস্তানি থেকে তিনি নিছক ‘বাঙলাদেশি’ হয়ে পড়লেন, সেহেতুই কি তার এই রুচির আক্ষেপ? জয়নুল কি বাঙলাদেশের লোকেদের শিল্পরুচি বা শিল্পবোধ কখনো তলিয়ে দেখছেন? নাকি নিজের ‘রুচি’ই কেবল চাপাইতে চাইছেন তাদের উপর, ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ শিরোনামে?

একটু পরেই ওই ইন্টার্ভিউতেই জয়নুল বলতেছেন: ‘হয়তো অর্থনৈতিক দারিদ্র্য এবং রুচির দারিদ্র্য সমান্তরালভাবে অগ্রসর হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের সংগ্রাম ওই উভয় দারিদ্র্যের বিরুদ্ধেই হওয়া উচিত।’ বোঝা যায়, জয়নুল দেশের অর্থনৈতিক গরিবিরেই ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’র কারণ ভাবছিলেন। যার টাকা কম, তার রুচি খারাপ হয়— সেজন্যেই বোধহয় কম টাকাওয়ালা গরিব বাঙলাদেশকে তার ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’পীড়িত মনে হইছে।

কিন্তু, জয়নুল থেকে মামুনুর রশীদে এসে আমরা দেখতেছি— মামলাটা স্রেফ টাকা কম-বেশি হওয়ার না; মামলাটা ক্লাশেরও, মামলাটা কালচারাল আধিপত্যেরও, সার্টেইন কিছু কালচারাল নির্মাণরে মানা/না মানারও। হিরোর টাকা আছে ম্যালা; কিন্তু টাকা তারে ক্লাশ দিতে পারে নাই, বা ছায়ানটের আদর্শে দীক্ষা দিতে পারে নাই, এখনও। জয়নুল বাঁইচা থাকলে তারে কোশ্চেন করা যাইত যে: আজ তো দেশে অনেক টাকা, মধ্যম আয়ের দেশ আমরা, হাই জিডিপি— আজও কেন রুচির এই দুর্ভিক্ষ, হে আচার্য?

৩.

মজার ব্যাপার দেখেন, জয়নুল আর মামুনুর রশীদের এই বক্তব্য দেওয়ার প্রেক্ষাপট খুব সাদৃশ্যময়। তখন ১৯৭৪, ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেশে, বাট জয়নুলের বিচারে এরচেয়েও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হইল রুচির।

মানে, ভাত পাবা কি পাবা না, তারচাইতে বড় প্রশ্ন হইল তোমার ‘রুচি’ ঠিক করা লাগবে। ‘চেতনা’ ঠিক করা লাগবে। এই ‘রুচি’ আবার ক্লাশ, রেস, আইডেন্টিটি, কোলকাত্তাই শিল্প ও সাংস্কৃকৃতিক মানসসহ হাজারটা শর্ত দিয়া ঘেরা; সর্বোপরি ‘মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী চেতনা’ দিয়া মোড়ানো। এই রুচি কীভাবে হাসিল করবে পুব বাঙলার মাছ খাওয়া গরিব বাঙাল? ফলে ৫০ বছরেও রুচি ঠিক হয় নাই। ৫০ বছর পর আবারও দুর্ভিক্ষের মুখে জাতি; কিন্তু মামুনুর বলতেছেন, রুচির দুর্ভিক্ষটাই আশল সমস্যা।

৪.

এই ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ কাদের? আমাদের নিশ্চয়ই! এই দেশের মানুশের নিশ্চয়ই। শাসকের অপশাসনে তৈরি দুর্ভিক্ষের সমালোচনা করতে না পাইরা, মানুশের ঘাড়ে ধার করা ‘রুচির বোঝা’ চাপায়ে দিয়া তাদেরই ভিলেন বানানোর বড় উদাহরণ এই বক্তব্য। ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ মানে, দেশে রুচিশীল লোক নাই। এই ‘রুচি’টা কী, ভাবছেন কখনো? কারা এই ‘রুচি’র কন্ট্রাক্টর? এই ‘রুচি’র গোড়া হাতাইতে গেলে দেখবেন, এই ‘রুচি’ আশলে বৃটিশ ভারতের কোলকাতাজাত ছায়ানটি বাঙালি জাতিবাদী, বিপ্লবের ফলস কনশাসনেসে ভোগা সাম্প্রদায়িক বাকশালি বাম ও পাকিস্তানমুগ্ধ ‘নিও আশরাফ’ বাঙলাদেশিদের একটা যৌথ সাংস্কৃতিক নির্মাণমাত্র। আর এই ‘রুচি’র অভাবের দোহাই দিয়াই এদেশের মানুশের উপর হওয়া হাজারটা জুলুম জায়েজ করা হইছে, হয়৷

এই রুচিমনস্করা দেশের মানুশের অর্গানিক রুচিরে ধইরা আগান নাই। ওই রুচিরে একটা শক্তিশালী সাংস্কৃতিক নির্মাণে পরিণত করতে পারেন নাই। দেশের মানুশের কালচারাল রুহটারে নার্চার করে জাতীয় সংস্কৃতি বানাইতে পারেন নাই। উলটা কিছু আমদানিকৃত রুচির বোঝা চাপাইছেন, যা আজ ক্লিশে, মৃতপ্রায়। এই ‘রুচি’র নামে তারা মূলত এদেশে শ্রেণীঘেন্না ছড়াইছেন, উনিশ শতকী কোলকাতার সাম্প্রদায়িক চিন্তারে উস্কে দিছেন, সর্বোপরি, দেশের মানুশের অর্গানিক কালচাররে খুন করছেন। সিনামার কথাই ধরেন! ‘অশ্লীল’ ‘অশ্লীল’ রব তুইলা এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আয় করা সিনামা ‘বেদের মেয়ে জোসনা’রেও কোনঠাসা করা হইছে। ‘অশ্লীল সিনামা’র বিরুদ্ধে ওই রুচিশীলতার সর্বোচ্চ গন্তব্য কী হইছে? দেশে বলিউডি সিনামা নামানো।

৫.

জয়নুলের ব্যাপারটা অবশ্য বেশ মজার। লোকটা বিখ্যাতই হইছেন দুর্ভিক্ষ নিয়া ছবি আঁইকা। কিন্তু কোন দুর্ভিক্ষ? ১৯৪৩ সালে বৃটিশ ভারতে হওয়া ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, যা ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে খ্যাত, সেই দুর্ভিক্ষ নিয়া সিরিজ ছবি আঁইকা বেশ খ্যাতি কামাইছিলেন উনি৷ কিন্তু ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ নিয়া জয়নুলের কোন সিরিজ ছবি আছে? বা অন্তত একটা স্কেচ? আমি জানি না। মানে থাকলেও, তা আজ কোথাও নাই, আমরা দেখি না। সম্ভবত দেশের লোকেদের ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ই জয়নুলের মত সৃজনশীল প্রতিভারেও মারাত্মক প্রভাবিত করছিল। তাই দুর্ভিক্ষ নিয়া ছবি আঁইকা খ্যাতি পাওয়া জয়নুল, এই দেশের মানুশের দুর্ভিক্ষ নিয়া কোন ছবি আঁকতে পারেন নাই। সেসময় খাবারের দুর্ভিক্ষের বদলে ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’রেই বেশি খারাপ মনে হইছিল তার। হয়ত জয়নুল ভাবছিলেন, যে দেশে রুচির দুর্ভিক্ষ, সেখানে খাবারের দুর্ভিক্ষ নিয়া ছবি আঁইকা লাভ কী!”

এদিকে মামুনুর রশীদের মন্তব্যটি ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে হিরো আলমও প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। ফেসবুক লাইভে এসে তিনি বলেছেন, ‘আমি নিজ যোগ্যতায়, নিজে পরিশ্রম করে আজ আলম থেকে হিরো আলম। আমাকে নিয়ে যাদের রুচি হয় না, সেই রুচিবান লোকেরা হিরো আলমকে তৈরি করেননি। এ জন্য রুচিবানেরা বাংলাদেশে রুচি আনতে চাইলে হিরো আলমকে মেরে ফেলে দেন।’


Leave a reply