অনন্ত প্রেমের গল্প
‘অনন্ত প্রেম’ যেন একটি অনন্ত চলচ্চিত্র, এটি ছিল রাজ্জাক সাহেবের পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র। তবে পরিচালনায় তিনি প্রথম থেকে জড়িত ছিলেন না, মূলত পরিচালক ছিলেন সে সময়ের গুণী চলচ্চিত্র সম্পাদক মরহুম বশীর হোসেন সাহেব, প্রযোজকও ছিলেন। তবে ছবিটির নির্মাণ শুরুর কিছুদিন পর উনি অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজ্জাক নিজেই শুরু করেন। পরে বশির সাহেব আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজ্জাক পুরো ছবিটিই কিনে নেন এবং পরবর্তীতে তার রাজলক্ষ্মী প্রডাকশনস থেকে মুক্তি দেন।
রাজ্জাকের পাশাপাশি ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন ববিতা, এটিএম শামসুজ্জামান, খলিল, ব্ল্যাক আনোয়ারসহ অনেকে। ‘অনন্ত প্রেম’ মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালের ১৮ মার্চ। ছবিটি ছিল সময়ের তুলনায় বেশ সাহসী। সাহসী এজন্য বলা… শেষ দৃশ্যে রাজ্জাক-ববিতার গভীর চুম্বনের একটি দৃশ্য ছিল যা সেই সময়ে সিনে পাড়া থেকে সিনেমাপ্রেমীদের মনে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল। সে সময়টায় এ রকম একটি দৃশ্যে অভিনয় তারকারা কল্পনাই করতে পারতেন না। শুধুমাত্র ছবিটির বাস্তবিক পূর্ণতার জন্য সম্মত হয়েছিলেন তারা। মূলত চিত্রনাট্যের প্রয়োজনেই এরকম একটি সাহসী দৃশ্য রাখতে বাধ্য হয়ে ছিলেন পরিচালক-অভিনেতা রাজ্জাক।
ছবির শেষ দিকে গভীর অরণ্যে রাজ্জাক-ববিতাকে ধাওয়া করে পুলিশ, পালিয়ে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে মূত্যু হয় তাদের। মৃত্যুর সময় ভালোবাসার শেষক্ষণে পরস্পরকে চুম্বন করেন তারা, পড়ে থাকে তাদের আলিঙ্গনবদ্ধ প্রানহীন দেহ। তবে অনেক দর্শকের আফসোসের কারন হয়ে আলোচিত সেই দৃশ্যটি বাদ দিয়েই ছবিটি মুক্তি দেওয়া হয়, যার কারণ লেখার শেষের দিকে বলা যাবে।
একেবারেই নতুন ভিন্ন গল্পকাঠামো নিয়ে নির্মিত হয় ‘অনন্ত প্রেম’। ছবিতে রাজ্জাক এবং তার তিন বন্ধু খলিল এটিএম শামসুজ্জামান ও ব্লাক আনোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। ববিতাও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। খলিল ববিতাকে পছন্দ করে, কিন্তু ববিতা তাকে পাত্তা দেয় না। সে ক্ষেত্রে খলিলকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে রাজ্জাক, ব্ল্যাক আনোয়ার ও এটিএম শামসুজ্জামান। পরিকল্পনা করতে থাকে কীভাবে ববিতাকে পটানো যায়। সেই মতে নির্জন স্থানে ববিতাকে আক্রমণ করে তিন বন্ধু। আর ববিতার সাহায্যে এগিয়ে আসে খলিল। সাজানো মারামারির কারণে সবাইকে হারিয়ে ববিতার চোখে হিরো হয়ে যায় খলিল।
পরবর্তীতে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ববিতাকে নির্জন জায়গায় নিয়ে ইজ্জত লুটতে চায় খলিল। চিৎকার শুনে রাজ্জাক ও বন্ধুরা এগিয়ে যায়। তবে এবার সত্যিকারের মারামারির একপর্যায়ে রাজ্জাকের হাতে খলিল খুন হয়। ববিতাকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে রাজ্জাক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। ঘটনার সঙ্গে ববিতার নাম জড়ালে তার বদনাম হবে ভেবে রাজ্জাক পুলিশের কাছে বলে টাকা নিয়ে ঝগড়ার কারণে বন্ধুকে একাই খুন করেছে।
পরে পুলিশ হেফাজত থেকে পালিয়ে যায় রাজ্জাক। এ দিকে শৈশবে মাতৃহীন ববিতাকে অত্যাচার-অনাচারের অংশ হিসেবে এক লম্পটের সঙ্গে সৎমা বিয়ে দিতে চাইলে বিয়ের আসর থেকে ববিতাও পালিয়ে যায়। রাজ্জাক ও ববিতা দুজনই পালিয়ে যায় দুদিক থেকে, তবে ট্রেনে দেখা হয়ে যায় তাদের। এবার তারা পালিয়ে চলে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অরণ্যে। যেখানে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা একে অপরের প্রেমে পড়ে যায়, শুরু হয় এক অনন্ত প্রেম কাহিনির যাত্রা। গভীর পাহাড়ি অরণ্যে ভেসে ওঠে মধুর সেই সুর, ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই, তুমি হলে মনের রানি’।
এ দিকে ব্ল্যাক আনোয়ার ও এটিএম শামসুজ্জামান পুলিশের হাত থেকে পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা যায়। ফলে প্রকৃত ঘটনার সাক্ষী দেওয়ার মতো আর কেউ থাকে না। রাজ্জাকের নামে পুলিশের হুলিয়া জারি হয়, হন্য হয়ে পুলিশ খুঁজতে থাকে তাকে। একপর্যায়ে তাদের সন্ধানও পেয়ে যায়, গভীর অরণ্যের মাঝে তাদের ধাওয়া করে পুলিশ। জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যাবার সময় একটি ঝর্ণার কাছে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় দুজনের। মৃত্যুর সময় ভালোবাসার নির্দশন স্বরূপ পরস্পরকে চুম্বন করেন তারা। শেষ পর্যন্ত ঝর্ণার তীরে পড়ে থাকে তাদের আলিঙ্গনবদ্ধ প্রাণহীন দেহ। মূলত এটাই কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘অনন্ত প্রেম’-এর মূল কাহিনি৷
শুরুর দিকে বলেছিলাম ছবির শেষ দৃশ্যের দিকে রাজ্জাক ববিতার একটি চুম্বন দৃশ্য ছিল, যা পরবর্তীতে বাদ দেওয়া হয়। যার একমাত্র কারণ ছিলেন ববিতা। তিনি কিছুতেই এরকম একটি দৃশ্যে অভিনয় করতে রাজি হচ্ছিলেন না, তবে রাজ্জাক সাহেব এমনভাবে বুঝিয়েছিলেন তাতে আর ববিতা দৃশ্যটি না করে থাকতে পারেননি। তবে শুটিংয়ের পরই ববিতা আফসোস করতে থাকলেন, রীতিমত কান্নাকাটি শুরু করেন। ভাবলেন এরকম দৃশ্য দেখলে তো তাকে আর কেউ বিয়ে করবে না। ঠিক তখন রাজ্জাক সাহেব আশ্বস্ত করে ববিতাকে বললেন, ‘আগে তুমি দৃশ্যটি দেখ, যদি ভালো না লাগে এটি বাদ দিয়ে দেবো।’ অবশ্য পরে ববিতা দৃশ্যটির শিল্পরূপ দেখে বাদ না দেওয়ার জন্য বলেছিলেন, কিন্তু তখন রাজ্জাক সাহেব ববিতার ভবিষ্যতের কথা ভেবে দৃশ্যটি আর রাখেননি। তিনি ভেবেছিলেন এরকম একটি দৃশ্যের জন্যে হয়তো ববিতার ভবিষ্যতের উপর কোন প্রভাব পড়তে পারে। সহশিল্পীর প্রতি এমন দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসা দেখিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের রাজ্জাক-ববিতারা।
তবে ছবি মুক্তির আগে এক বিবৃতিতে রাজ্জাক এটাও বলেন, আমার ছবির শেষ দৃশ্যে একটি চুম্বন দৃশ্য ছিল। পত্রিকায় সে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর আমার অগণিত ভক্ত, অনেক মা-বোন ব্যক্তিগতভাবে অনেক চিঠি এবং টেলিফোনে আমার কাছে প্রশ্ন রেখেছেন যে, চুম্বন দৃশ্যটি ছবিতে না থাকলেই কি নয়? আমি পুরো ছবিটি আবার দেখে উপলব্দি করলাম যে চুম্বন দৃশ্য না থাকলে ছবির এতটুকুও সৌন্দর্যহানি হয় না। ঐটুকু ছাড়াই এ ছবি দর্শকদের ভালো লাগবে। তাই ভক্ত এবং মা-বোনদের অনুরোধ রক্ষার্থে আমি চুম্বন দৃশ্য বাদ দিয়ে দিয়েছে।
তূমুল দর্শকপ্রিয় ছবিটির সবকটি গানও পেয়েছিল সমান জনপ্রিয়তা। সংগীত পরিচালক ছিলেন আজাদ রহমান সাহেব, অবশ্য ‘ঐ আকাশ যতদিন থাকবে, এই পৃথিবী যতদিন থাকবে, আমি যে তোমারই থাকবো’ গানটির পরিচালক ছিলেন জনাব খন্দকার নূরুল আলম সাহেব, গীতিকার ছিলেন কাজী আজিজ আহমেদ সাহেব৷
আজাদ রহমানের সুরে ‘আলো তুমি নিভে নিভে যাও যাও’, ‘ঐ কোর্ট কাচারির এমনই রায়’, ‘তোমারই কাছে আমি বারবার আসবো’, ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই’ গানগুলো এখনো সমান জনপ্রিয়। বিশেষ করে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখায় খুরশীদ আলম ও সাবিনা ইয়াসমিনের কন্ঠে ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি’ গানটি সময়ের স্পর্শকে বাঁচিয়ে রেখে বাংলা চলচ্চিত্রের একটি ক্ল্যাসিক গানে পরিণত হয়েছে। গানটির শুটিং হয়েছিল কাপ্তাইয়ের অসাধারণ সুন্দর সব লোকেশনে!
নিম্মে গানটির কথা তুলে ধরা হলো—
ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই
তুমি হলে মনের রানি
তোমার দৃষ্টি যেন ছোবল হানে
যখন তখন শুধু আমার প্রাণে, ওরে কালনাগিনী
ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই
আমি হলেম কলঙ্কিনী
আমার অঙ্গ ঢাকে আটপৌরে শাড়ি
মনটা থাকে সদায় বাহির বাড়িতে, ওরে উদাসিনী
ভেবেছিলাম প্রেমানলে মন পোড়াবো না
শেষে যে কলিজাতে ঘুণ ধরাতে হলো
মনেরই চোর গলিতে আসতে তো চাইনি
সোনার হরিণ তবু আমায় ডেকে নিয়ে এলো
এই সোনার হরিণ তবু আমায় ডেকে নিয়ে এলো!
ও বন্ধু চোর গলিতে না এলে
আমি হতেম বিরহিনী
ঐ বাঁশী যদি না হত বাঁশী
নিজের ঘরে হতেম পরবাশী
কেঁদে একাকিনী!
ভেবেছিলাম নাইতে এসে চুল ভেজাবো না
শেষে যে অথৈ জলে ডুবে যেতে হলো
আমি যাকে প্রেম বলে গলায় পড়েছি
লোকে বলে পোড়ামুখীর জাত কূল মান গেল
সজিনী কূল ছেড়ে গো না এলে
তুমি হতে অভাগিনী
এই যৌবনে কেউ না এলে কাছে
এত রূপের কি দাম বল আছে গো
হতে সন্যাসিনী!
নান্দনিক পোস্টার কৃতজ্ঞতায়: ফারুক আহমেদ পিজু ও গোলাম সারওয়ার।
……………………………………………………………………………………………………………………….
ফুটনোট: অনন্ত প্রেম’ সম্পর্কে আমার লেখা ‘চিত্রসম্পাদক বশীর হোসেন’ বইতে আছে – ১৯৭৪ সালে খান আতাউর রহমান চিত্রনাট্যকার ও গীতিকার কাজী আজিজ আহমেদ (জন্ম ১৯৩৯-) কে দিয়ে ‘অমর প্রেম’ নামে একটি চিত্রনাট্য রচনা করান। চলচ্চিত্রটি তিনিই নির্মাণ করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু বশীর হোসেন চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করতে চাইলেন। রাজী হলেন খান আতা। একই সময় একই নামে পরিচালক আজিজুর রহমান একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করলে বশীর হোসেন নাম পরিবর্তন করে ‘অনন্ত প্রেম’ নাম দিয়ে নিজের প্রযোজনা সংস্থা থেকেই চলচ্চিত্রটি বানাবেন সিদ্ধান্ত নিলেন। এজন্য অর্থনৈতিক লেনদেনে অভিজ্ঞ ছোট ভাই মোহাম্মদ আবু তাহের মুন্সি কে অফিস দেখাশোনার জন্য দায়িত্ব দিলেন।
রেজা লতিফের চিত্রগ্রহণে রাজ্জাক, ববিতা ও অন্যান্যদের নিয়ে কিছুদিন স্যুটিংও করলেন বশীর হোসেন। এসময় তার অসুস্থতা, সম্পাদনা কাজের ব্যস্ততা এবং অর্থনৈতিক কারন প্রভৃতির জন্য কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অপর দিকে তখনকার তুমুল জনপ্রিয় নায়ক রাজ্জাক বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করলেও তখন পর্যন্ত কোন চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন নি। তিনি ‘অনন্ত প্রেম’ চলচ্চিত্রটি পরিচালনায় আগ্রহী হলেন। তিনি প্রথমে বশীর হোসেনের প্রযোজনাতেই পরিচালনা শুরু করলেও পরবর্তীতে বশীর হোসেনের কাছ থেকে চলচ্চিত্রস্বত্ব কিনে নিয়ে, সুরকার খন্দকার নুরুল আলমের পরিবর্তে আজাদ রহমানকে নিয়ে কিছু গান পরিবর্তন করে এবং কাজী আজিজ আহমেদকে দিয়ে চিত্রনাট্যের কিছু অদল বদল করে নির্মাণ করলেন।
রাজ্জাকের প্রযোজনা পরিবেশনা সংস্থা ‘রাজলক্ষী প্রডাকসন্স’ থেকে মুক্তি পাওয়া ‘অনন্ত প্রেম’ (১৮/০৩/১৯৭৭) চলচ্চিত্রটি বেশ কয়েকটি কারণেই একটি আলোচিত চলচ্চিত্র।
– চলচ্চিত্র গবেষক মীর শামসুল আলম বাবু।