অন্ধকারের আলো: দাপুটে নায়িকা শাবনূর
২০০৫ সাল। মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারের মঞ্চে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার দিতে গিয়ে রাজ্জাক বলেছিলেন ‘আমি এখন যার নাম ঘোষণা করছি, সে এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা,আর সে হচ্ছে শাবনূর’। নায়করাজের কাছ থেকে এরূপ সম্বোধন শুনে আনন্দে উচ্ছ্বসিত সেই জনপ্রিয় নায়িকা ‘মোল্লা বাড়ির বউ’ ছবির জন্য পুরস্কার নিতে মঞ্চে ওঠেন। যার নামের অর্থ ‘অন্ধকারে আলো’।
তুমি মোর জীবনের ভাবনা কিংবা এই বুকে বইছে যমুনার গানে ভালোবাসার জয়গান যেমন গেয়েছেন, তেমনি ‘একাত্তরের মা জননী’ গানে গেয়েছেন মুক্তি সংগ্রামীর জয়গান। আনন্দ অশ্রুর দুলির চপলতা পেরিয়ে নিরন্তরের নিশিকন্যা ‘তিথি’, সবটাতেই তিনি অনন্যা। ভক্তদের কাছে যেন ‘অনেক সাধনার পরে’ পাওয়া কোনো আকাঙ্ক্ষিত নায়িকা, যাকে সবাই ‘দুই নয়নের আলো’ করে রাখেন। একের পর এক সুপারহিট সিনেমা দিয়েছেন, নানা চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে করেছেন নন্দিত। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম যুগান্তকারী সেরা জনপ্রিয় নায়িকা ‘শাবনূর’।
ক্যাপ্টেন এহতেশামের ‘চাঁদনী রাতে’র মাধ্যমে যে মেয়েটি চলচ্চিত্র জগতে পা আলো ছড়াতে চেয়েও পারেননি,পরবর্তীতে সেই মেয়েটিই নব্বই পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় চিত্রতারকার খেতাব পান। দুনিয়ার বাদশাহ,তুমি আমার ছবির মাধ্যমে হিটের তকমা পেলেও ক্যারিয়ারের জয়যাত্রা শুরু হয় ‘স্বপ্নের ঠিকানা’র মাধ্যমে। এই সিনেমার ‘সুমি’ চরিত্রের মাধ্যমে তিনি দর্শক থেকে পরিচালক মহলে অন্যরকম প্রভাব ফেলেন। এরপর তোমাকে চাই, স্বপ্নের পৃথিবী, আনন্দ অশ্রুর মাধ্যমে জানান দেন, ভবিষ্যতে তিনিই হচ্ছেন শীর্ষ নায়িকা। সালমানের অকাল মৃত্যুতে হোঁচট খেলেও রিয়াজের সঙ্গে জুটি বেঁধে বহু দর্শকনন্দিত ছবি উপহার দেন। অশ্লীলতা সময়ে এই জুটি ছিল স্বস্তির নিঃশ্বাস। কাটপিসের সেই যুগে ‘শাবনূর যুগ’ ছিল রুচিশীল দর্শকদের কাছে আস্থার নাম। তখনকার সুপারস্টার ইলিয়াস কাঞ্চন, রুবেল, মান্নাদের সঙ্গে যখন কাজ করতে সমসাময়িক নায়িকারা মুখিয়ে থাকত, সেখানে তিনি তাদের এড়িয়েই যেতেন। এতে দাম্ভিকতার পরিচয় দিলেও তিনি সফল হয়েছেন।
অমর নায়ক সালমান শাহর সঙ্গে তাঁর জুটি ছিল যেন মণিকাঞ্চন যোগ। রিয়াজ তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সুবর্ণ সময় কাটিয়েছেন শাবনূরের সঙ্গেই। ফেরদৌস বেশ সংখ্যক ব্যবসাসফল ছবির নায়ক হয়েছেন, শাবনূর তাঁর সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন বলেই। যে শাকিব খান এখন চড়া পারিশ্রমিক ছাড়া ছবি সাইন করেন না, সেই শাকিবই বিনা পারিশ্রমিকে শাবনূরের সঙ্গে কাজ করেছেন। ক্যারিয়ারের প্রায় এক দশক পর মান্নার বিপরীতে অভিনয় করে ‘স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ’র মতো সুপারহিট ছবি উপহার দেন। অমিত হাসান তাঁর সঙ্গে সিনেমা করার জন্য পাথরে ফুল ফোটাতে পারেন কিংবা খোঁপায় তারার ফুল দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন ক্ষণিকের আলো হয়ে আসা শাকিল খান!
বিয়ের ফুল, কাজের মেয়ে, এ বাঁধন যাবে না ছিঁড়ে, ফুল নেবো না অশ্রু নেবো, প্রেমের তাজমহল, বউ শাশুড়ির যুদ্ধ, মোল্লা বাড়ির বউ, আমার স্বপ্ন তুমিসহ বহু ব্যবসাসফল ছবির নায়িকা ভিন্ন ধারার ছবিতেও নিজের জাত চিনিয়েছেন, করেছেন বাঙলা, চার সতীনের ঘর, নিরন্তর, কাল সকালে’র মতো প্রশংসিত চলচ্চিত্র। তবে আক্ষেপ একটাই এখনো রবি বা শরৎবাবুর নায়িকা চরিত্রে এখনো দেখা যায়নি তাকে।
আমার হৃদয় একটা আয়না, সাগরের মতো গভীর থেকে ওগো আমার সুন্দর মানুষ, তুমি আমার মনের মানুষসহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের নায়িকা তিনি। বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় গানের ক্ষেত্রেও ‘শাবনূর’ নামটি স্বাতন্ত্র্য হয়ে আছে। বেশির ভাগ ছবি রোমান্টিক ধারার হওয়ায় গানের প্রতি আলাদা যত্ন নেয়া হতো।
বাংলা চলচ্চিত্রে ‘সুপারস্টার’ খেতাব পাওয়া এই জনপ্রিয় নায়িকা ২০০৬ সাল থেকেই মুটিয়ে যাওয়া শুরু করেন। শাকিব খানের সাথে ব্যবসাসফল ছবি উপহার দিলেও ধীরে ধীরে বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকেন, সিনেমা নির্বাচনেও ভুল করেছেন। দর্শকেরা সেই শাবনূরকে আর খুঁজে পায়নি, তাই শেষটা ভালো হয়নি। আশা করি, খুব শীঘ্রই ‘কাঁটাতারের বেড়া’ পেরিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে আবার তাঁর সফল প্রত্যাবর্তন ঘটবে।
ব্যবসাসফল ছবি উপহার দেয়ার পাশাপাশি বহু পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পুরস্কার মেরিল প্রথম আলোতে দশবার সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতে রেকর্ড করেন। ক্যারিয়ারের মাত্র দুই বছরের মাথায় বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন, পরবর্তীতে এই পুরস্কার আরো পাঁচবার অর্জন করেন। তবে হতবাক হলেও সত্যি, দর্শকনন্দিত এই নায়িকা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন মাত্র একবার। ‘দুই নয়নের আলো’ এর মাধ্যমে সেই অধরাটা পূর্ণ করেন। এরপর বাঙলা, নিরন্তরের জন্য পুরস্কার প্রাপ্য হলেও জুরি বোর্ডের দূরদর্শিতার অভাবে (?) জাতীয় পুরস্কার আর পাওয়া হয়ে উঠেনি। বর্ণিল এই ক্যারিয়ারে অন্তত আরো কয়েকবার জাতীয় পুরস্কার হাতে উঠুক এই কামনা করি।