Select Page

অপুর রাজত্ব

অপুর রাজত্ব

ApurSansarEnding

সম্পাদকের নোটঃ বাংলা মুভি ডেটাবেজ (বিএমডিবি)-তে সাধারণভাবে বাংলাদেশী ব্যতীত অন্যান্য দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে কিছু প্রকাশ করা হয় না। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রগুলো ভৌগলিকভাবে ভারতীয় চলচ্চিত্র হলেও বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করার জন্য অল্প যে কজন বাঙ্গালী চলচ্চিত্র নির্মাতা বিশাল ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে সত্যজিত রায়, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তাই এ সকল নির্মাতা ও তাঁদের সৃষ্টি সম্পর্কে ব্লগ বা রিভিউ প্রকাশের ব্যাপারে বিএমডিবি তার সাধারণ নীতিমালা শিথিল করে। আশা করি বাংলাদেশী চলচ্চিত্রপ্রেমিরাও ব্যাপারটিকে সেভাবে গ্রহণ করবে। ধন্যবাদ।

সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’ কে আমি গল্পের পারস্পেক্টিভে তিনভাবে বর্ণনা করতে পারি। পথের পাঁচালীর ক্ষেত্রে গল্পে ‘বাস্তবতা’… অপরাজিত’র ক্ষেত্রে গল্পে ‘আবেগ’… এবং অপুর সংসারের ক্ষেত্রে গল্পে ’চূড়ান্ত পরিণতি’।

অনেক প্রখর সমালোচক সত্যজিতের স্টোরিটেলিং নিয়ে এক সময় প্রখর সমালোচনা করেছেন, এখনও করেন। যেমন, সত্তরের দশকের মার্কিন চলচ্চিত্র সমালোচক স্ট্যানলী কফম্যান এ সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, “সত্যজিতের কিছু সমালোচকেরা প্রায়ই মনে করে থাকেন যে, তিনি বোধহয় সবসময়ই তার গল্পের চরিত্রগুলো নিয়েই বেশী মেতে থাকেন, চরিত্রগুলোর জীবনের নাটকীয় বিন্যাসের দিকে তিনি মনে হয় ভ্রুক্ষেপই করেন না”।

আবার এক বাঙ্গালী সমালোচক বলেছিলেন একবার, “সত্যজিতের চলচ্চিত্রগুলোর গল্প মাত্রাতিরিক্ত ধীরগতির, যেন অনেকটা ‘রাজকীয় শামুক’ -এর চলার মতো”।

এর অবশ্য একটা অসাধারন জবাব দিয়েছিলেন কিংবদন্তী জাপানী চলচ্চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া। তিনি বলেছিলেন, “সত্যজিতের গল্পগুলো মোটেই ধীরগতির নয়, বরং এদের অনেকটা শান্তভাবে বহমান নদীর সাথে তুলনা করা যেতে পারে”। তিনি আরো যোগ করেন, “সত্যজিতের চলচ্চিত্রগুলো না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র-সূর্য না দেখা একই কথা”।

সত্যজিতের আমি বিশেষ ভক্ত কয়েকটা কারণে… তার গল্প ও চরিত্রসমূহের সরল উপস্থাপন… গল্প ও চরিত্র দ্বারা সৃষ্ট ঘটনাগুলো দেখার সময় আপনার শুধু মনে হবে, এ যেন আমাদের পাড়ারই গল্প, আমাদের পরিবারেরই গল্প। গল্পে মানবতাবাদের আকুলতা প্রবল । চরিত্রগুলোর বাহ্যিক উপস্থাপন খুবই সরল, কিন্তু এদের ভেতরকার মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব জটিল ও ভয়াবহ। বিশেষ করে ‘অপরাজিত’ (১৯৫৭), ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ (১৯৬২), ’কাপুরুষ’ (১৯৬৫), ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৭০), ‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১)… চলচ্চিত্রগুলো দেখে থাকলে ব্যাপারগুলো বুঝতে পারবেন সাধারনভাবে, যারা গল্পে আকস্মিক প্লট বিন্যাস খোজেন, তারা সত্যজিতের চলচ্চিত্রগুলো দেখে হতাশ হতে পারেন, এটা অনুমান করাই যায়।

চিন্তা করা যায়… পথের পাঁচালীর গল্পের শেষে একটা হ্যাপি এন্ডিং এর অনুরোধ করেছিলো তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার! যেটা রাখা সম্ভব হয়নি সত্যজিতের পক্ষে। এমনকি দেশের বাইরের এক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এক প্রখ্যাত প্রোডাকশন থেকে পথের পাঁচালীর চিত্রনাট্য বিক্রির প্রস্তাবও এসেছিলো, কিন্তু সত্যজিৎ যে নাছোড়বান্দা… তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, এই পথের পাঁচালী-ই তার জীবন বদলে দিতে চলেছে। তিনি কি আর এতো সহজেই জীবনের সেরা কীর্তি নির্মাণের সুযোগ ছেড়ে দেবেন!

যেভাবে শুরু হলো ‘অপু’র পথচলাঃ

গল্পের শুরুটা ঠিক ১৯৪৩/৪৪ এর দিকে। তখন তরুন সত্যজিৎ এক নামকরা প্রকাশনী সংস্থার মালিক ডি কে গুপ্ত’র অফিসে প্রচ্ছদের কাজ করতেন। একদিন গুপ্ত’দা এসে জানালেন যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের একটা কিশোর সংস্করন ‘আম আটির ভেঁপু’ নামে প্রকাশ করা হবে। এর প্রচ্ছদ ও ভেতরকার বিভিন্ন দৃশ্যের ছবি আঁকতে হবে, এবং সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে। সত্যজিৎ তখনও পথের পাঁচালী উপন্যাসটা পড়েননি এবং সেটা জানতে পেরে গুপ্ত’দা দারুন অবাক হন। তিনি সত্যজিৎকে ‘জোরপূর্বক’ অনুরোধ করেন অতিসত্তর উপন্যাসটা পড়ার জন্য। অবশেষে অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার পথের পাঁচালী পড়ে ফেললেন সত্যজিৎ। পড়ার পর গুপ্ত’দা ফিডব্যাক চাইলে শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করেন তিনি, ‘অপূর্ব’! তখনই জীবনের প্রথম চলচ্চিত্রের উপজীব্য/প্লট চূড়ান্ত করে ফেলেন সত্যজিৎ।

এরপর মোটামুটি অনেকগুলো বছর কেটে যায়। ১৯৪৯ -এ কলকাতায় নিজের নতুন চলচ্চিত্রের লোকেশন দেখতে আসেন প্রখ্যাত ফরাসী চলচ্চিত্র পরিচালক জ্যঁ রেনোয়া। সত্যজিৎ ও তার প্রতিষ্ঠিত ‘কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি’র চলচ্চিত্রপাগল ছেলেপেলেরা রেনোয়াকে তখন সাহায্য-সহযোগিতা করছিলো। কাজ আর ঘোরাঘুরির মধ্যেই রেনোয়ার আস্থাভাজন প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন সত্যজিৎ। আধুনিক ও বাস্তববাদী চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র-দর্শন সম্পর্কে সত্যজিতের জ্ঞান ও ধারনা দেখে ভীষন অবাক হন তিনি। তখনই রেনোয়াকে পথের পাঁচালী নির্মাণের জন্য নিজের পরিকল্পনার কথা জানান সত্যজিৎ। শুনে খুব খুশিই হন রেনোয়া এবং নিজস্ব সংস্কৃতির একটা বাংলা উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনার প্রশংসা করেন তিনি। পরবর্তী জীবনে অবশ্য সত্যজিৎ বহুবার এই ফরাসী পরিচালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

এর মধ্যে ১৯৪৯ সালের ৩রা মার্চ পারিবারিক ভাবেই সম্পর্কে মামাতো বোন বিজয়া কে বিয়ে করে জীবনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস অবশ্য খেলে ফেলেন সত্যজিৎ। সদ্য বিয়ে করা বউকে নিয়ে বিয়ের কয়েকমাস পরেই কোম্পানীর একটা কাজে হঠাৎ লন্ডন যেতে হয় তাকে। অবশ্য আকস্মিক এই লন্ডনযাত্রা টা ছিলো সমুদ্রপথে। যেতে লেগেছিলো প্রায় ১৬ দিন। জাহাজে যেতে যেতেই পথের পাঁচালীর মোটামুটি একটা খসড়া চিত্রনাট্যও তৈরী করে ফেলেন তিনি। যদিও পথের পাঁচালীর কোন পূর্ণাঙ্গ চিত্রনাট্য ছিলো না। তিনি চলচ্চিত্রটির জন্য দৃশ্য তৈরী করেছিলেন তার ‘আম আটির ভেঁপু’ (পথের পাঁচালীর কিশোর সংস্করণ) বইয়ের জন্য আঁকা বিভিন্ন দৃশ্যের ছবিসমূহ এবং বর্ণনামূলক টীকার মাধ্যমে। ব্যাপারটা কিন্তু ইন্টারেস্টিং…

যাই হোক, সত্যজিতের প্রবল ইচ্ছা ছিলো, স্বয়ং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে সাক্ষাত করে পথের পাঁচালী উপন্যাসের গ্রন্থস্বত্ব কেনার ব্যাপারে কথা বলবেন। কিন্তু সে আশা তার পূরণ হয়নি । ১৯৫০ -এ হঠাৎ করেই মারা যান বিভূতিভূষণ । ফলে পথের পাঁচালী নির্মাণে একটা অনিশ্চয়তা উঁকি মারছিলো সত্যজিতের মনে। কারণ, পথের পাঁচালী উপন্যাসের গ্রন্থস্বত্ব কেনার জন্য ইতিমধ্যে অনেক প্রযোজক-পরিচালকই বিভূতিভূষণের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তবে, বিভূতিভূষণের স্ত্রী সত্যজিৎকে বিশেষ স্নেহ করতেন, কারণ সত্যজিৎদের পরিবারের সাথে বিভূতিভূষণ পরিবারের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক ভালো ছিলো। যেকারণে বিভূতিভূষণের স্ত্রী নিশ্চিন্তমনেই পথের পাঁচালীর গ্রন্থস্বত্বটা সত্যজিৎকেই দেন। সত্যজিৎও যেন অনেকটা হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। অবশ্য তখন অনেক প্রযোজক-পরিচালকই একজন আনকোরা-নতুন-নাদান পরিচালকের হাতে পথের পাঁচালীর মতো একটা ধ্রুপদী উপন্যাসের ভাগ্য তুলে দেওয়ার জন্য বিভূতিভূষণের স্ত্রী’র সমালোচনা করেছিলেন। তাতে কি আসে যায়, ওই আনকোরা-নাদান সত্যজিতের উপরেই যে পূর্ণ আস্থা ছিলো বিভূতিভূষণের স্ত্রী’র।

প্রি-প্রোডাকশনের সব কাজ মোটামুটি শেষ বলা চলে। এবার আসল কাজ, প্রডিউসার খোজার পালা। মোটামুটি ৭০,০০০/- (তখনকার টাকার মানের হিসাবে) টাকার একটা খসড়া বাজেট করেন সত্যজিৎ, পথের পাঁচালীর জন্য । টাকার পরিমানটা ছিলো আসলেই একটু বেশী। সত্যজিতের বন্ধুরা তাকে এক থিয়েটার মালিক শিশির মল্লিক -এর কথা জানায়। সত্যজিৎও বন্ধুদের কথামত প্রথমে সেই শিশির মল্লিকের কাছে যান, পথের পাঁচালী প্রযোজনা করার অনুরোধ করার জন্য। চিত্রনাট্য ও গল্প উপস্থাপনের ধরন বেশ ভালো লাগে ভদ্রলোকের । মল্লিক সাহেব তখন রানা বাবু নামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির খোজ দেন সত্যজিৎকে। সেই রানা বাবুও একদম এক কথাতেই ৪০,০০০/- টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হয়ে যান । বেশ ভালো কথা । খুশি মনে বাড়ি ফিরে কিছুদিনের মধ্যেই আনকোরা এবং শখের বশে অভিনয় করতে চাওয়া কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাস্টিং করে পুরো ইউনিট নিয়ে স্যুটিং শুরু করেন সত্যজিৎ। কয়েকদিন ঠিকঠাকভাবেই চলছিলো । হঠাৎই কোন এক অদৃশ্য কারণে টাকা দেয়া বন্ধ করে দেন রানা বাবু । স্যুটিং ইউনিট নিয়ে ভীষন বিপাকে পড়ে যান সত্যজিৎ। অনির্দিষ্টকালের জন্য স্যুটিং প্যাক-আপ করে কোমড় বেঁধে আবার প্রযোজক খোজায় নেমে পড়েন তিনি । আবার হঠাৎ ভাবলেন শটের ফুটেজগুলো (যতটুকু নেয়া হয়েছে) দেখিয়ে যদি প্রযোজক ম্যানেজ করা যায়, তাও তো ভালো । কিন্তু আলটিমেইটলী তাতেও কাজ হলো না। বন্ধুদের কাছ থেকে ধার, পছন্দের বই-সঙ্গীতের অ্যালবাম বিক্রি, স্ত্রী’র অলংকার বিক্রি থেকে শুরু করে কি করেন নি সত্যজিৎ। সব প্রচেষ্টাই মাঠে মারা যায়। অবশেষে এগিয়ে আসে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পথের পাঁচালী নির্মানের পুরো ৭০,০০০/- টাকাই দিতে রাজি হয় তারা। যদিও তখন সরকারের চলচ্চিত্র বিষয়ক কিছু কর্মকর্তা সত্যজিৎ কে এই বিশাল অঙ্কের টাকা প্রদান সম্পূর্ণ ‘জলে গেলো’ বলে মন্তব্য করেন।

পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রে চিত্রগ্রহনের কাজ করেন অখ্যাত সুব্রত মিত্র, যদিও তিনি পরবর্তীতে বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন । সম্পাদনা করেন দুলাল দত্ত। আমার খুবই খুবই খুবই প্রিয় একজন সম্পাদক। কয়েকদিন আগে “কাটিং এজ” (সম্পাদনার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক) দক্ষতার উপর কোন এক আমেরিকান ব্লগে একটা লেখা পড়ছিলাম। তো, ওইখানে দেখলাম লেখক কিছুক্ষন পরপরই এই ‘কাটিং এজ দক্ষতায় পারদর্শী’ এমন সম্পাদক হিসেবে বারবার সত্যজিতের এই দুলাল দত্তের নাম উচ্চারণ করছেন। বেশ ভালো লাগছিলো ব্যাপারটা। যাই হোক, পথের পাঁচালীর আগে তিনিও ছিলেন তুলনামূলকভাবে নতুন। তবে পরবর্তীতে সত্যজিতের সবগুলো চলচ্চিত্রেরই সম্পাদনা করেন তিনি। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সেতারবাদক রবিশঙ্কর। পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে উনার বাঁশিতে তোলা হৃদয় কাঁপানো সেই সিগনেচার সুরটা এখনও কানে বাজে আমার, বলতে গেলে সবসময়ই।

অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। তিন বছর স্যুটিং-এর পর ১৯৫৫ সালের ২৬শে আগস্ট মুক্তি পেলো সত্যজিতের প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’। বাংলা চলচ্চিত্রের নির্মাণের ধারাটাকেই আমুল বদলে দিয়েছিলো বাস্তববাদী এই চলচ্চিত্রটি। গল্পের পরতে পরতে এতো বিস্তৃত বর্ণনাশক্তি ও মন্তাজ এর আগে কোন চলচ্চিত্রে দেখেনি বাঙ্গালীরা। মুক্তির পর থেকেই দেশে এবং বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা কুড়াতে থাকে পথের পাঁচালী । ভারতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘সেরা চলচ্চিত্র’, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘শ্রেষ্ঠ মানব দলিল’, বার্লিন ও সানফ্রান্সিসকো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘সেরা চলচ্চিত্র’, নিউইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র’ সহ আরো অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘরে তুলে নেয় এটি । শুধু পুরস্কার জিতেই পাল্লা ভারী করেননি সত্যজিৎ… বাণিজ্যিকভাবেও দারুন সফলতা পায় চলচ্চিত্রটি। মুক্তির দুই সপ্তাহে ৭০,০০০/- টাকা বাজেটের এই চলচ্চিত্রটি শুধু ভারতেই আয় করে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা (তখনকার সমমূল্যের)। অবিশ্বাস্য… দারুন… ।

মূলত ভারতীয় চলচ্চিত্রসমূহকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হবার সুযোগ তৈরী করে দেয় এই পথের পাঁচালী। আর সেই সাথে বাংলা চলচ্চিত্র পায় একটি কালজয়ী চরিত্র ‘অপু’। সত্যজিতের এই অপু ট্রিলজির তিনটা চলচ্চিত্র দেখার পর ‘অপু’ হতে চায়নি, এমন ছেলে হয়তো খুজে পাওয়া যাবে না। আজ পর্যন্ত এই ‘অপু’-কে নিয়ে তো আর কম বিশ্লেষণ হয়নি। চলচ্চিত্র নির্মাণ-শিল্পের একজন একনিষ্ঠ ছাত্র হিসেবে আমি নিজেও একজন ভয়ানক লেভেলের ‘অপু’ভক্ত । সিএসই’র স্টুডেন্ট হলেও আমার খুব ইচ্ছা ছিলো সত্যজিতের এই ‘অপু’ এবং ‘অপু ট্রিলজি’র উপর একটা থিসিস করার । কিন্তু সেটা অ্যাটলিস্ট অনার্সে আর সম্ভব হচ্ছে না। জীবনে কখনও যদি সুযোগ পাই, ‘অপু’র উপর একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ এবং একটা বইও লেখার ইচ্ছা আছে। এমনকি সত্যজিতের ‘অপু’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ চরিত্র দুইটাকে ক্রসওভার করে লেখা গল্পের উপর একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও নির্মাণ করার ইচ্ছা আছে। দেখি কতদুর কি করতে পারি…

১৯৫৫ তে পথের পাঁচালী মুক্তির পর সত্যজিৎ ‘৫৭-তেই নির্মাণ করেন অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় পর্ব ‘অপরাজিত’। পথের পাঁচালীর মতোই দারুন প্রশংসিত হয় ‘অপরাজিত’। উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার হিসেবে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে “গোল্ডেন লায়ন” পুরস্কার জেতে এটি। ঋতিক ঘটক, মৃণাল সেনসহ আরো বহু সমালোচকদের মতে অপরাজিত ছিলো পথের পাঁচালীর চেয়েও ভালো। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছেও মনে হয়েছে, অপরাজিত পথের পাঁচালীর চেয়ে বেটার ছিলো। বিশেষ করে টেকনিক্যালি। অপরাজিতের সেরা টেকনিক্যাল দিক ছিলো চিত্রগ্রহণ।

পরের বছর ‘৫৮-তে সত্যজিৎ নির্মাণ করে ফেলেন দুটি চলচ্চিত্রঃ ‘পরশ পাথর’ ও ‘জলসাঘর’। দুটি চলচ্চিত্রের জন্যই দারুন প্রশংসিত হন তিনি। ‘জলসাঘর’-এর প্রিমিয়ারের জন্য একটা ফেস্টিভ্যালে যোগ দিতে তখন ইউরোপ যান সত্যজিৎ। সেখানে এক সাংবাদিকের এক অদ্ভুত প্রশ্নের সম্মুখীন হন তিনি। সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, “পথের পাঁচালী ও অপরাজিতের ‘অপু’র চূড়ান্ত পরিণতি টা তাহলে কি হলো?” ভাবনায় পড়ে যান সত্যজিৎ। সহসাই তার মাথায় একটা প্ল্যান খেললো, অপুর চূড়ান্ত পরিণতি! হবে অপুর তৃতীয় ও শেষ চলচ্চিত্র । আর এটা দিয়েই সমাপ্তি হবে বাংলা চলচ্চিত্রে অপুর রাজত্বের। ১৯৫৯ তে নির্মাণ করলেন ‘অপুর সংসার’। আর এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই অভিষেক হয় দুই গুণী শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শর্মিলা ঠাকুরের। আর হ্যা… রবিন উড, অপর্ণা সেনের সাথে আমিও সুর মিলিয়ে বলতে চাই… ‘অপুর সংসার’-ই হলো অপু ট্রিলজির সেরা চলচ্চিত্র।

পথের পাঁচালী… অপরাজিত… অপুর সংসার… তিনটা চলচ্চিত্রেরই সমাপ্তি একই মন্তাজ দিয়ে। নতুন দিনের যাত্রা… নতুন করে বাঁচা। এটাই তো জীবনের মূলদর্শন হওয়া উচিত। সত্যজিৎ দেখিয়েছেন, কিভাবে শুধু ‘জীবনবোধ’ দিয়ে একটা পরিপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায়। শুধু আফসোস… এই ভদ্রলোকটা যদি আরেকটু টেকনিক্যাল সাপোর্ট পেতেন, তাহলে বিশ্ববাসী হয়তো আরো একজন ‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’ কিংবা ‘পাবলো পিকাসো’ পেতো। আবার আফসোস করারও কিছু নেই… অামরা একজন ‘সত্যজিৎ’-কে তো পেয়েছি… বিশ্বের দরবারে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তিনিই যথেষ্ট।

বেঁচে থাকুক ‘অপু’… বেঁচে থাকুক ‘সত্যজিৎ’… বেঁচে থাকুক পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার।


Leave a reply