
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাহসী ও সম্ভাবনাময় বাণিজ্যিক প্রচেষ্টা ‘ইনসাফ’
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ‘ইনসাফ‘ একটি সাহসী ও সম্ভাবনাময় বাণিজ্যিক প্রচেষ্টা। গল্পের মানবিক দিক, সামাজিক বার্তা ও প্রধান চরিত্রদের পারফর্মেন্স সিনেমাটিকে মনে রাখার মতো করে তোলে। আমাদের দরকার এমন আরো সিনেমা—আর তা সম্ভব প্রয়াসকে প্রশংসা ও সমালোচনার ভারসাম্যে মূল্যায়ন করলেই…
[স্পয়লার নেই]
ঢাকা শহরের এক সময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইউসুফ-যার মৃত্যুর খবর বহু আগেই ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ ইউসুফের অস্তিত্ব বারবার অনুভূত হচ্ছে। রহস্যভেদে দায়িত্ব দেওয়া হয় এএসপি জাহানকে। এভাবেই শুরু হয় সঞ্জয় সমাদ্দার পরিচালিত ‘ইনসাফ’। যেখানে দেখা গেছে প্রেম-ভালোবাসা, প্রতিশোধ, দুর্নীতি এবং রাজনীতির মিশেলে একটি অ্যাকশন থ্রিলার এবং গ্যাংস্টার ড্রিভেন গল্প।
বাংলাদেশে সঞ্জয় সমাদ্দারের প্রথম বাণিজ্যিক সিনেমা ‘ইনসাফ’। এর আগে তিনি ওপার বাংলায় জিতের সাথে ‘মানুষ’ নামে একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন। ‘মানুষ’ সিনেমার মতো ‘ইনসাফ’ সিনেমাতেও সঞ্জয় সমাদ্দার সবকিছু সামলে একটি মানবিক গল্প দেখানোর চেষ্টা করেছেন। দেশের একটি বিশেষ সেক্টরের দুর্নীতির ঘটনাও উঠে এসেছে এই সিনেমায়।

সিনেমার স্ক্রিনপ্লে সম্পর্কে বললে— প্রথমার্ধে যেন তেমন কিছুই ঘটে না, আবার অনেক কিছুই ঘটে। শুরুতে তাসনিয়া ফারিণের এন্ট্রি সিক্যুয়েন্সটা বেশ ভালো ছিল। এই অংশে ফারিণের দুইটা অ্যাকশন সিক্যুয়েন্স বেশ এনজয়েবল ছিল। এরপর গল্প বিরতির আগ মুহূর্তে গিয়ে শকিং ভ্যালু অ্যাড করে। সেসময়ও বেশ ভালো একটা ফাইট সিক্যুয়েন্স দেখতে পাওয়া যায়। সেকেন্ড হাফে গিয়ে গল্প আরো কিছুটা মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এই অংশে ইমোশন বিল্ড করতে সঞ্জয় সমাদ্দার পর্যাপ্ত সময় দিয়েছেন, যেটা অবশ্যই ভালো দিক। ফাইনালি ক্লাইমেক্সে এক নতুন সূচনার আলো দেখিয়ে ন্যায়ের জার্নি শেষ হয়। ও হ্যাঁ, কিছু ট্রেন্ডি ডায়লগের ব্যবহার ছিল পুরো সিনেমাজুড়েই। ধরতে পারলে ভীষণ মজা পাবেন। ছিল কিছু সামাজিক ইস্যু, যা অবশ্যই এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। সব মিলিয়ে, গল্পের উপস্থাপন মোটামুটি ভালো ছিল।
সিনেমায় শরীফুল রাজের কাজ বেশ ভালো ছিলো। পুরো সিনেমাজুড়ে রাজকে বেশ কয়েকটা লুকে দেখতে পাওয়া গেছে। বোঝাই যাচ্ছিলো যে রাজ এই সিনেমার জন্য অনেক খেটেছেন। কেননা, ওনার ট্রান্সফরমেশনটা অবশ্যই চোখে পড়ার মতো। উনি অভিনয়ও ভালো করেছেন এই সিনেমায়। ফাইট সিক্যুয়েন্সগুলোতে দুর্দান্ত ছিলেন। তাসনিয়া ফারিণ প্রথম বাণিজ্যিক সিনেমা হিসেবে যথেষ্ট ভালো করেছেন। গল্পে তার চরিত্রের গুরুত্ব অনেকটা অংশজুড়েই ছিলো। আর তিনি সেটা বেশ কনফিডেন্সের সাথে পুল অফ করেছেন। হ্যাঁ, কিছু সমস্যা আছে। সেটা নিয়ে পরে কথা বলছি। তবে বাণিজ্যিক সিনেমায় তাসনিয়া ফারিণের মতো গ্ল্যামারাস নায়িকারা নিয়মিত হলে ইন্ডাস্ট্রির জন্যই ভালো।
মোশাররফ করিমের স্ক্রিনটাইম কম ছিল। যেটুকু সময় পর্দায় ছিলেন, ভালো করেছেন। ওনার আলগা দাঁড়ি নিয়ে যতোটা সমালোচনা হয়েছে, ততোটা পর্দায় ফুটে ওঠেনি। মিশা সওদাগরকে আলাদা কিছু মনে হয়নি। নিজের চরিত্রে ঠিকঠাক ছিলেন। ফজলুর রহমান বাবু নিজের আর ৫-৭ সিনেমার মতোই পারফর্ম করেছেন। সিনেমায় বাকিদের কাজও ঠিকঠাকই বলবো। তবে একজনের ক্যামিও ছিল-যেটা অবশ্যই ইমপ্যাক্টফুল।
সিনেমায় মোট ৪টি গান রয়েছে। সবগুলো গানই একবার শোনার মতো। বিজিএমের ব্যবহার মোটামুটি। সিনেমাটোগ্রাফি এবং কালার গ্রেডিং যুতসই।
এবার আসি এই সিনেমার নেগেটিভ দিকগুলোতে। পরিচালক সঞ্জয় সমাদ্দার এই সিনেমার বাজেট স্বল্পতা ঢাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। কিছুক্ষেত্রে সফল হলেও পুরোটা ঢাকতে পারেননি। সিনেমায় ভিএফএক্সের কাজ খুবই দুর্বল লেগেছে। কিছু ফ্রেম বাস্তবসম্মত লাগেনি। কিছু টেকনিক্যাল ব্লান্ডার ছিল, ছিল অসতর্কতা। রাজের কিছু কিছু সিক্যুয়েন্সের পুনরাবৃত্তিও চোখে লেগেছে। একই বিজিএম বারবার ব্যবহার করার ব্যাপারটা কিছুটা বিরক্তি ধরিয়েছে। উপরে বলেছিলাম-সিনেমার ফার্স্টহাফে তেমন কিছুই ঘটে না, আবার অনেক কিছু ঘটে। মূলত ঘটে অনেক কিছুই, কিন্তু সেগুলো ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারেনি। এই অংশের স্ক্রিনপ্লে কিছুটা ধীরগতির। তবে একইসাথে অনেককিছু ঘটার কারণে বোর লাগেনি। এমনকি ক্লাইমেক্সে গিয়ে আবার একটা তাড়াহুড়ো ভাব দেখা গেছে এই সিনেমায়। রাজ-ফারিণের কেমিস্ট্রি বিল্ড আপে আরেকটু সময় দেওয়া যেতো। ফারিণকে এক্সপ্রেশনে আরো মনোযোগী হতে হবে বলে মনে করছি।
এই ছিল আমার দৃষ্টিতে ‘ইনসাফ’। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ‘ইনসাফ’ একটি সাহসী ও সম্ভাবনাময় বাণিজ্যিক প্রচেষ্টা। গল্পের মানবিক দিক, সামাজিক বার্তা ও প্রধান চরিত্রদের পারফর্মেন্স সিনেমাটিকে মনে রাখার মতো করে তোলে। আমাদের দরকার এমন আরো সিনেমা—আর তা সম্ভব প্রয়াসকে প্রশংসা ও সমালোচনার ভারসাম্যে মূল্যায়ন করলেই।