Select Page

অজানা মানুষের পাশাপাশি থাকার ‘নীল মুকুট’

অজানা মানুষের পাশাপাশি থাকার ‘নীল মুকুট’

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পুরস্কার ও প্রশংসাপ্রাপ্ত ২০১২ সালের সিনেমা ‘শুনতে কি পাও’-খ্যাত নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমনের ডকু ড্রামা ‘নীল মুকুট’ গত বছরই মুক্তির কথা ছিলো। মাঝে অবশ্য ‘একটি সুতার জবানবন্দি’ নামক আরেকটি সিনেমা উপহার দিয়েছিলেন তিনি। এরপর বেশ কয়েক বছর বিরতি দিয়ে হাজির হলেন ‘নীল মুকুট’ নিয়ে।

সাইমন অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কোনো আন্তর্জাতিক উৎসবে নয়, এই ডকু ড্রামাটা সবার আগে দেখবেন বাংলাদেশের দর্শক। কিন্তু করোনার কারণে দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্থগিত হয়ে যায় সিনেমার মুক্তি। কিছুদিন আগেই মুক্তি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন কামার আহমাদ সাইমন। সে উদ্বেগের অবসান ঘটিয়ে ৮ আগস্ট চরকিতে মুক্তি পেয়েছে ডকু ড্রামাটি।

সেই অর্থে আমাদের দেশে ডকু ড্রামা বা ডকুমেন্টারি নিয়ে কাজ হয় হাতেগোনা। এর ওপর তথাকথিত বাণিজ্যিক ও ভিন্নধারার সিনেমা যতটা আলোচনা বা আগ্রহের জায়গায় থাকে ডকু ড্রামা নিয়ে আগ্রহ অতোটা লক্ষ্য করা যায় না। তবে সময়ের সাথে সাথে দর্শকদের মাঝে আগ্রহ বৃদ্ধি এবং ভিন্নধর্মী কনটেন্ট দেখার ইচ্ছা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এটাও সত্য। সেই হিসেবে ‘নীল মুকুট’ নতুন প্রজন্মের কাছে একটি আলোচিত কাজ হয়ে থাকবে নান্দনিক নির্মাণ এবং অজানা বাস্তবতা সেলুলয়েডে উপস্থাপনের জন্য।

বাংলাদেশের কোনো এক গ্রামের একটি সাধারণ বাড়িতে বৃষ্টিস্নাত দিনে পুলিশ বাহিনীর এক নারী সদস্যের পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে সরকারি মিশনে যাবার দৃশ্যের মাধ্যমে প্রায় ১০২ মিনিট ব্যাপ্তির ডকু ড্রামার সূচনা। প্রথমে কিছুটা স্লো বা প্রতিটা ফ্রেমের সময়কাল দীর্ঘ মনে হলেও খুব তাড়াতাড়িই পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের এই যাত্রার মাঝে নিজে মিশে যেতে বা নিজেকে মিলিয়ে নিতে কষ্ট হবে না।

কামার আহমাদ সাইমন রিলিজের আগেই জানিয়েছিলেন যে, ‘এই ডকুড্রামায় কোনো গল্প নাই’। হ্যাঁ, তথাকথিত বা আমাদের পরিচিত অ্যাংগেলে যে কোন সিনেমায় কিছু চরিত্রকে কেন্দ্র করে ফিকশনের গল্প এগিয়ে যাবার যে নীতি এই ডকু ড্রামায় তেমনটি নয়। এখানে কোনো চরিত্র বা স্পেসিফিক কোনো কিছুকে প্রাধান্য দিয়ে কিছু দেখানো হয়নি। তবুও আক্ষরিক অর্থে দেশ ছেড়ে মানবতার তরে সুদূর হাইতিতে গিয়ে নানাবিধ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার একটা অচেনা এবং অজানা গল্প উঠে এসেছে। একদল নারীর ট্রেনিং, পরিবার এবং আপন মানুষদের সাথে খন্ডকালীন দুরত্ব, নতুন এক দেশে সব পরিস্থিতিতে নিজের মনের সাথে নানা রকম টানাপোড়েন উঠে এসেছে মানবিক দিকগুলো উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে।

ছবির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংলাপ। না এখানে কোনো কিছুই লিখিত বা পূর্ব নির্ধারিত নয়। হাজার মাইল দূরে আমাদের দেশের একদল নারী তাদের জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক যে কথাবার্তা বলে এখানে তাই দেখানো হয়েছে যা সিনেমার ভাষায় একদমই ‘র’। পরিবার থেকে দূরে থাকলেও ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তাদের হাসি, আনন্দ, কষ্ট, সন্তানের জন্য আকুতি সবই বর্ণনা করেছেন তারা নিজেরাই নিজেদের মতো করেই। তাই ‘নীল মুকুট’ দেখার সময় এই মানুষগুলোর পাশাপাশি আছি বলেই মনে হয়েছে।

ক্যামেরার কিছু কাজ দেখে মনে হতেই পারে খুব সাধারণ হয়ে গেলো, তবে ১০২ মিনিটের এই যাত্রা শেষ হলে মনে হবে এই সাধারণ টুকুরই দরকার ছিলো খুব। পুলিশ বাহিনী শব্দটা শুনলে যে চিত্রটা কখনোই আমাদের মনে আসে না বা চোখে ভাসে না নির্মাতা সেই কষ্টসাধ্য কাজটিই করে দেখিয়েছেন সফলতার সাথে। একটি আন্তর্জাতিক মিশনে আমাদের দেশের নারীদের কী কী ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তারই নান্দনিক উপস্থাপন ‘নীল মুকুট’।

‘নীল মুকুট’ নিয়ে কামার আহমাদ সাইমন জানিয়েছিলেন, ‘নীল যদি ব্যথার রং হয় আর মুকুট যদি হয় ক্ষমতার পরিচয়, নীল মুকুট সেই অর্থে অন্য রকম একটা ফিকশন। প্লেনে একবার এক দূরদেশ যাত্রায় একটা কান্না শুনে মন খুব খারাপ হয়েছিল, কান্নাটা খুব ভাবিয়েছিল। সেই ভাবনার মুহূর্তটাকে ফ্রেমে আনার চেষ্টাই নীল মুকুট। এখানে কোনো বিরাট ঘটনা নেই। শুনতে কি পাও!-এ যেমন দর্শকের জন্য একটা আখ্যান আছে, এখানে সেটাও নেই। তবু এই সিনেমা বানাতে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে দূরের একটা দেশে যেতে হয়েছিলো।’

নির্মাতার কথার সুত্র ধরেই বলতে হয়, এখানে হয়তো কোনো গল্প বা আখ্যান নেই তবুও ‘নীল মুকুটে’ আছে আমাদের দেশের ডকু ড্রামা ঘরানা প্রতিষ্ঠিত করার এক নান্দনিক প্রয়াস। বিশ্ব চলচ্চিত্রে দরবারে বাংলাদেশের ডকু ড্রামা ঘরনার যে শুরুটা তারেক মাসুদ ‘মুক্তির গান’ এর মাধ্যমে করেছিলেন আজ কামার আহমাদ সাইমনরা সেটাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ‘শুনতে কি পাও’ বা সাম্প্রতিক ‘নীল মুকুট’ এর মাধ্যমে। শুভ কামনা রইলো নির্মাতা এবং চলচ্চিত্রটির সাথে জড়িত সবার জন্য।


মন্তব্য করুন