Select Page

শাকিব খানকে বয়কট, লাভবান হবে কে?

শাকিব খানকে বয়কট, লাভবান হবে কে?

পরিচালকদের বেকার বলেছেন শাকিব খান। এতে চলচ্চিত্র পরিচালকদের সম্মানহানী ঘটেছে। তারা শাকিবকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন এবং বয়কট করার ঘোষনা দিয়েছেন। শাকিব খান যতই যৌথপ্রযোজনার পক্ষে কথা বলুক, পরিচালকদের হুমকীতে ঠিকই ভয় পেয়েছেন। নিজেকে সালমান শাহের মত ষড়যন্ত্রের শিকার বলে নিজের পক্ষে জনমত নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। কাহিনীর জল এ পর্যন্ত গড়িয়েছে। এই জল শীঘ্রই থামবে বলে মনে হচ্ছে না আবার হুট করে থেমেও যেতে পারে। যাই ঘটুক, প্রশ্ন হল, শাকিব খানকে বয়কট করে পরিচালকরা আদৌ লাভবান হচ্ছেন কিনা কিংবা কতটুকু হচ্ছেন।

এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সামান্যা আলোকপাত করা প্রয়োজন। পূর্বাপর ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে – শাকিব খানের ‘বেকার’ শব্দোচ্চারণ ছিল বদিউল আলম খোকনের কোন এক বিবৃতির জবাব। প্রথম আলোতে দেয়া সাক্ষাতকারে শাকিবের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল – ‘আপনাদের বিয়ে-সন্তানের বিষয়টি এভাবে গণমাধ্যমে আসাটাকে অনেকে নাটক মনে করছেন। কী বলবেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরেই শাকিব খান পরিচালকদের বেকার আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন,

এখন যেহেতু বেশি সিনেমা হচ্ছে না, তাই বেকার লোকের সংখ্যাও একটু বেশি। পরিচালক সমিতির তালিকা দেখবেন, অনেক পরিচালক। তাঁরা এফডিসিতে আড্ডাও মারছেন। কিন্তু কাজ করছেন কতজন? প্রযোজকের ক্ষেত্রেও দেখবেন একই অবস্থা। শিল্পীদের ক্ষেত্রেও তা-ই। অনেক শিল্পী তো নিবন্ধিত আছেন, কাজ করছেন কতজন? শত শত লোকের দিকে না তাকিয়ে দেখতে হবে, এই শিল্পের ভালো লোকেরা কী বলছেন। সফল মানুষেরা কী বলছেন। আজকে ৬০০ শিল্পী কী বললেন, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। কিন্তু রাজ্জাক, আলমগীর, ফারুক, সোহেল রানা, ববিতা, কবরী, শাবানা যখন কথা বলবেন, তখন তাঁদের বিষয়টা গ্রহণযোগ্য। আমার কাছে মনে হয়, এই দেশে এক নম্বর হওয়াটা একটা যন্ত্রণার ব্যাপার। এক দিন বা দুই দিনের জন্য হলে ঠিক আছে, কিন্তু দীর্ঘদিন প্রথম স্থান ধরে রাখলে তখন শত্রুর অভাব হয় না। ব্যাপার না, আমাদের নাম–বদনাম দুই-ই নিয়ে চলতে হবে।

তার এই মন্তব্যের জবাবেই পরিচালক সমিতির সভাপতি বদিউল আলম খোকন উকিল নোটিশ পাঠান। উকিল নোটিশ পাঠানো কিংবা শাকিবের বিরুদ্ধে পরিচালক-প্রযোজক-চলচ্চিত্র শিল্পীদের একত্রিত অবস্থান যে ষড়যন্ত্র তা শাকিব খান জানান মানবজমিনকে। তার উত্তরটি কোট করছি –

আমি নিজেও তো একজন শিল্পী, একজন প্রযোজক। আমি কাউকে উদ্দেশ্য করে তো একথা বলিনি। বর্তমান সিনেমার সামগ্রিক বিষয় নিয়ে এ কথা বলেছি। কিন্তু আমাকে নিয়ে কেন এই চক্রান্ত করা হচ্ছে। অনেকদিন ধরেই বদিউল আলম খোকন আমার বিষয়ে নানা কথা বিভিন্ন পত্রিকায় বলছেন। আমরা একসঙ্গে অনেকদিন কাজ করেছি। তাই বিষয়টি আমি এতদিন আমলে নেইনি। কিন্তু আর না। সকল প্রযোজক তো বলছেন, একটা হিরো দিয়ে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি চলছে। আর সেই হিরোকে নিয়ে ষড়যন্ত্র। এটা আমার কথা না। সব শিল্পী ও প্রযোজক একত্রিত হয়ে গেছে। এ হট্টগোলের কারণে শিল্পী সমিতির নির্বাচন আপাতত স্থগিত করা হবে। বদিউল আলম খোকন ব্যক্তিগতভাবে আমার ওপর ক্ষোভ নিয়ে এসব করছেন। আমি এখন শিল্পী সমিতির সংবিধান অনুযায়ী রানিং প্রেসিডেন্ট। যে কোনো রকম হট্টগোলে নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট রুল জারি করতে পারবে। এটা আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট লেখা আছে। এখন আর নির্বাচন স্থগিত করা ছাড়া আমার উপায় নেই। আমি এখন প্রয়োজনে রুল জারি করবো।

শাকিব খানের এ অভিযোগ মিথ্যা নয়। বদিউল আলম খোকনের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে আরও প্রায় বছরখানেক আগে। ২৬ এপ্রিল তারিখে ডেইলি স্টার পত্রিকায় শাকিব জানান,  

গতবছর খোকন সাহেবের একটি ছবির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম। ব্যস্ততার কারণে শিডিউল দিতে পারিনি। কিছুদিন অপেক্ষা করতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি অনুরোধ না শুনে রেগে গেলেন। আমাকে নিয়ে নানা জায়গায় বাজে কথা বলতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি পরিচালক সমিতির ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। আমিও শিল্পী সমিতির সভাপতি। ইন্ডাস্ট্রির শিল্পীরা আমার সঙ্গে রয়েছেন।

শাকিবের এ উক্তির সাথে মিলে যায় গত বছরের ৩০ নভেম্বর তারিখে প্রকাশিত  বিডিনিউজের একটি রিপোর্টে। সেখানে বদিউল আলম খোকন শাকিব খানকে নিয়ে আর সিনেমা নির্মান করবেন না বলে জানান। বদিউল আলম খোকন বলেছিলেন, 

শাকিব খান এখন বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের সিনেমাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। তার মতে বাংলাদেশের কলাকুশলীরা ভালো কাজ করতে জানেন না। ভারতের কলাকুশলীরা আমাদের কলাকুশলীদের তুলনায় ভালো কাজ জানেন। শুধুতাই নয় বাংলাদেশে নাকি কোনো ভালো কলাকুশলীই নেই!
খোকনের এ মন্তব্যটি অবশ্য শাকিব খানের একটি মন্তব্যের জবাব। এই সাক্ষাতকার প্রকাশের কিছুদিন পূর্বে শাকিব খান এদেশের কলাকুশলীরা যথেষ্ট কুশলী নয় – এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেছিলেন। ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে শাকিব খান চোরাচালানের মত ভারতীয় সিনেমা আমদানী করছেন – খোকনের এমন অভিযোগও পাওয়া যায়।

শাকিব খান যৌথ প্রযোজনার ছবিতে সময় বেশি দিচ্ছেন – কথাটি মিথ্যে নয়। একসময় শিল্পী সমিতির সভাপতি হিসেবে কাফনের কাপড় পরে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির বিপক্ষে আন্দোলন করলেও একই পদে আসীন অবস্থায় ভিন্ন বোতলে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানী প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছেন তিনি। মাঝখানে আখের গুছিয়েছেন। বাংলাদেশের গন্ডি ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় পৌঁছেছেন তিনি, হয়তো তুলনামূলক বেশি আয়ও করেছেন। তার এই ব্যস্ততা স্বাভাবিকভাবেই এ দেশের পরিচালকদেরকে উদ্বিগ্ন করবে। শাকিব নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মান করতেন যারা তাদের মধ্যে  বদিউল আলম খোকন এক নাম্বার, শাকিব খানের ব্যস্ততায় সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্থও তিনিই হবেন / হয়েছেন। অন্য পরিচালকরা যারা  শাকিব নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মান করতেন না তারা যে শাকিব-বিদ্বেষ থেকে বিরত থেকেছেন তা নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের প্রযোজকদের দৌড় বিভিন্ন নায়িকা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল, শাকিব পর্যন্ত পৌছানোর ক্ষমতা ছিল না। গত এক দশকে শাকিব খান ছাড়া কয়টি সিনেমা ব্যবসা সফল হয়েছে তার তালিকা করলে স্পষ্ট হয়ে যায় – পরিচালকদের একট সম্বল ছিল, তা হল শাকিব খান!

শাকিব খানের বিবৃতির পূর্বে কি চলচ্চিত্র পরিচালকরা বেকার ছিলেন না? পরিচালকদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে – এ তথ্য শাকিব খানের বিবৃতির বহু আগেই গোচরিভূত হয়েছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারীতে পূর্ব-পশ্চিমবিডি ডট নিউজের একটি রিপোর্ট দেখুন। ‘পূর্ণাঙ্গ পরিচালক আছেন প্রায় ৩৫০ জন, এবং সহযোগী পরিচালকের সংখ্যা শতাধিক। কিন্তু বর্তমানে ১০ থেকে ১২ জন নির্মাতা ছবি নির্মাণ করছেন। আর বেশিরভাগই পরিচালকরা সমিতিতে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। দিন দিন বেকার হয়ে পড়ছেন গুনী নির্মাতারা’ – এই তথ্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিভিন্ন গুণী পরিচালকের পরিসংখ্যান সহকারে উপস্থাপন করেছে পত্রিকাটি।

২০১৫ সালের মার্চ মাসে শুভ সকাল নামে একটি অনলাইন পত্রিকা লিখেছিল, ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া পেলেও বেকার পরিচালকদের সংখ্যা বাড়ছে।  বৈশাখী নিউজ নামে একটি অনলাইন পত্রিকা পরিচালক হাফিজ উদ্দিনের বরাত দিয়ে লিখে,

ডিজিটাল ফিল্মের নামে এখন মানহীন ছবি নির্মাণ হচ্ছে। আর এগুলো সবই করছেন তরুণ নির্মতারা। তাদের অজ্ঞতার কারণে এখন ভালো ফিল্ম হচ্ছে না। যে কারণে আমাদের চলচ্চিত্র ব্যবসা হচ্ছে না।তাই এখন তিনশরও বেশি পরিচালক এখন পুরোপুরি বেকার।
২০১৫ সালে সেপ্টেম্বর মাসে বিডিনিউজে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে চিত্রনায়ক আলমগীরের একটি উদ্বৃতি দেয়া যায়। অঙ্গার চলচ্চিত্রের মহরতে তিনি বলেছিলেন,  আরও আগে ২০১২ সালে ইত্তেফাকে দেয়া সাক্ষাতকারে মেধাবী নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন বলেছিলেন, 
আমার প্রধান কাজ হবে বেকার মেধাবী পরিচালকদের কাজ দেওয়া। ভালো ছবি নির্মাণে এগিয়ে আসতেই সমিতির থেকে আমরাই লগ্নির ব্যবস্থা করব। কারণ আমাদের বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে যে, সিনিয়ররা ভালো ছবি নির্মাণ করতে পারে না। সেই ধারণার আমূল পরিবর্তন করতে চাই।

সকল চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক এবং শিল্পী মিলে বয়কট করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে প্রকৃতপক্ষে লাভবান হবে কে? এই তিন পক্ষের কেউই নয়। ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিনেমায় বিনিয়োগ করেন যে প্রযোজক তার কাছে শাকিব খানের গুরুত্ব অন্য যে কোন নায়ক অপেক্ষা বেশি। কারণ একমাত্র শাকিব খানই পুঁজি ফিরিয়ে দেয়ার তুলনামূলক বেশি নিশ্চয়তা দিতে পারে। শাকিব খানকে বয়কট করার ফলে এ ধরনের প্রযোজকদের হারাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প। বাকী যেসব চলচ্চিত্র প্রযোজক থাকবেন, তারা সিনেমার নায়ক বাছাইতে আদৌ কোন গুরুত্ব দিবেন কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে। ফলে বেকার পরিচালকদের বেকারত্বের পরিমান বাড়বে বৈ কমবে না। মাঝখানে, মিশা সওদাগর এবং জায়েদ খানের নেতৃত্বে যে সকল চলচ্চিত্র শিল্পী শাকিব খানকে বয়কট করতে চাচ্ছেন তাদের বেকার হবার সম্ভাবনাও বাড়বে। ফলে আদতে এই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের লাভবান হবার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

তবে লাভবান হবে কে? পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র শিল্প। স্বীকার করুন আর না্ করুন, বাংলাদেশে কলকাতার চলচ্চিত্রের চাহিদা শাকিব খানের চলচ্চিত্রের পরেই। এদেশে বড়পর্দায় কলকাতার চলচ্চিত্র প্রদর্শনের বহু আগেই চলচ্চিত্রের বাজার তৈরী হয়েছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে, তাও জেনে রাখুন, জিৎ এর চাহিদা শাকিব খান ব্যতীত বাংলাদেশে যে কোন নায়কের চেয়ে বেশি। মান্নার মৃত্যুর পরে দর্শক শাকিব খানকে বেছে নিয়েছে, শাকিব খানের অনুপস্থিতিতে জায়েদ খানকে বেছে নেবে না – এই নিশ্চয়তা দিতে বেশি চিন্তা করতে হয় না। ফলে শাকিব খানের অনুপস্থিতিতে যে শূ্ন্যতার সৃষ্টি হবে সেখানে জায়গা করে নেবে পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতারা। বর্তমানের ছদ্মবেকার চলচ্চিত্র পরিচালকরা তখন পূর্ণ বেকারে পরিণত হবেন।

কাজী হায়াতের চলচ্চিত্র ‘পাগলা বাবুল’-এর কথা মনে আছে? সহপাঠিনীকে উত্যক্ত করায় এক কুছাত্রকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন শিক্ষক। কুছাত্র ক্লাস থেকে বেরিয়ে ক্লাসের আরেক শিক্ষার্থী ছাত্রসংসদের সভাপতি কাবিলাকে বলেছিল – যদি সে এর প্রতিবাদ না করে তাহলে পরবর্তী নির্বাচনে তাকে আর ভোট দেয়া হবে না। কাবিলাও ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয়, উক্ত শিক্ষকের বহিস্কারের দাবীতে আন্দোলন শুরু করে। সিনেমার নায়ক বাবুল চরিত্রের মাসুদ শেখ সকলের বিপরীতে দাড়িয়ে আন্দোলনকারীদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল – প্রকৃত দোষী কে এবং সত্য অবস্থান কি। শিক্ষার্থীরা তাদের ভুল বুঝতে পেরে ক্লাসরুমে ফিরে গিয়েছিল।

এই মুহুর্তে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে একজন পাগলা বাবুলের ভীষণ প্রয়োজন!


মন্তব্য করুন