অন্ধকার ঢাকা
নাম : লাইভ ফ্রম ঢাকা
ধরন : ড্রামা
পরিচালক : আব্দুল্লাহ মোহাম্মাদ সাদ
প্রযোজনা : খেলনা ছবি প্রডাকশন
অভিনয় : মোস্তফা মনোয়ার (সাজ্জাদ), তাসনুভা তামান্না (রেহানা), তানভীর আহমেদ চৌধুরী (মাইকেল), মোশাররফ হোসেন প্রমুখ।
শুভমুক্তি : ২৯ মার্চ, ২০১৯
ভাষা : বাংলা
নামকরণ : ছবিতে মূলত রাজধানী ঢাকার একটি বিশেষ সময়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যখন ঢাকার শেয়ারবাজারে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ধস নামে। সেই সময়কার ঢাকার সার্বিক পরিস্থিতি এক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীর দর্শনানুসারে তুলে ধরা হয়েছে।
তাই নামটি যথার্থ মনে হয়েছে, তবে এক্ষেত্রে বাংলা শব্দের ব্যবহার থাকলে নামটি আরো শ্রুতিমধুর হতো।
কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ : কাহিনী লিখেছেন পরিচালক নিজেই। খুবই সহজ-সরল ভাষায় গল্প উপস্থাপন করায় তেমন কিছু আলোচনা করছি না।এ কথায় বলা যায়, সেসময়কার দেশের পরিস্থিতি নিয়ে, যেটির ওপর এছবির ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে।
২০১০/১১ সালের দিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ স্মরণকালের সেরা দরপতনের সাক্ষি হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কখনোই শেয়ারবাজারে এমন ভয়াবহ ধস নামেনি। হাজার হাজার বিনিয়োগকারী কয়েক মিনিটের ব্যবধানে চোখের সামনে নিজেদের দেউলিয়া হতে দেখেন। সর্বহারা হয়ে তারা রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল করেন, পুলিশের সাথে হামলা-পাল্টা হামলাও হয়। পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ছুড়ে কয়েকদফা বিনিয়োগকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়, বিক্ষোভের গতিও পরবর্তীতে কমে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে এই সর্বহারা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে খুব কমই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।
এই বিনিয়োগকারীদের একজন গল্পের মূল চরিত্র, সাজ্জাদ। তিনিও অন্য সবার মতো দেউলিয়া হয়েছেন, রয়েছে শুধু তার পুরোনো মডেলের গাড়িটি এবং কিছু জমানো টাকা। কীভাবে মাথা তুলে দাঁড়ান, অদৌ দাঁড়াতে পারেন কিনা, সময়ের সাথে সাথে সেটিই গল্পের বাকি অংশে দেখা যায়।
গল্পের আইডিয়া অন্য যেকোনো ছবির থেকে আলাদা, নিঃসন্দেহে একথা বলাই যায়। সেইসাথে ছবির চিত্রনাট্যও যুতসই ছিল।ছবির প্রথমাংশে গল্পের চরিত্রগুলি একে একে তৈরি হয়েছে। আর দ্বিতৗয়াংশে চরিত্রগুলোর কি পরিণতি হয় তা দেখানো হয়েছে।
গতানুগতিক সব ছবির তুলনায় এছবিতে সংলাপের পরিমাণ কিছুটা কম, প্রয়োজন ব্যতিরেকে কোনো চরিত্রই অযথা বকবক করে না। কিছু ক্ষেত্রে গালিগালাজের ব্যবহার থাকলেও তা পরিস্থিতি অনুসারে এসেছে, তাই ক্লিশে লাগেনি।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৮০
পরিচালনা ও অভিনয় : পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মাদ সাদ তার প্রথম পরিচালনায় সহজ-সরল নির্মাণের সাথে জটিল চিন্তাভাবনার সেতুবন্ধন ঘটিয়ে আমাদের একটি গল্প দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সে চেষ্টায় তিনি সফলও হয়েছেন। দেখিয়েছেন সরল নির্মাণভাষা দিয়েও দর্শকদের গভীর চিন্তায় ডুবিয়ে ফেলা যায়। কিছু কিছু দূর্বলতা বাদ দিলে বাকি সব দিক থেকেই তিনি অনেক ভালো দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
মোস্তফা মনোয়ার এর আগে ছোটপর্দায় কাজ করলেও তেমন একটা দেখা হয়নি। এবারই প্রথম তার কোনো কাজ দেখলাম। সাজ্জাদ চরিত্রে পুরো ছবি জুড়েই তিনি ন্যাচারাল অভিনয় করে গেছেন। সাজ্জাদ সব হারিয়ে নতুন পথ খুঁজছে, ধীরে ধীরে তিনি বজমেজাজী হয়ে উঠছেন, সে কথায় কথায় গার্লফ্রেন্ডকে সন্দেহ করে, মারধর করে, আবার নিজের ভুল বুঝতে পারলে তার সাথে ভাব করে নিচ্ছে, তার ছোট ভাই বেয়াদবির সীমা অতিক্রম করলেও তিনি একটা সময় পর্যন্ত অভিভাবকের মতো পাশে থেকেছেন… এ রকম গুরুত্বপূর্ণ সিচ্যুয়েশনগুলোতে তার এ্যাকটিং একদম পারফেক্ট ছিল, মোটেও অতিরঞ্জিত লাগেনি।
রেহানা নামক চরিত্রে তাসনুভা তামান্নাও স্বাভাবিক অভিনয় দেখিয়েছেন। সে সাজ্জাদকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে। চাকরিজীবী হলে যতটুকু সম্ভব সে সাজ্জাদের খেয়াল রাখে। তার অভিনয় মোটামুটি ভালো লেগেছে।
তানভীর আহমেদ চৌধুরীর অভিনয় করা ‘মাইকেল’ চরিত্রটিও এছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বড়ভাই সাজ্জাদের প্রতি তার আলাদা এক ক্ষোভ জমে আছে, যার কারণে সে কখনোই তার সাথে ভালো আচরণ করে না। তার ওপর সে মাদকাসক্ত, রিহ্যাবে গেলেও পরবর্তীতে পালিয়ে যান। দফায় দফায় বড়ভাই এর সাথে ঝগড়া হয়, আবার দিনশেষে ভাইয়ের কথা মনে পড়লে ঠিকই জড়িয়ে ধরেন। মাদকাসক্তের চরিত্রে তার অভিনয়ও মোটামুটি ভালো ছিল।
ছবির অন্যান্য চরিত্রগুলো গল্পের প্রয়োজনে টুকটাক এসেছে, তাই ডালপালা মেলার তেমন সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তবে এসব চরিত্রে যারা ছিলেন তারা ঠিকঠাক অভিনয় করে গেছেন।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৯০
কারিগরি : ছবিটি যে স্বল্প বাজেটের পর্দায় তার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে, এটাই এ অংশের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা। যদিও সাদাকালো ফর্মেটের হওয়ায় কিছুটা ভুলভ্রান্তি ঢেকে দেওয়া গেছে, কিন্তু কতই বা ঢাকা যায়।
ছবিতে ক্যামেরার কাজ খুব একটা আহামরি ছিল না, বেশ কিছু শর্ট দেখে মনে হলো ডিএসএলআর দিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে একবারে খারাপও হয়নি। সম্পাদনার কাজ মোটামুটি ভালো হয়েছে। ছবিতে কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার করা হয়নি, স্বাভাবিক শব্দটাই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সেটিও মোটামুটি ভালোই ছিল, তবে কিছু কিছু সিচ্যুয়েশনে বিজিএম এর অভাব বোধ করেছি। কালার গ্রেডিং এর কথা তো আগেই বললাম, ছবিটি ৭০ মি.মি ফর্মেটে হলেও সাদাকালো। এতে ছবিতে একটা ক্লাসি ফ্লেভার এসেছে।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৭০
বিনোদন ও সামাজিক বার্তা: ছবিতে বিনোদন বলতে আমরা যেরকম বিনোদন বুঝি, তেমনটার ছিটেফোঁটাও নেই। খুবই গভীর চিন্তাধারার ছবি এটি। গল্প চলাকালীন সময়েই এটি আপনাকে ভাবাবে, এমনটা কেন হলো, এটা কেন হলো না… এমন। সেইসাথে ছবিটি বেশ ধীরগতির। একদমই আমাদের বাংলা ছবিগুলো থেকে আলাদা।
ছবিতে যে সামাজিক বার্তাটি দেওয়া হয়েছে সেটিও বেশ গভীর। আমরা বাঙালিরা জন্মগতভাবেই অন্যকে গাছের উপর থেকে মাটিতে নামানোতে পারদর্শী। আবার নতুন করে কেউ গাছে উঠলে তাকেও নিচ থেকে টেনে ধরতে পারি। সামান্য লাভের খাতিরে একে অন্যকে ধোকা দেই। যার দরুণ আমাদের রাজধানী ঢাকা অন্ধকার, কলুষিত।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৯০
ব্যক্তিগত : ছবিটি সিঙ্গাপুরের ২৭তম চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়ে দুইটি পুরস্কার জিতে এসেছে, আর নিজের দেশে পেয়েছে একটি থিয়েটারে দিনে দু/তিনটি শো। তাও সপ্তাহখানেকের জন্য। এ ব্যর্থতার দায়ভার আমাদেরই। বিশেষ করে আমাদের সিনেমা দেখার পরিবেশের। ছবিটি দেখার পর যা উপলব্ধি করলাম, স্বল্পবাজেটের এ ছবিটি আমাদের ঘোলা পর্দা এবং ভাঙ্গা এ্যানালগ কোয়ালিটির সাউন্ডবক্সওয়ালা হলে মোটেও চালানোর জন্য উপযুক্ত না। খুব বড়জোর স্টার সিনেপ্লেক্স, যমুনা ব্লকবাস্টার এবং সিলভার স্ক্রিন মিনিপ্লেক্সেই এমন ছবি চলতে পারে। এটি মোটেও সিঙ্গল স্ক্রিনের ছবি না।
সবমিলিয়ে বলবো ছবিটিতে কারিগরি দূর্বলতা থাকলেও একটা অন্যরকম ফ্লেভার আছে। এমন স্বাদ আমাদের উপমহাদেশের ছবিতে একদমই পাওয়া যায় না।
রেটিং : ৮.৫/১০
ছবিটি কেন দেখবেন : ধীরস্থির চিন্তাধারার কোনো ছবি দেখতে চাইলে এ ছবি সম্পূর্ণ আপনার জন্য। আর যদি আমার মতো মুভিপোকা হন, তাহলে অবশ্যই হলে গিয়ে দেখে আসুন। কারণ আমাদের জেনারেশন সাদাকালো যুগের ছবি সিনেমাহলে দেখার সুযোগ পায়নি। যারা পেয়েছেন তারা নিশ্চিত ঐ সময়টাকে মিস করেন। তাই প্রথমবার বড়পর্দায় সাদাকালো ছবি দেখার কিংবা যারা আগে দেখেছেন তাদের পুরোনো সুখস্মৃতি মনে করার এমন সুবর্ণসুযোগ মিস করবেন না। ভবিষ্যতে হয়তো এমন সুযোগ না-ও পেতে পারেন।