অমিতাভ রেজার আরেক খণ্ড মুনশিয়ানা ‘রিকশা গার্ল’
টিভির জন্য নাটক আর বিজ্ঞাপন চিত্র বানিয়ে এক দশক হাত পাকিয়ে প্রথম চলচ্চিত্রেই মাত করে দিয়েছিলেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী; ‘আয়নাবাজি’র পর বানালেন ওয়েব সিনেমা ‘মুন্সীগিরি’; এরপর বানালেন ‘রিকশা গার্ল’, প্রথম দর্শনেই যাতে দেখা গেল নির্মাতা হিসেবে তার মুনশিয়ানার ছাপ।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের লেখক মিতালি পারকিন্সের উপন্যাস থেকে ‘রিকশা গার্ল’ বানিয়েছেন অমিতাভ রেজা। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কার ঝুলিতে ভরেছে সিনেমাটি। ঢাকা লিট ফেস্টের তৃতীয় দিনে প্রদর্শনী ছিল রিকশা গার্লের, যা মুক্তির আগে দেশের দর্শকদের জন্য বড় সুযোগ বলা যায়।
লিট ফেস্টের দর্শকও সুযোগটি হাতছাড়া করেননি। আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তন ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ, দর্শক মেঝেতে বসেও দেখলেন ‘রিকশা গার্ল’।
সিনেমার প্রথম শটটিই দর্শকের এই কষ্ট লাঘবের জন্য যথেষ্ট ছিল। একটি লং শটে বিয়ে বাড়ির ব্যস্ততা, প্রস্তুতি ও আনন্দময় আবহ ফুটিয়ে তুলতে পরিচালক, সিনেমাটোগ্রাফার এবং শিল্পীদের প্রচেষ্টা ও সফলতা মন ভরার মতো।
বিয়ে বাড়ির দৃশ্য দিয়ে সিনেমা শুরু হলেও গল্পটা এগোতে থাকে বিয়ে বাড়িতে ২০০ টাকা মজুরিতে আল্পনা আঁকতে আসা নাইমাকে ঘিরে। এক রিকশাচালক বাবার বড় মেয়ে নাইমা। শারীরিক অসুস্থতা ও রিকশা মালিকের জমার টাকার চাপ যাকে যাঁতাকলে পিষ্ট করে ফেললেও মেয়েকে বলতে পারেন, ‘আঁকাআকিটা ছাড়িস না মা’।
আঁকাআঁকি! রিকশাচালকের মেয়ে নাইমার নিজস্ব এক জগৎ। উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে বাবার রিকশা, বাড়ির ধসে যাওয়া দেওয়াল, টিনের চাল যার ক্যানভাস। যার দুরন্তপনা আর সরলতার আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রতিবাদী রূপ। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার জেদ।
এই জেদ নাইমাকে পাবনার পাকশী থেকে নিয়ে আসে ঢাকায়। দাঁড় করিয়ে দেয় সীমাহীন নির্মমতার মুখোমুখি। মফস্বলীয় সৃজনশীলতায় ভর করে নগরে এসে হোঁচট খাওয়া নাইমা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, ‘নাইম’ নামের ছেলে হয়ে।
মানুষ তার জীবনে লক্ষ্য ঠিক করে মূলত সুনির্দিষ্ট কারণকে সামনে রেখে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর যখন দেখে তার সেই কারণটা হয়ে উঠেছে অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রয়োজনীয়; জয়ের মুকুট মাথায় দিয়েও পরাজিতের বেদনা নিঃশেষ করে দেয় না? সব আগ্রহ, উন্মাদনা, আত্মবিশ্বাস বোতলবন্দি জিনের মতো অসহায় হয়ে পড়ে না?
নাইমারা ব্যতিক্রম। শোককে যারা গতির জ্বালানি বানায়, নিজেকে বানায় জেট ইঞ্জিন, তারাই তো আকাশ ছোঁয়। রিকশা গার্ল মূলত নাইমা নামের মফস্বলের বেদনার্ত চঞ্চল মেয়েটির আকাশ ছোঁয়ার গল্প।
রিকশার প্যাডেলে পা রেখে দুই-একটা ছবি তুলে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করা নগরবাসী কারও কারও কাছে বিনোদনের হতে পারে; কিন্তু জীবিকার তাগিদে, দুপুর বেলার খাবারের টাকা জোগাড় করতে, বাবার আজীবন চলা ওষুধ কেনার কষ্টের গল্পগুলো তাদের কাছে শুধু সিনেমার হয়ে থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
তবে চিত্রগ্রাহক নিকোলাস রিবার্প আর তুহিন তমিজুলের ক্যামেরা যখন নাইমাদের এঘর থেকে ওঘর ঘুরছিল, অসুস্থ বাবার রিকশা হারানোর বেদনা যখন ঘরের কোণে হাবুডুবু খাচ্ছিল, ঘুমন্ত নাইমা হঠাৎ করে চোখ খুলল, তার চোখের ভেতর বিষাদসমুদ্র টলমল করছে, এক পলকের দৃশ্যটি পরের দু-তিনটি দৃশ্যকে ঝাপসা দেখতে বাধ্যই করল।
গ্যারেজ থেকে ভাড়ায় চালানোর জন্য রিকশা নিতে ব্যর্থ নাইমা; তবে ছেলেরূপী নাইম ঠিকই রিকশা পেয়ে গেল! রিকশায় প্যাডেল রেখে গ্যারেজ থেকে বের হয়ে ‘নাইম’ রানওয়েতে ছুটতে থাকা বিমানের মতো ডানা মেলে দিল আকাশে, এক ঝাঁক দর্শক হাত তালিতে ফেটে পড়ল।
এই যে রিকশাচালকের আবেগের সঙ্গে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ‘আপার ক্লাস’ কিংবা শিল্প সাহিত্য বোঝা ‘মিডল ক্লাস’র আবেগকে যিনি এক উনুনে বাষ্পীভূত করলেন, তিনি অমিতাভ রেজা চৌধুরী।
আয়নাবাজির মতো ব্যবসাসফল সিনেমার নির্মাতা ‘রিকশা গার্ল’র দুঃখ-বেদনা আর আনন্দকে একত্রিত করে তা সব শ্রেণীর ভেতর ছড়িয়ে দিতে পারাটা তার যেমন মুনশিয়ানা; তেমন মুনশিয়ানা বুনো শালিক, রাস্তার কুকুরকে ফ্রেমে এনে কিংবা অপ্রত্যাশিতভাবে ফ্রেমে এসে যাওয়ার পর সেটাকে অর্থবহ করে তোলা।
প্রতিটি শিল্পীকে চরিত্রটা বিশ্বাস করানো এবং সেটাকে যথোপযুক্তভাবে ফুটিয়ে তুলে দর্শকের মাঝে সেই বিশ্বাস ছড়িয়ে দেওয়ার মুন্সিয়ানায় উৎরে গেলেন নির্মাতা।
সিনেমার পুরোটা জুরে রিকশা পেইন্টিংয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতিটি ফ্রেমে আলো ও রঙের পরীক্ষায় উৎরে যাওয়া, নাইমার রঙের ভুবনকে জীবন্ত করে সাধারণ সীমাবদ্ধতাগুলোকে ভুলিয়ে দেওয়ার মুন্সীয়ানাও দেখালেন অমিতাভ রেজা।
আর প্রায় প্রতিটি ফ্রেম দখলে রেখে অমিতাভ রেজাকেও যিনি ছাড়িয়ে গেলেনন, তার নাম নভেরা রহমান। যিনি নাইমা রূপে যতটা সফল, নাইম রূপেও ততটাই।
অ্যালেন শুভ্র, নাসির উদ্দিন খান, চম্পা এবং হঠাৎ চমকে দেওয়া সিয়াম আহমেদসহ সিনেমার প্রতিটি চরিত্র যার যার কাজ করে গেছেন শত ভাগ শক্তি নিয়ে।
গল্প আহামরি কিছু না হলেও প্রতিটি চরিত্রের অভিনয় আর চিত্রগ্রাহক নিকোলাস রিবার্প ও তুহিন তমিজুলের সাহায্য নিয়ে অমিতাভ রেজা পুরো সিনেমায় দর্শককে আটকে রেখেছেন অনাবিল মুগ্ধতায়।
সবকিছু মিলিয়ে ২০২৩ সালে ‘রিকশা গার্ল’র দর্শকের পছন্দের সিনেমা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা পুরোপুরি রয়েছে।
*বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোরে পূর্ব প্রকাশিত