“অজ্ঞাতনামা” কথা
সিনেমার পোস্টার খুব সাদামাটা, কিন্তু সেই পোস্টারের একটি জায়গায় কেন জানি নিজের দুষ্টু চোখটা স্থির হয়ে গেল। অজ্ঞাতনামা শব্দটার ইংরেজি Unnamed এর Un অক্ষরটি লাল রঙের করে দেয়া পোস্টারে। সিনেমা শুরুর আগেই মাথায় চিন্তা ঘুরতে লাগল- সিনেমাটা কি অপরাধের, অনিয়মের নাকি অস্তিত্ব সংকটের? এই কারণেই কি অ বা Un কে লাল করে দেয়া? সিনেমা শেষে বুঝলাম- গল্পটা আসলে সব কিছুরই।
গল্প আমাদের খুব চেনা আর খুব আপন। কিন্তু এই চেনা গল্প দুর্দান্ত হয়েছে দারুণ স্ক্রিনপ্লে আর স্টোরি টেলিং এর কারণে আর এখানে ক্যামেরার পিছনে বসা তৌকীর আহমেদের ভূমিকাই যে বেশি সেটা আলাদা করে বলতে হয়না। নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে বিদেশ যাওয়া মানুষদের মাঝে কেও যখন মারা যায়, তখন তার লাশ এই দেশে আসলে সেটা নিয়ে কি কি সমস্যা হয় (বিশেষ করে গরিব ঘরের কেও হলে তো সমস্যার শেষই নাই!) এবং এই এক লাশকে কেন্দ্র করে কীভাবে আমাদের দেশের আদম ব্যবসা থেকে শুরু করে উপরের মহলের মুখোশ উন্মোচিত করা হয়েছে- সেটা দেখবেন অজ্ঞাতনামা সিনেমাতে।
গল্প শুনে খুবই সেনসিটিভ ইস্যু মনে হলেও এত স্পর্শকাতর জিনিসে এত দারুণভাবে হিউমার ঢুকিয়েছেন তৌকীর আহমেদ – যে ১ ঘণ্টা ৪৮ মিনিটের এই সিনেমার এক সেকেন্ডও আপনার কাছে বোরিং লাগবে না। বিশেষ করে সিনেমার প্রথম অর্ধেকে শহিদুজ্জামান সেলিম আর মোশাররফ করিম অসাধারণ বিনোদন দিয়েছেন। অথচ সিনেমার সেকেন্ড পার্টে গিয়েই এরা দুইজনেই ইমোশন দিয়ে চোখ ভিজিয়েছেন। আলাদা করে ফজলুর রহমান বাবুর কথা না বললে বিরাট অপরাধ হবে। নিজের ছেলেকে হারিয়ে সেই ছেলের আসল পরিচয় তিনি দিতে পারছেন না কারণ তার ছেলে আরেকজনের গলাকাটা ছবি পাসপোর্টে দিয়ে বিদেশে গেছে- সেলিম যখন তাকে বারবার নিজের ছেলের নকল পরিচয় দিতে বলেন, তখন বাবুর কান্না দেখে পুরো সিনেমাহল একদম চুপ! আরেকটি দৃশ্যে শাহেদ আলীর হাত থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে খাওয়ার দৃশ্যে বাবু এতটাই বাস্তব ছিলেন, চোখের পানি সামলানো আসলেই কষ্ট হয়ে যায়। আসলে এই সিনেমার সবচেয়ে বড় সম্পদ এর অভিনয়- আবুল হায়াত, নিপুণ, শতাব্দী ওয়াদুদ, শাহেদ আলী- কাকে রেখে কার কথা বলব? এদের প্রায় সবাই তো অভিনয়ের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে আসা দুর্দান্ত অভিনেতা। তৌকীর আহমেদ তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন – আমি ট্রেইনড অভিনেতা নিয়ে এই কারণে কাজ করি কারণ তাতে সিনেমার ৬০% কাজ হয়ে যায়।(সূত্র- আজকের বাংলাদেশ, ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি) ভুল যে বলেন নি, তার প্রমাণ তো সিনেমাতেই দেখলাম।
[su_box title=”অজ্ঞাতনামা নিয়ে আরও দেখুন”]অজ্ঞাতনামা : বাস্তবসম্মত কেস স্টাডি, লেখক: রহমান মতি[/su_box]
প্রতি বছর যারা কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের দেশের জন্য রেমিটেনস পাঠাচ্ছেন বিদেশে থেকে, তাদের মৃত্যুর পর তাদের জন্য সামান্য মাটির ব্যবস্থা আমরা করতে পারি না, তারা যেন মাঝি ছাড়া নৌকার মতো ভেসে বেড়ান- জাতি হিসেবে আমাদের এই ব্যর্থতাকে পরিচালক প্রশ্ন করেছেন। তার প্রশ্নের ধরনের কিছুটা ডার্ক কমেডি ভাব ছিল এবং এই কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন সেলিম আর মোশাররফ করিমকে – আর এই দুইজনেই তাদের সেরাটা দিয়েছেন। মজার ব্যাপার হল, লাশ নিয়ে কাহিনী হলেও পুরো সিনেমাতে একবারের জন্যও লাশটিকে দেখানো হয়নি (হবে কীভাবে, লাশ নাকি ছিলই না শুটিং এর সময়, খালি কফিন ছিল, তবে বেশিরভাগ সময় সবাই নাকি সেটা ভুলে যেতেন- তৌকীরের ভাষ্যমতে- সূত্র- কালের কণ্ঠ) সিনেমার কোন ক্যারেক্টারকেই আপনি পুরোপুরি ভাল বা পুরোপুরি মন্দ বলতে পারবেন না, ক্যারেক্টার নিয়ে বেশ খেলেছেন তৌকীর আহমেদ। আদম ব্যবসায়ী শুরুতে একরকম, আবার সিনেমার শেষে একরকম। লাশ আনতে তার প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে বলে সে বারবার রাগে গজগজ করছে, আবার লাশ যেন পচে না যায় এই কারণে তাড়াতাড়ি দাফন করানোর চিন্তাও তার মাঝে- দ্বৈতসত্তা যাকে বলে আরকি। প্রবাসী হিসেবে দূরে থাক, মানুষ হিসেবেও আমরা যখন নিজের দেশের মানুষদের মৃত্যুর পরে ন্যূনতম সম্মান দিতে পারিনা- তখন মানুষ হিসেবে আমাদের নিজেদের মূল্য কতটা আসলে? জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থান কোথায়? কে দিবে সেটার উত্তর? সেই প্রশ্নের উত্তর কি অজ্ঞাতনামা সিনেমার লাশের পরিচয়ের মতই অজ্ঞাত?
৬০ কোটির তামিল ঝকঝকে সিনেমা আমরা এক বা দেড় কোটিতে চুরি করে বা রিমেক করে বানিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, ৬০ কোটির আউটপুট আর এক কোটির আউটপুটে আকাশ পাতাল পার্থক্য। এর চেয়ে নিজেদের মৌলিক গল্প দিয়ে যদি আমরা আগাই, তাহলে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে একেবারেই সময় লাগবে না। বলিউড নামের একটা বড় ইন্ডাস্ট্রি- ভাল কাহিনীর আশায় এখন চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে মালায়ালাম নামের ছোট একটা ইন্ডাস্ট্রির দিকে – কারণ ৬ থেকে ৮ কোটির মালায়ালাম সিনেমা ১০০ কোটির মতো আয় করছে দিনকে দিন! রহস্য একটাই- তারা নিজেদের কাহিনী বলছে, নিজের মাটির কাহিনী, দেশের কাহিনী!
শুধু নিজেদের কাহিনী নিয়ে অজ্ঞাতনামার মতো সিনেমা বানিয়ে বসে থাকলেই চলবে না, আপনার ভাল জিনিসের প্রচার না থাকলে কেও
দেখবে না সেটা। প্রচারটা অনেক বেশি দরকার এটা আমরা কেন এখনও বুঝিনা সেটা আমার মাথায় আসে না। পাবলিক যদি নাই জানে, তাহলে সে কীভাবে দেখবে সিনেমা? এরকম একটা সিনেমা সিনেপ্লেক্স বা যমুনাতে এখনও রিলিজ পেল না কেন সেটাও একটা ‘অজ্ঞাত’ রহস্য। “সিনেমার প্রচার আমার কাজ না, আমার কাজ পরিচালনা করা আর সেটা আমি করেছি। আর পিআর (পাবলিক রিলেশন) এর ব্যাপারে আমি খুব একটা আগ্রহী না, আমি নিভৃতচারী মানুষ। এটার দায়িত্ব প্রোডিউসার আর পরিবেশকের”- তৌকীর আহমেদ (সূত্র- মুভি বাজার, এশিয়ান টিভি) কথা ভুল বলেননি পরিচালক খুব একটা। যেভাবে পরিচালক আর অভিনেতারা তাদের নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতো করেছে, সেভাবে যাদের দায়িত্ব প্রচার করার- তারা যদি করেন- তাহলেই আমাদের জন্য মঙ্গল। তা নাহলে একসময় হয়ত উৎসাহের অভাবে দেশীয় মৌলিক সিনেমা বলেই কিছু থাকবে না।
পুনশ্চ- সিনেমার একটি জিনিসে একটু খটকা লেগেছে- সারাজীবন অজপাড়াগাঁয়ে থাকা বাবুর মুখে সিনেমার শেষে মানবতার বড় সংলাপ একটু ধাক্কা দেয়। তবে এই ধাক্কা নিয়ে আর কথা বলতে চাচ্ছিনা। গোটা সিনেমা যেখানে এত ভাল লেগেছে, সেখানে এই ধরনের জিনিস কিছুটা তো ওভারলুক করাই যায়।