অতীত-বর্তমানে শহীদুল ইসলাম খোকন
এত বাতাস পৃথিবীতে, তবু ফুসফুস ভরাইতে পারে না
– আত্মহত্যার অধিকার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
মানিক বলেছিলেন পৃথিবীর বাতাসের কথা। যে বাতাসে মিশে আছে অক্সিজেন আবার ঐ বাতাসেই আছে বিষাক্ত সীসা। বাতাস তাই দূষিত, নিঃশ্বাস নিতে গেলে ভালোমত নেয়া যায় না।
প্রথম ছবিটিতে দেখুন নিঃশ্বাস নেবার কী অাপ্রাণ চেষ্টা করছেন একজন মানুষ। দেখে মুহূর্তেই মায়া হতে পারে, করুণা জাগতে পারে বা খুব খারাপ লাগতে পারে। মানুষটির নাম শহীদুল ইসলাম খোকন। বর্তমানে লাইফ সাপোর্টে থাকা তাঁর শারীরিক অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে।আমাদের দেশের মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার সফল পরিচালক। তিনি ফুল প্যাকেজ নির্মাতা ছিলেন।সিনেমার মসলা বলতে অালোচনায় যা আসে তার সবকিছুই তিনি রাখতেন। তাঁর মত সৃজনশীল, মেধাবী পরিচালকরা দেশের সিনেমায় একসময়ের স্বর্ণসময়টিকে নিয়ে আসেন। অনেক শিল্পীকে তারকা বা স্টারডম দেবার পেছনে বা দর্শকের ভালোবাসা পাবার উপযুক্ত করে গড়ে তোলেন। একজন বিশ্বমানের শিল্পী হুমায়ুন ফরীদি যখন নাটকে নিজের জাত চেনাচ্ছিলেন তাকে সিনেমাতে ব্রেক দেন তিনি। একের পর এক সিলেক্টিভ ক্যারেক্টারে তাঁকে খলনায়ক হিশেবে অনবদ্য করে তোলেন।তাঁর সিনেমাগুলোর মধ্যে সিংহভাগেই ফরীদি স্যার ছিলেন। নায়ক রুবেলকেও একটা আলাদা গ্রহণযোগ্যতা দেন তিনি। রুবেল তাঁর সিনেমাতেই অ্যাকশন বা কুংফুর স্বতন্ত্র পরিচিতিতে দর্শকের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তিনি বাণিজ্যিক সিনেমার মধ্যে এক্সপেরিমেন্ট করতেন। তাঁর সিনেমাতে প্রেম, বিরহ, মান-অভিমান, নাচ-গান যেমন থাকত সিনেমার প্রয়োজনে তেমনি সিনেমাকে ফোকাস করতে শক্ত রাজনৈতিক মেসেজ দিতেন। সমাজের বিভিন্ন সমস্যাকে সরাসরি ব্যঙ্গ করতেন।সেসবকে প্রতিহত করতে চাইতেন। বিদ্রোহের একটা মেজাজ ছিল তাঁর নির্মাণশৈলীতে। সেসময়ের রাজনৈতিক বা স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সুবিধাবাদী শ্রেণিকে তুলে ধরা তাঁর লক্ষ্য ছিল। তাঁর ‘সন্ত্রাস’ বা ‘ঘাতক’ সিনেমা দুটি এ বাস্তবতাকে ভালোমত তুলে ধরে। ‘ঘাতক’-এ হুমায়ুন ফরীদি স্যারের রাজাকারের ক্যারেক্টারাইজেশন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরে তাই তার সংলাপে ঘুরেফিরে বলা হত ‘পেয়ারা পাকিস্তান। ‘এ ধরনের সংলাপ একটা পিনপয়েন্ট দেয় যেখানে সুবিধাবাদী রাজনৈতিক শ্রেণি সুযোগ বুঝে বসে থাকে আর তার কুকর্ম চালায়। রাজনৈতিক বক্তব্যে খুব সূক্ষ্মভাবে বিভিন্ন অপরাধকে তুলে ধরেন খোকনসাহেব তাই তাঁর সে ধরনের এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমার নামগুলো হয়েছিল এমন- ‘অপহরণ, রাক্ষস, মূর্খ মানব, নরপিশাচ, ঘাতক, ভণ্ড, ঘৃণা, চাই ক্ষমতা। ‘মুখোশ তুলে ধরার সাথে বিদ্রোহের ভাষাতেও তিনি এক্সপেরিমেন্ট করেছেন তাই কিছু সিনেমাগুলোতে নাম ছিল এমন – ‘বীরপুরুষ, বজ্রমুষ্ঠি, উদ্ধার,বিপ্লব, উত্থান পতন, সতর্ক শয়তান, দুঃসাহস, কমান্ডার, যোদ্ধা। ‘তিনি সমস্যা দেখানোর পাশাপাশি সমাধানের দিকেও দৃষ্টি দিতেন। তাঁর সিনেমার ভাষাতে সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্যাকে তুলে ধরে বিদ্রোহের দিকটাও প্রাধান্য পেত।
রাজনৈতিক ছাড়াও রোমান্টিক সিনেমা ফুল প্যাকেজ বাণিজ্যিক ছিল। সেজন্য ‘বিশ্বপ্রেমিক’-ই যথেষ্ট। এ সিনেমা দেশের আবহমান সিনেমাপ্রেমী মানুষ সারাজীবন মনে রাখবে। একটা গানই যথেষ্ট এ সিনেমাকে তুলে ধরতে সেটি হল ব্যতিক্রমী আয়োজনে ভিলেন-নায়িকার রোমান্সে ‘তোমরা কাউকে বোলো না’ গানটি ইতিহাস আজ দেশের সিনেমায়। হুমায়ুন ফরীদি-মৌসুমী রোমান্সে ভিন্নধারার স্বাদ আনতেই এ এক্সপেরিমেন্টটি করা হয়েছে।
খোকন সাহেবের অফট্র্যাক সিনেমা ‘বাঙলা। ‘শাবনূরকে দিয়ে মূল চরিত্রে কাজ করানো অনবদ্য একটি সিনেমা। আহমদ ছফার নামকরা উপন্যাস ‘ওঙ্কার’ অবলম্বনে ‘বাঙলা’ নামকরণে সিনেমাটি নির্মাণ করেন তিনি। এ সিনেমা দেখলে একজন তুখোড় বাণিজ্যিক সিনেমার নির্মাতাকে কোনোভাবেই চেনা যায় না। তিনি তাঁর মত করে নির্মাণ করেছেন আড়ম্বর ছাড়া, একেবারে ধীরে ধীরে। শাবনূরকে দিয়ে তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অভিনয় আদায় করেছেন।
সেই ফুল প্যাকেজ নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন আজ লাইফ সাপোর্টে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ। মরতে তো হবে সবাইকেই কিন্তু সবার মৃত্যুচিন্তায় থাকে একটাই চেতনা সেটা হচ্ছে, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। যখন শহীদুল ইসলাম খোকন অনন্ত জলিলের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন তখনই বোঝা গিয়েছিল তাঁর খোঁজখবর তেমন কেউ রাখে না। সেটি এরকমও বাস্তবতা হতে পারে যাদের জন্য তিনি সিনেমা নির্মাণ করেছেন বা যাদের ক্যারিয়ার গড়ে দিয়েছেন তারাও তাঁর খোঁজ রাখেননা বা রাখেননি। আমাদের রাষ্ট্র তো সিনেমাকেন্দ্রিক সবকিছুতেই অমনোযোগী। যা করা হয় দায়সারাভাবেই। তাই খোকনসাহেবের জন্য লাইফ সাপোর্টই ভরসা।
অতীতের উজ্জ্বল শহীদুল ইসলাম খোকন বর্তমানের সিনেমাজগতকে কানে কানে বলে যাচ্ছেন তাঁর মত মেধাবী, সৃজনশীল নির্মাতার প্রতি অবহেলার ফল ঠিক একইভাবে হয়তো আজকের কাউকে ভোগ করতে হবে।হয়তো তাঁর মত করেই মুখ হা করে থাকতে হবে, মিলবে না বাতাস ভরবে না ফুসফুস..আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে থাকবেন আজ-আগামীর জীবনশিল্পী।