অমর হয়ে থাকবে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সৃষ্টি
একবার জ্যোতিষী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের হাতের রেখা দেখে বলেছিলেন, এ হাতের মধ্যে গীতিকার বা সুরকার হওয়ার কোন রেখাই নাই৷ অথচ সেই ভবিষ্যতবাণী ভুল প্রমাণ করে পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিলেন আমাদের বাংলা সংগীতে প্রতিথযশা একজন গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক৷
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তার সুরারোপিত বেশির ভাগ গানই নিজের লেখায় সুর করতেন, এ জন্য চলচ্চিত্রের গানে তাকে এক সময় টুইন ওয়ান বলা হতো, অর্থাৎ একের ভিতর দুই। বুলবুলের জন্ম ১৯৫৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায়। বাবা ওয়াফিজ আহমেদ ও মা ইফাদ আরা নাজিমুন নেসা। উনার স্কুল জীবন কাটে ঢাকার আজিমপুরের ওয়েস্টটেন্ট উচ্চ বিদ্যালয়ে, পরর্বতীতে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন!
ক্লাস নাইনে থাকা অবস্থায় মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলেই হয়তো তার কাছ থেকে এসেছিল সব কটা জানালা খুলে দাও না, সেই রেল লাইনের ধারে, সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য, মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে, একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে নার মতো হৃদয়ে দাগ কাটা সব সুর। গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা ও সাবিনা ইয়াসমিনের দরদী মধুর কন্ঠে ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না’ গানটি শুনলে এর যে আবেদন তা যেন এক অন্য রকম শিহরণ কাজ করে আমাদের মনে!
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল শুধু দেশাত্মবোধক গানই নয় করেছেন অসংখ্য অসংখ্য চলচ্চিত্র আর আধুনিক গান। বিশেষ করে চলচ্চিত্রে তার গানের ভাণ্ডারে খোঁজ নিলে মিলবে অসাধারণ সুরের সুধা, যে সুধা পান করেছে লক্ষ কোটি শ্রোতা, হারিয়ে গিয়েছেন সুরের এক অন্য রাজ্যে, যেখানে মন আর প্রান আনন্দের জলকেলিতে নিত্য স্নান করেছে!
চলচ্চিত্রে তার সংগীত পরিচালনা শুরু করেন সত্তর দশকের একেবারে শেষের দিকে বেলাল আহমেদ পরিচালনায় ‘নাগরদোলা’ (২৮/১২/১৯৭৯) ছবির ‘ও আমার মন কান্দে ও আমার প্রান কান্দে’ শিরোনামের গান দিয়ে। প্রয়াত নজরুল ইসলাম বাবুর লেখায় সাবিনা ইয়াসমিনের কন্ঠে গানটি তখন তূমুল জনপ্রিয়তা পায়। অবশ্য গানটি প্রথমে করা হয়েছিল বেতারের জন্য, পরে চলচ্চিত্রে যোগ করা হয়। উনার সুরারোপিত দ্বিতীয় গান ছিল কাজী নূরুল হক পরিচালিত ‘মেঘ বিজলী বাদল’ (১৮/০২/১৯৮৩) সিনেমায় মনিরুজ্জামান মনিরের কথায় রুনা লায়লার কন্ঠে ‘ও বন্ধুরে প্রাণ বন্ধুরে, কবে যাবো তোমার বাড়ী’ পিন্দিয়া গোলাপী শাড়ী, টিকলি মাথায় ঘোমটা দিয়ারে’। গানটিও তূমুল জনপ্রিয়তা পায়।
পরবর্তীতে ইবনে মিজানের ‘চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা’র (২৯/০৬/১৯৮৪) সবকটা গান তার সুরে জনপ্রিয়তা পায়- মনটা যদি খোলা যেত সিন্ধুকেরই মতো, আমি তোমারই চির ভিখারী ভালোবেসে ঠাঁই দিও পরাণে গো, বনমালি তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা এবং আইলো দারুণ ফাগুনরে লাগলো মনে আগুনরে একা একা ভালো লাগেনা। এরপর বেলাল আহমেদের ‘নয়নের আলো’র (০৩/০৮/১৯৮৪) আমি তোমার দুটি চোখের দুটি তারা হয়ে থাকবো, আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান, আমার বুকের মধ্যেখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানে তো সুপারডুপার হিট। ছবি দুটির সবকটি গানই তার লেখা আর সুরে। এভাবে তূমুল জনপ্রিয়তায় শুরু হয় বুলবুল অধ্যায়, যে অধ্যায়ে ছিল শুধু সফলতায় ঘেরা!
তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করা বুলবুল সাহেবের উল্লেখ্যযোগ্য কিছু চলচ্চিত্রের মধ্যে চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, নয়নের আলো, সহযাত্রী, আনন্দ অশ্রু, তোমাকে চাই, মরণের পরে, চাওয়া থেকে পাওয়া, বিয়ের ফুল, সৎ ভাই (আমার ভাগ্য বড় আজব যাদুগর), দায়ী কে, আম্মাজান, দাঙ্গা, মহৎ, চাঁদাবাজ, বিক্ষোভ, আত্ম অহংকার, জ্যোতি, বিয়ের ফুল, নারীর মন, মহা মিলন, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, বিদ্রোহ চারিদিকে, ফুল নেবো না অশ্রু নেবো, রঙ্গীন রাখাল বন্ধু, আঁখি মিলন, জীবন ধারা, ভালোবাসি তোমাকে, কষ্ট, ইতিহাস, জলপরী, ছেলে কার, আব্বাজান, কাজের মেয়ে, অবুঝ মন, অবুঝ দুটি মন, লাভ ষ্টোরি, লূটতরাজ, ধাওয়া, প্রেমের তাজমহল, প্রেমের জ্বালা, দুই নয়নের আলো, হাজার বছর ধরে অন্যতম!
আমাদের বাংলা সংগীতে অসমান্য অবদান স্বরূপ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল পেয়েছেন দুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, প্রেমের তাজমহল (২০০১) ও হাজার বছর ধরে (২০০৫) ছবির জন্য। এছাড়া বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন রেকর্ড পরিমাণ, মোট ১১ বার। পেয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক! এছাড়া আরো অনেক পুরস্কারে পুরস্কীত হয়েছেন তিনি!
২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করছি তাকে।