Select Page

স্বপ্নজাল কেমন ছিল?

স্বপ্নজাল কেমন ছিল?

কোন চলচ্চিত্র দেখার পর আমাদের সবার একটি প্রশ্ন থাকে, ‘চলচ্চিত্রটি কেমন ছিল?’ এ ধরনের প্রশ্নে মূলত দুইটি উত্তর থাকে— ভালো ও খারাপ।

খুব সহজ এই উত্তরটি কিন্তু আবার সব চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে দেওয়া যায় না, কারণ কোন কোন চলচ্চিত্র এর মাঝামাঝি একটি অবস্থানে থাকে, যাকে আপনি ঢালাওভাবে খারাপ বা ঢালাওভাবে ভালো সিনেমা বলতে পারবেন না। এ ধরনের চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বেশি হয়, যুক্তি-তর্কও বেশি চলে। সর্বোপরি এ ধরনের চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র শিল্প বিকশিত হয়। কারণ আলোচনার মধ্য দিয়ে ভালো দিকগুলো চলে আসে এবং সমালোচনারা মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের দূর্বলতাগুলোও একে একে সামনে ধরা দিতে থাকে। যা পরবর্তী নির্মাণের ক্ষেত্রে রেফারেন্স হিসেবে কাজ করে।

‘স্বপ্নজাল’ ঠিক এমন একটি চলচ্চিত্র। যা বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য একটি উদাহরণ হতে হতে গিয়েও হতে পারেনি, আবার আপনি তাকে ফেলেও দিতে পারবেন না। চলুন একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যায়।

চলচ্চিত্রের পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিমের নাম ‘মনপুরা’র বদৌলতে পৌঁছে গিয়েছে সবার মাঝে। ‘মনপুরা’র জন্য তার নাম হয়ে গিয়েছে একটি ব্র্যান্ডের মত। স্বাভাবিকভাবে ৯ বছর পর তার নতুন চলচ্চিত্রের প্রতি মানুষের স্বপ্নের জাল বেশি বিস্তার করে থাকবে। এজন্য ‘স্বপ্নজাল’র প্রতি মানুষের এক্সপেক্টেশন একটু বেশি ছিল বলা যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে কল্পনা এবং বাস্তবতার মিল হয় না। ‘স্বপ্নজাল’র ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য।

কাহিনি শুরু হয় নদীমাতৃক বাংলাদেশের একটি অঞ্চল চাঁদপুর থেকে। মাছ কেনা-বেচা নিয়ে দুজন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই এক সময় এতটা প্রবল রূপ নেয় যে, সেখানে হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হয়। সবার অগোচরে মেরে ফেলা হয় সনাতন ধর্মের অনুসারী হিরণ সাহা চরিত্রের মিশা সওদাগরকে। তার পরিবারের কাছে জানানো হয় তিনি ভারতের কলকাতাতে চলে গিয়েছেন আবার বিয়ে করে। হিরণ সাহার মেয়ে শুভ্রা ও পরিবার উপয়ান্তর না দেখে পাড়ি দেয় কলকাতাতে। মাঝ দিয়ে শুভ্রার বাবার বন্ধুর ছেলে অপুর সাথে বাঁধনহারা প্রমের সুতায় গাথা পড়ে শুভ্রার মন। যেতে যেতে অপুকে বলে, ‘তুমি আমার’। শুভ্রা অপুর মিল কি হবে? শুভ্রা কি জানতে পারবে তার বাবার হত্যাকারী কে? আসলে কি হয়েছিল তার বাবার। জানতে চাইলে দেখতে হবে ‘স্বপ্নজাল’।

অনেক গতানুগতিক কথা বলে ফেলেছি। উপরের অংশটুকুতে ছিল সিনেমার কিছুটা কাহিনি বা গল্প, যেখানে একই সাথে দেখা মেলে অপু-শুভ্রার ভালোবাসার স্বপ্ন ও আয়নাল গাজীর ষড়যন্ত্রের জাল (মনে হয় এখান থেকেই নাম হয়েছে স্বপ্নজাল 😛 মজা করলাম, নাখোশ হয়েন না কেউ)।

চলচ্চিত্রটির সব থেকে পজেটিভ দিক হচ্ছে, অভিনয়। প্রতিটি অভিনেতা-অভিনেত্রী দারুণভাবে নিজেদের উপস্থাপন করেছেন। যেভাবে উপস্থাপন করা দরকার ঠিক সেভাবে। বিশেষ করে ইরেশ যাকেরের কথা বলতে হয়। খুব ভালোভাবে খেয়াল না করলে প্রথম দর্শনে ইরেশ যাকেরকে চেনা যাবে না। নিজের চরিত্রের সাথে মিশে যাবার জন্য তিনি দাড়িটাও কাটেননি। অনেকেই দেখা যায় নকল দাড়ি ব্যবহার করেন কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি করেননি।

পুরো চলচ্চিত্রটি হাস্যরস দিয়ে মাতিয়ে রেখেছেন বলা যায় ফজলুল রহমান বাবু। তার বিখ্যাত ডায়লগ- ‘অপু না? আব্বায় কই?’ মানুষ যতবার শুনেছে হেসেছে। এছাড়া ধরার পড়ার পর নির্বাচনের জয়ের পর ভি সাইন দেওয়াও তার চরিত্রটিকে নন্দিত করেছে। এছাড়া নবাগত ইয়াশ রোহানের টিনএজার লাভারের ভূমিকা ছিল ঠিকঠাক। অল্প বয়সে প্রেমে পড়লে বেখায়ালীপনা যেরকম হয় ঠিক সেভাবে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন।

‘স্বপ্নজাল’র সব থেকে বড় পাওয়া পরী মনি। তাকে মানুষ অন্যভাবে চিনেছে। বর্তমান সময়ের সেরা গ্ল্যামারাস এই নায়িকা আলোচনাতে থাকলেও বলার মতো তেমন কোন চলচ্চিত্র তার ক্যারিয়ারে ছিল না। কিন্তু ‘স্বপ্নজাল’ তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যেতে পারে। এত চমৎকার ভয়েস মিক্সিং ছিল তার প্রতিটি সংলাপ মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে বাধ্য করবে, সাথে নজরকাড়া গ্ল্যামার তো ছিল।

১৯৯৬ পরবর্তী সময়কে ফুটিয়ে তোলার জন্য সিনেমাতে ব্যাবহার করা হয়েছে ল্যান্ড ফোন। সময়ের কোন ধারণা দেওয়া না থাকলেও চলচ্চিত্রে ব্যাবহার হয়েছে এক সময়ের জনপ্রিয় সিরিজ ‘এক্স ফাইলস’র টিউন, যা বিটিভি তখন দেখানো হত। চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে এই টিউনটি শোনা যায়, যার মধ্য দিয়ে ধারণা করা নেওয়া যায় কোন সময় অনুসারে চলচ্চিত্রটি নির্মিত। চলচ্চিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ও গান ছিল শ্রুতিমধুর।

প্রথম দিকেই বলেছিল চলচ্চিত্রটির সব কিছুই ভালো না, কিছু খারাপ দিকও আছে। আসলে চলচ্চিত্রটির গল্পটি বেশ বড়। গল্পের বিশালত্ব কখনো চলচ্চিত্রের বাজে দিক হতে পারে না, কিন্তু শেষ দিকে গল্পটি মনে হয়েছে জোর করে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য মেলানো হয়েছে। চলচ্চিত্রের ফোকাস ছিল গাঢ় প্রেমের গল্প নিয়ে, কিন্তু চলচ্চিত্রে বেশির ভাগ সময়ে দেখানো হয়েছে, ‘পাপ ছাড়ে না তার বাপকেও’। আয়নাল গাজী চরিত্রটি তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

এছাড়া পিতার হত্যার প্রতিশোধ কিংবা হিন্দু-মুসলিম বিয়ের জটিলতা এটা দেখাতে গিয়েও সিনেমাটি তার মূল থিম থেকে অনেকাংশে সরে এসেছে বলে মনে হয়েছে। চলচ্চিত্রটি না হয়ে পরিপূর্ণ থ্রিলার, না হয়েছে পরিপূর্ণ রোমান্টিক চলচ্চিত্র। এছাড়া হিন্দু-মুসলিম বিষয়টি টেনে নিয়ে এসে সমাজকে দোষারোপ করার মধ্যে দিয়ে ধর্ম ভালোবাসার কাছে কালপ্রিট— এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেটা আমরা দেখেছিলাম সালমান শাহ ও শাবনুরের ‘প্রেম পিয়াসী’তে।

গল্পটিকে আরো একটি ঘষামাজা করলে আমরাও মালায়ালাম ‘আনারকলি’র মতো একটি নিখাদ ভালোবাসার গল্প দেখতে পেতাম। যেখান ধর্ম বাধা ছিল, পরিবার বাধা ছিল এমনি যেখানে ষড়যন্ত্রও ছিল। হয়তো পরিচালক নিজের ‘মনপুরা’র ট্রেন্ডমার্ক বজায় রাখতে চেয়েছেন। তৈরি করতে চেয়েছেন নিজস্ব একটি ধারা। কিন্তু সময় পরিবর্তন হয়েছে। ‘মনপুরা’র সময় আর ‘স্বপ্নজাল’র সময় এক না, এটিও মাথায় রাখা উচিত ছিল।

চলচ্চিত্রে যেভাবে বর্ডার ক্রস করেছে, বর্ডার এত সহজে পার হতে পারলে তো ভালো হত। এছাড়া সিনেমার শেষ দৃশ্যতে কালারগ্রেডিং খুবই চোখে পড়ার মত। এ ধরনের দৃশ্য ইচ্ছা করলেই ন্যাচারাল কালারেই করা সম্ভব ছিল। পরবর্তীতে এ ধরনের কাজে আরো বেশি যত্নশীল হলে চলচ্চিত্রের মান আরো বেড়ে যাবে।

সর্বোপরি, ‘স্বপ্নজাল’ হয়ত স্বপ্ন পুরোপুরি পূরণ করতে পারেনি, কিন্তু স্বপ্নের বীজ বপন করেছে। বাংলা চলচ্চিত্রের পরিবর্তনের ধারাকে ধরে রেখছে। ‘স্বপ্নজাল’র স্বপ্নের পথে হাটলে দারুণ কিছু পাবে বাংলা চলচ্চিত্র এ কথা বলা যায়। শেষদিকে কাহিনি একটু ফল করলেও বেশ উপভোগ্য এ কথা বলা যায়। পরিবার নিয়ে উপভোগ করার মত একটি চলচ্চিত্র ‘স্বপ্নজাল’। পুরো সিনেমা বিবেচনা করলে নির্মাণগত দিক থেকে মোটামুটি ভালো সিনেমা বলা যায়। আপনার সময় নষ্ট হয়েছে একথা মাথায় আসবে না, এটি ‘স্বপ্নজাল’র শতভুলের পরও সব থেকে বড়প্রাপ্তি।

রেটিং : ৭/১০


মন্তব্য করুন