অজ্ঞাতনামা : হৃদয়স্পর্শী বাস্তবতা
চলচ্চিত্র: অজ্ঞাতনামা
পরিচালক: তৌকীর আহমেদ
শ্রেষ্ঠাংশে: ফজলুর রহমান বাবু, মোশাররফ করিম, শহিদুজ্জামান সেলিম, নিপুন আক্তার, শতাব্দী ওয়াদুদ।
মাসুদ সেজান পরিচালিত “এইম ইন লাইফ” নাটক দেখার সুবাদে সিনেমা সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য বা কৌশল সম্পর্কে ছোট্ট ধারণা হয়েছিল। যা পরবর্তীতে ফিল্ম নিয়ে গবেষনা করে সেই জ্ঞানে কিছুটা শান দিয়েছি।
তবুও ফিল্মের মত বিশাল ভান্ডারে এটা কিছুই না। নাটকটিতে বলা হয়েছিল সিনেমায় কিছু ৩য় বুদ্ধির কাজ করা হলে সিনেমাটির সৌন্দর্য্য অনেক বৃদ্ধি পায় । যা স্পস্টভাবে লক্ষ করা যায় সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায়। পথের পাঁচালি সহ অপু সিরিজ কিংবা গুপি বাঘার মত কমেডি ধাঁচের সিরিজের ছবিতেও তা লক্ষ করা যায়। একসময় ভেবেছিলাম বাংলাদেশে মনেহয় আর সত্যজিৎ আসবে না। ১৫-১৬ সালে সিনেমায় উন্নতি দেখে ভেবেছিলাম ১০ বছরের মধ্যেই আমরা সত্যজিৎ রায়ের কোন উত্তর সুরী পেয়ে যাব। কিন্তু না ২০১৬ সালেই মনে হয় পেয়ে গেছি। হ্যা তৌকীর আহমেদ যার মাঝে সত্যজিৎ রায়ের ছায়া খুজে পাওয়া যাচ্ছে। মাত্র ৪-৫ দিনের একটি ঘটনাকে উপজিব্য করে নির্মিত অজ্ঞাতনামা দেখলে মনে হয় ৪০ বছরও মানুষের মনে থাকতে সক্ষম।
চলুন একনজরে দেখে নেয়া যাক ছবিটির সংক্ষিপ্ত কাহিনী: বাংলাদেশের মানুষ যারা জীবিকার উদ্দেশ্যে বিদেশে যায় তার একটা বড় অংশ যায় মধ্যপ্রাচ্যে। তেমন একজন আছির উদ্দিন যাকে নিয়েই পুরো গল্প। সেখানে দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন। তার লাশ আনা থেকে শুরুকরে সৎকার নিয়েই ছবির গল্প আবর্তিত হয়।
কী ভাবছেন এমন গল্পে আবার আকর্ষন কই। আকর্ষন আছে। ছবিতে দেখা যাবে তথা কথিত রমজান দালাল (শহিদুজ্জামান সেলিম) ধাওয়া করছে ঐ থানার এস আই ফরহাদ (মোশাররফ করিম) কে। সেই এস আই এর সাথে আবার ঘটনা ক্রমে দেখা যাবে ঐ দালালের মামলাতেই। এরকম আরো অনেক হাস্যরস ও বিষাদময় দৃশ্য আপনাকে বারবার আটকে রাখবে ছবি দেখার পর্দায়।
কাহিনীর বাস্তবতা
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ যারা জীবিকার জান্য বিদেশে যায় তাদের একটা বড় অংশ যায় মধ্যপ্রাচ্যে। ধর্মীয় দিক থেকেও মধ্যপ্রাচ্য অর্থাৎ আরব রাষ্ট্র গুলোকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে আসছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য মধ্য প্রাচ্যে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়। শ্রমিকের অধিকার বা সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়না। প্রায়সই শোনা যায় দুর্ঘটনায় শ্রমিকের নিহত হওয়ার খবর। অনেক সময় ঘটে আত্যহত্যার মত ঘটনা ঘটে। তেমন একটি দুর্ঘটনায় মৃতূই এই ছবির গল্পের মুল উপজীব্য। অনেক সময় গলাকাটা পাসপোর্টের মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার ফলে বেওয়ারিশ লাশের মত ঘটনা ঘটে। কিন্তু সে লাশের ভার কেউ নিতে চায়না।
তৃতীয় বুদ্ধির উদয়
আগেই বলেছিলাম সত্যজিৎ রায়ের এই ছায়াটা পাওয়া গিয়েছে অজ্ঞাতনামা ছবিতে। তৃতীয় বুদ্ধি, একটু আলোচনা করা দরকার। কোন কাজ সম্পন্ন হওয়ার সময় সেটা থেকে আলাদা কিছুর আবিষ্কার যা ছবির সৌন্দর্য বাড়ায়, পরিচয়ে সহযোগিতা করে। উদাহরন হিসেবে বলা হয়ে থাকে “পথের পাচালী ছবির দুর্গা যখন তার গলার হারটি পানিতে ছুড়ে ফেলে দেয় তখন পানিতে ভাসমান কচুরিপানা ধীরধীরে সরে যায় আবার যখন হারটি পানিতে সম্পুর্ণ ডুবে যায় তখন কচুরীপানা গুলো আবার একত্রিত হয়।”
এরকম কিছূ কাজ অজ্ঞাতনামা ছবিতে পাওয়া গেছে। যেমন:
১। ছবির শুরুতেই দেখা যায় ছবির মুল চরিত্র কেফায়েত উদ্দিন পরামানিক (ফজলুর রহমান বাবু) একটি মরা পাখির কবর দিচ্ছেন। এর দ্বারা বেশ সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে তিনি সৎকারে বিশ্বাসী।
২। নৌকা নিয়ে যখন যাচ্ছিল তখন নৌকার ধাক্কার ফলে পানি গিয়ে ধাক্কা লাগে যা ঐ সময়ের কাহিনীকে মনের গভীরে ঢুকিয়ে দেয়।
৩। ট্রাকে করে যাওয়ার সময় ক্যামরা ধরা হয় গাছের পাতার পেছনে বাতাস দোলা দেয়ার ফলে সেই দৃশ্য দেখতে অনেক আকর্ষনীয় লাগে।
৪। সকালের দৃশ্য দেখানোর জন্য দেখানো হয় নদীর উপর পড়ার সকালের সোনালী রদ্দুর।
৫। পুলিশের নৌকা যাওয়ার পর বৃষ্টির দৃশ্য।
৬। মিটিং শুরুর দৃশ্য দেথানোর আগে গরুর কাছ থেকে ক্যামরা রোলিং করে মিটিংয়ে দেখানো হয়। এতে অনেকটা গ্রামীন সৌন্দর্য প্রকাশ পায়।
মানবিক মুল্যবোধ
পরিচালক এই অংশেও পুরোপুরি সফল। বলতে গেলে পিঠে চাপড় দিয়ে দেখিয়েছেন দেখো এভাবেই মানুষের মনে আঘাত করে মন জয় করতে হয়্ । সেক্ষেত্রে অভিনয় শিল্পিগণ বিশাল ভুমিকা রেখেছেন। সেরকম কিছু অংশ হল
১। শুরুতে পুলিশ যখন এসে আব্দুল হাকিম (আবুল হায়াত) কে এসে বলে তার ছেলে নিহত। তখন মনে হচ্চিল কেউ তাকে ধাক্কা দিয়েছে । অবশ্য সদ্য কথা বলা ছেলের মৃত্যু সংবাদ শুনলে এরকমটাই হওয়ার কথা।
২। আবার এই খবর সঠিক স্থানে অর্থাৎ পরামানিক বাড়ীতে বলা হল তখন তিনজনের তিনরকম এক্সপ্রিয়েশন দেখা যায়। মা (মমেনা চৌধুরী) চিৎকার দিয়ে কাঁদে, স্ত্রী (জুই করিম) পাথর হয়ে যায় আর বাবা তিনিই গল্পের নায়ক (ফজলুল রহমান বাবু) যার এক্সপ্রিয়েশন ছিল চোখে পড়ার মত “কি করবে বুঝতে পারছেনা” এমন।
৩। খাওয়ার সময় আবুল হায়াত যখন শতাব্দী ওয়াদুদের কাছে জানতে পারে সে নিঃসন্তান তখন আবুল হায়াত বলে “আপনার কোন দিন সন্তান হারানোর ভয় নাই” এ সময় মানুষের মনে কি হয় নিশ্চয় বুঝতে পারছেন !
৪। ফজলুর রহমান বাবুকে যখন রিহার্সেলের জন্য প্রশ্ন জিজ্ঞেশ করা হয় তখন তার আপাত উত্তর না দিয়ে সত্য উত্তর দেয়। এরপর আছির আছির বলে কাঁদে। আবার বিমানবন্দরে কফিন ধরে তথ্যদিয়ে কাঁদে সে সময়ের আবেগগুলো সবার মনে নাড়া দেবে।
৫। কথিত আছে “পিতার কাছে সবচেয়ে ভারি বস্তুহল সন্তানের লাশ” কিন্তু এখানে সন্তানের লাশ সমেত একটা পিকাপ ঠেলতে হচ্চে পিতাকে এমন ক্রিয়েটিভ আবেগের কোন তুলনা হয় না।
অভিনয়
এই ছবিতে এমন এমন কিছু অভিনেতা অভিনয় করেছে যাদের অভিনয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। অর্থাৎ অভিনয়ের জন্য সমালোচিত হননা, শুধু প্রসংশাই পান।
ফজলুর রহমান বাবু
যারা নাটক দেখেন তারা এই অভিনেতাকে ভালভাবেই চেনেন । নাটকেও তাকে বিভিন্ন চরিত্রে দেখা যায় । বেশির ভাগ ক্ষেত্র কমেডি চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেলেও মাঝে মাঝে সিরিয়াস নাটক বা চরিত্রে আবির্ভুত হন । এই ছবিতে তার অভিনয় দেখে মুদ্ধ নাহয়ে পারা যায়না । একেবারেই ন্যাচারাল । অভিনয় করছে বলে মনেই হবে না । মনে হবে বাস্তবেই এরকম করছে ।
মোশাররফ করিম
এসময়ের জনপ্রিয়তার অন্য নাম মোশাররফ করিম। তার অভিনয় দেখে অনেকেই সেই চরিত্রে ঢুকে যেতে চায়। “ফইন্নির ঘরের ফইন্নি” ডায়লগটাই তার বড় প্রমান। এছবিতে তাকে দেখা গেছে কিছুটা নেতিবাচক চরিত্রে। তার নিজের জায়গা থেকে তিনি পুরোটা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
শহিদুজ্জামান সেলিম
তার অভিনয়েরও তুলনা হয়না। তিনি রমজান দালাল চরিত্রে ফাটিয়ে অভিনয় করেছেন। তার কিছু কিছু দৃশ্য অনেক দিন মনে থাকবে আপনার।
শতাব্দী ওয়াদুদ
ক্যারেক্টারের মধ্যে যারা অনেক ভালভাবে ঢুকতে পারে তাদের একজন শতাব্দী ওয়াদুদ। ওসি চরিত্রে অনেক তিনি স্মার্ট ভাবে আবির্ভুত হয়েছেন। কখনো গরম কখনো নরম এরমক ভাবেই তার চরিত্রটি এগোয়।
এছাড়াও নিপুন তার চরিত্রে যথেষ্ঠ সাবলিল ছিলেন। জুই করিমও তার সেরাটা দিয়ে অভিনয় করেছেন। ছবির অন্যান্য ছোট ছোট চরিত্র গুলোও অনেক ভাল ছিল।
এই ছবিতে অনেক ডায়লগ বা সংলাপ পাওয়া গেছে যেগুলো সাহিত্য, আবেগ, বাস্তবতা সম্পন্ন। এমন কিছু ডায়লগ হল:
শহিদুজ্জামান সেলিম বলা কিছু উল্লেখযোগ্য সংলাপ :
# এখন যদি আমি বলি যে জানি তাইলেও ডলা দেবেন জানিনা বললেও ফাশায়ই দেবেন।
# ধরা খাইছি রাম ধরা,
# এই এক সমস্যা যতক্ষন বাইচে আছেন অনেক কিছুই করতে হইব ।
# মাল ছাড়া ঢাকা যাইবেধ? সাড়ে তেরো টাকা দিয়া লাশ পার করবেন ?
# এই লাশ সিন্দাবাদের ভুত হইয়া আমাগোরে কান্ধে চইড়া বসছে ।
ফজলুর রহমান বাবু বলা সংলাপঃ
“আমার ছেলের নাম যেদিন হারায় গেছিল গলাকাটা পাসপোর্টে সেই দিনইতো তার মৃত্যু হইছিল। নামই যদি না থাকল তাইলে থাকলকি মানুষটার। আমি নিজ হাতে তার দাফন করব, হোকসে পচা গলা দর্গন্ধময় সেতো আমার সন্তান। হিন্দু মুসলমান খ্রিষ্টান কি যায় আসে। একটা মানুষের বড় পরিচয় হল সে মানুষ। একটা সৎকারের অধিকারতো তার আছে।” গভীর মনোভাব সম্পন্ন ডায়লগ।
“এইটা আমার আছির না, আছির মরে নাই” এক আশা।
”আমার ছেলেটা আপনার মতই দেখতে, তিন তিন জন মারা যাওয়ার পর আমার আছির।” মনে চাপা হতাশা ।
শতাব্দী ওয়াদুদ এর বলাঃ
আপনারা কি লিঙ্গ দেইখা মুর্দা নির্ধারণ করেন? # সব গুলারে এক্সট্রা ডিউটি দিতে হইব
আবুল হায়াত এর বলা : সব আল্লারই খেলা আপনার কোনদিন সন্তান হারানোর ভয় নাই।
মোশাররফ করিম এর বলা : সেতো আমারে দেখেনাই ভুত দেখিছে। # চেহারা ছবি দেখে বোজেন না/ এ কি পুলিসের চেহারা? ঘুস মুস দিয়ে ঢুকিছে।
ভুল
এই ছবিতে এতকিছু ভালোর মাঝেও কিছু ভুল লক্ষ করা গেছে। যেমন শুরুতে মোশাররফ করিমের মোবাইল নিপুন হাতে নিয়ে শহিদুজ্জামান সেলিমকে নিজের বলে নিজের কাছেই মোবাইলটা রেখে দেয়। মোশাররফ করিম যখন ধাওয়া খেয়ে পালায় তখন মোবাইল টা রেখেই দৌড় দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে দেখাযায় মোবাইলটা মোশাররফ করিমের হাতে।
আবার যখন ইতালী প্রবাসী আব্দুল ওয়াহাবের সাথে কথা বলে তখন ওয়াহাব বলছিল “ইটালি যাবার সময় পুরান পাসপোর্টটা রমজান দালাল রেখে দিছিল।” কিন্তু মানুষ কোন জায়গায় যাওয়ার পর বলে “এখানে আসার সময়”। ঐখানে “ইতালি আসার সময় পুরান পাসপোর্ট রমজান দালাল রেখে দিছিল” বললে আরো ভালো হত। তাছাড়া জনসম্মুক্ষে পুলিশের ঘুষ চাওয়াটা বেশ বেমানান লেগেছে। আবার একজন নামকরা আদম ব্যাপারি তার নিজ থানার এস আইকেই চেনেনা। মানতে কষ্টই হয়। এরকম ছোট খাটো ভুল বাদ দিলে ছবি টা অনেক সুন্দর।
যারা এখনো ছবিটি দেখেননি তাড়াতাড়ি দেখে ফেলুন।
আমার পক্ষ থেকে রেটিং ৯.৩/১০ ।