Select Page

ইরফান খানে আগ্রহ, ‘ডুব’ নিয়ে অনাগ্রহ: ৬ কারণ

ইরফান খানে আগ্রহ, ‘ডুব’ নিয়ে অনাগ্রহ: ৬ কারণ


গতকাল (২৯ এপ্রিল) ভারতের প্রখ্যাত অভিনেতা ইরফান খান মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের পুরো সোস্যাল মিডিয়া তাকে নিয়ে শোকস্তব্ধ! বড় বড় তারকা হতে শুরু করে আমজনতা পর্যন্ত সবাই প্রিয় অভিনেতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কিছু না কিছু লিখে পোস্ট দিচ্ছে, সেগুলোতে ভরপুর স্যাড (sad) রিয়েকশন পড়ছে। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে আমিও দ্বিধা বোধ করিনি..

তো নিউজ ফিডে পোস্ট ঘাটতে ঘাটতে কেন জানি একটা বিষয় মাথায় এলো। খুব কম মানুষকে পেলাম যারা ইরফান খানের কাজগুলোর বর্ণনা করতে গিয়ে “ডুব” নিয়ে কিছু বলেছে। এতোবড় একজন অভিনেতা আমাদের ঢালিউডের সবথেকে খারাপ সময়ে এসে কাজ করে গেছেন, প্রযোজনাও করেছেন… অথচ মৃত্যুর পর ওনার অন্যান্য কাজগুলো যতটা না প্রশংসিত হচ্ছে, সে তুলনায় এই বিষয়টি খুব মানুষের কাছেই অর্থবহ হয়ে উঠলো। তো চিন্তা করে দেখলাম, কী কী কারণ থাকতে পারে যার জন্যে “ডুব” এর প্রতি মানুষের অনাগ্রহ, নিজ দেশের কাজের প্রতি মানুষের অগ্রাহ্যতা। ছোট্ট এই মস্তিষ্কে অল্প কিছু কারণ উঁকি দিলো, জানি না আমি কতটুকু সঠিক কিংবা কতটুকু ভুল। আসুন দেখে নেয়া যাক-

নেতিবাচক প্রচারণা: 
আপনি যদি ডিজিটাল বাংলা ছবির দর্শক হন এবং জাজ মাল্টিমিডিয়ার চলচ্চিত্রসংক্রান্ত কর্মকান্ড দেখা হয়ে থাকে, তবে এটা হয়তো অবশ্যই খেয়াল করেছেন, তারা ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রচারণায় বিশ্বাসী! এই পদ্ধতির সবথেকে বড় সুবিধা হলো, অল্প সময়ের মধ্যে বেশি মানুষের কাছে চলচ্চিত্রটির নাম পৌছে যায়। “ডুব” এর আগে এবং পরে তারা তাদের বেশিরভাগ চলচ্চিত্রের প্রচারণার ক্ষেত্রে এই পন্থা অবলম্বন করেছে এবং বলা বাহুল্য, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সফল হয়েছেন। কিন্তু কথায় আছে, প্রতিটি জিনিসেরই একটা খারাপ দিক আছে। “ডুব” এর ক্ষেত্রে দূর্ভাগ্যজনকভাবে খারাপটাই ঘটেছে। “ডুব” কে ঘিরে যে কন্ট্রোভার্সিগুলো দানা বেধেছিল, তা আজ পর‍্যন্ত সাধারণ দর্শক ভালোভাবে নেয়নি।

আনন্দবাজার পত্রিকা কন্ট্রোভার্সি:
আনন্দবাজার পত্রিকার পরিচালক মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর বরাত দিয়ে যে ইন্টারভিউটি নিয়েছিল, প্রকাশ করার আগেই ছবির গল্পে হুমায়ুন আহমেদের ব্যক্তিগত জীবন তুলে ধরার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এটির পর পুরো দেশ নড়েচড়ে বসেছিল, কারণ বিষয়টি ছিল একদম অপ্রত্যাশিত। হুমায়ুন আহমেদের বিতর্কিত ব্যক্তিগত জীবনকে ঘিরে একটি কাহিনিচিত্র তৈরি হচ্ছে, এমন খবর শোনার পর লক্ষাধিক হুমায়ুন ভক্ত ক্ষোভে ফেটে পড়ে! তারা বিভিন্নভাবে ছবিটির বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছে। অনেককে দেখেছি রীতিমতো ছবিটিকে মন থেকে বয়কট ঘোষণা করেছেন। ছবি মুক্তির পর এটা অনেকটা সত্য প্রমাণিত হয়েছে, বাস্তব ঘটনা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এ ছবির গল্প তৈরি। তো এতেও লাভের থেকে “ডুব” এর ক্ষতি বেশি হয়েছে।

টার্গেট অডিয়েন্স ঠিক করতে না পারা:
আপনি যখন কোনো চলচ্চিত্র দর্শকদের জন্য তৈরি করছেন কিংবা দর্শকদের জন্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করছেন, তখন আপনার আগে বুঝতে হবে আমার এই ছবিটি কারা সর্বোচ্চ উপভোগ করতে পারবে। এ কাজটি সাধারণত ছবি তৈরির আগে পরিচালক এবং ছবি তৈরির পর প্রযোজক ও পরিবেশক ভালো বুঝে থাকেন, তারা ভালো বাছ-বাছাই করতে পারেন কোন ছবি শ্রমজীবীদের ভালোলাগবে, কোন ছবি তরুণদের ভালোলাগবে আর কোন ছবি তথাকথিত রুচিশীলদের ভালোলাগবে। “ডুব” এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, তারা কাদের ধরতে হবে এটা একদমই ঠিক করতে পারেনি। ছবিটি দেখে আমার মনে হয়েছে, এটি তথাকথিত আমজনতার ছবি না। এখানে পর্দায় যতটা দেখানো হয়েছে, তার থেকেও বেশি একেকটি সিন নিয়ে ভাবতে হয়েছে, মাথা খাটাতে হয়েছে। তো এরকম দর্শক এই সময়ে দাঁড়িয়ে কয়জনই বা আছে, যারা গুরুগম্ভীর ছবির স্বাদ নিতে পারবে।

বাজে প্রদর্শন সিস্টেম:
এটা নিয়ে আমরা বিগত এক যুগ ধরে ভুগছি। মাল্টিপ্লেক্স ব্যতীত ঢাকার নির্দিষ্ট কিছু সিনেমাহল ছাড়া দেশের কোথাও ভালো প্রজেকশন সিস্টেম নেই। আপনাকে যদি নড়বড়ে ছেঁড়া ফোমের চেয়ারে বসিয়ে পায়ের নিচে কিছু ছাঁড়পোকা ছেড়ে দিয়ে এরপর যদি ফাঁটা ঘোলা পর্দা ও বাজে সাউন্ড সিস্টেমের সাহায্যে “ডুব” এর মতো গুরুগম্ভীর ছবি দেখাই, আপনার কেমন লাগবে? আর এর সাথে যদি আপনার পকেট থেকে আমি ৪০-৫০ টাকা কেটে নেই, কেমন লাগবে? সিনেমাটোগ্রাফি, সাউন্ড ডিজাইন যতই বিশ্বমানের থাকুক; আপনি ঠিকই আমাকে গালাগাল দেবেন। আর আমাকে না পেলে দিবেন “ডুব”কে।

ভিন্ন কিছু নিতে না পারার মানসিকতা:
আপনার যদি আমাদের অতীতের ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র সম্পর্কে ধারণা থাকে, তবে দেখতে পাবেন আমাদের দর্শকরুচির সাথে হিন্দি ছবির দর্শকরুচির বেশ মিল আছে। আমরা মঞ্চ কিংবা যাত্রা ঘরানার ড্রামা দেখতে অভ্যস্ত। স্ক্রিণের সামনে এসে শিল্পীরা উচ্চস্বরে বড় বড় সংলাপ ছুঁড়বে, সেই সংলাপ এতোটা শক্তিশালী হবে যে খুশিতে দর্শক হাততালি দিবে। এখানে দুঃখ দেখানো হবে বেশি, আবেগ দেখানো হবে বেশি। যা মানুষের হৃদয়কে জোরপূর্বক ধাক্কা দিবে। এই প্যাটার্নের বাইরে গিয়ে যে চলচ্চিত্রগুলো নির্মিত হয়েছে, প্রায় কোনোটিই সিনেমাহলে ভালো চলেনি। উদাহরণ হিসেবে আপনি সত্তর দশকের “সূর্য দীঘল বাড়ী” কে টানুন, কিংবা হালের “অজ্ঞাতনামা” কে। অর্থাৎ আমরা এখনো এরকম ডাউন দ্য গ্রাউন্ড ঘরানার ড্রামা ছবি দেখার জন্য প্রস্তুত নই, যেখানে কথা হবে কম আর ভিজ্যুয়ালি গল্প বোঝানো হবে বেশি। হয়তো সুদুর ভবিষ্যতে আমরা এগুলোকে গ্রহণ করতে পারবো।

ছবি মুক্তির সময়কাল:
সবশেষ পয়েন্ট এটাই, তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ না, আবার একবারে ফেলে দেওয়ার মতোও না। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৭ তে। এর তিন সপ্তাহ আগে মুক্তি পেয়েছে সারাদেশব্যপী দর্শকপ্রশংসা পাওয়া চলচ্চিত্র “ঢাকা অ্যাটাক”, যে ছবির মাধ্যমে বহুদিন পর মাস-ক্লাস অডিয়েন্স একসাথে সিনেমাহলে ভীড় করেছে। এছাড়া “ডুব” এর আগে ও পরে ডিপজল-মৌসুমী-বাপ্পী’র “দুলাভাই জিন্দাবাদ, নীরবের “গেম রিটার্নস”, সাইমনের “খাস জমিন” মুক্তি পেয়েছিল; এর সবগুলোই পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক ছবি। তো পরপর এতোগুলা বাণিজ্যিক ছবির ভীড়ে এইঁছবিটি তেমন দর্শক আগ্রহ ধরে রাখতে পারেনি। অনেক দর্শক মুক্তির পর দর্শকদের নেতিবাচক মনোভাব দেখে ছবিটি দেখেইনি।

তো এই ছিল আমার বিশ্লেষণ। আমার দেশের দর্শক “ডুব” দেখে গালাগাল দিয়েছে, এটা যেমন সত্যি; ঠিক তেমনি দেশের বাইরে “ডুব” এর ফেস্টিভ্যাল ভার্সন এ ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, এটাও সত্যি। আর এমনিতেও মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী নিজেও স্বীকার করেন, তার ছবি আসলে দর্শক দুই ভাগ হয়ে যায়; একদল তাকে মাথায় তুলে নাচে, আরেকদল তাকে যা তা বলে গালাগাল করে। “ব্যাচেলর”, “থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার” এর সময় সোস্যাল মিডিয়ার প্রভাব না থাকা সত্ত্বেও পত্র-পত্রিকায় ভয়াবহ রকমের সমালোচনা হয়েছে তাই এগুলো মেনে নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে সবাইকে৷

তবে আমি এই দুই পক্ষের মাঝামাঝি অবস্থান করতে পছন্দ করি। ভালো লাগা কিংবা মন্দ লাগা, সেটা চলচ্চিত্রের ওপর নির্ভর করুক, সেটাই হওয়া উচিত। শুরুর মতো শেষটাও ইরফান খানকে দিয়ে করি। আমি নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করি, আমি ইরফান খানের মতো এতো বড় মাপের একজন অভিনেতাকে বড়পর্দায় দেখতে পেরেছি।


মন্তব্য করুন