Select Page

অশ্লীলতার কারণেই আর অ্যাডজাস্ট করতে পারিনি : ইলিয়াস কাঞ্চন

অশ্লীলতার কারণেই আর অ্যাডজাস্ট করতে পারিনি : ইলিয়াস কাঞ্চন

‌‘বেসিকলি আমার একটা প্রডাকশন হাউস ছিল। অনেক চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছি। আমার পরিচালিত চলচ্চিত্রের প্রযোজক ছিলেন অন্যজন। ২০০০ সালে এসে অশ্লীলতার কারণেই আমি আর অ্যাডজাস্ট করতে পারিনি। হাউস বন্ধ করে দিয়েছি। বিবেকের কারণেই পারিনি। নিরাপদ সড়ক নিয়ে দেশের মানুষের উন্নয়ন করব, আবার অশ্লীল চলচ্চিত্র বানিয়ে মানুষের নৈতিকতা নষ্ট করব— এটা হতে পারে না। একই কারণে অভিনয় করাও কমিয়ে দিয়েছি।’— বাংলা চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে কথাগুলো বলেন ‘বসুন্ধরা’, ‘ভেজা চোখ’, ‘চরম আঘাত’ ও ‘বেদের মেয়ে জোসনা’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন

২০১৫ সালের মার্চে গুণী এই অভিনেতা ও পরিচালকের মুখোমুখি হয়েছিলেন দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক মাসুম আওয়াল। সেখানে উঠে আসে ইলিয়াস কাঞ্চনের অভিনয় জীবন, বাংলা চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা, ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনসহ অন্যান্য প্রসঙ্গ। সেই আলাপচারিতার নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হল—

পরিবারের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করি। আপনার পরিবারের কেউ কি শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

আমার বাবা কৃষক ছিলেন। উনি জীবনের বেশিরভাগ সময় গ্রামেই কাটিয়েছেন। মা-বাবা কেউ শিল্প-সংস্কৃতির ধারেকাছেও ছিলেন না। আমি কিভাবে এই জগতে এলাম এটার একটা মজার গল্প আছে।

অভিনেতা না হলে চিকিৎসক হতেন এমনটি শুনেছি…

আমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম, এটার পেছনে একটা বড় কারণ আছে। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। মা অসুস্থ হয়ে যান। আমি মাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলাম। আমরা বাইরে বসে আছি। ভেতরে ডাক্তার একজন রোগীকে ধমকাচ্ছিলেন, খুব খারাপ ব্যবহার করছিলেন। ভাল চিন্তা করা, দেশের মানুষের কথা চিন্তা করা— আমার ভেতর খুব ছোটবেলা থেকেই ছিল। সে সময় আমার মনে হল একজন ডাক্তার তো রোগীর সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে না। গরিব মানুষ বলেই তো তারা সরকারি হাসপাতালে যায়। তখন মনে হল ডাক্তার হব, মানুষের সেবা করব।

চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়েছিল কিভাবে?

চলচ্চিত্রের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়েছিল ভাললাগা থেকে। স্কুল লাইফ থেকেই হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। সিনেমার পোকা হয়ে গিয়েছিলাম। পড়ালেখার বাইরে চলচ্চিত্রই ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। প্রতিদিন ছবি দেখব সেই টাকা জোগাড় করাও খুব কষ্টকর ছিল। তাই সিনেমা হলে প্রজেকশনের দায়িত্বে যিনি থাকতেন তাকে চার আনা-আট আনা দিয়ে হাত করতাম। তার রুমে বসিয়ে আমাকে চলচ্চিত্র দেখার ব্যবস্থা করে দিতেন। বাড়িতে আমার বদনাম হয়ে গিয়েছিল। ফিরতে দেরি হলেই ভাবত সিনেমা হলে গেছি। আমি যেটা করি না সেটা আমাকে কেউ বললে আমার খুব কষ্ট লাগত।

একবার একটা ঘটনা ঘটে। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বই পড়ার ঝোঁক ছিল। আমি একদিন গল্পের বই নিয়ে রমনায় চলে গেলাম। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। বই পড়তে পড়তে এত মশগুল হয়ে যাই কখন যে সময় চলে যায় বুঝতে পারি না। আমার প্রাইভেট টিচার আসবে সেটাও ভুলে গেছি। যখন দিনের আলো কমে গেল বুঝতে পারলাম দেরি হয়ে গেছে। তখন থাকতাম নবাবপুরে। ভাবলাম বাসে চড়ে গুলিস্তান যাব, এরপর রিকশা নিয়ে বাড়িতে যাব। না দেখেই বাসে চড়ে বসেছি। বাস দেখি গুলিস্তান যায় না। তখন আমার ধারণা ছিল সব বাস গুলিস্তান যায়। সেই বাস গুলিস্তান না গিয়ে দৈনিক বাংলা হয়ে মতিঝিলের দিকে চলে যাচ্ছে। খুব সম্ভবত বাস যখন আমিন কোর্টের কাছে কন্ট্রাকটরকে বললাম বাস কোথায় যাচ্ছে? সে বলে কমলাপুর। আমি ভাবলাম, সর্বনাশ! এখন বাড়ি যেতে তো আরও অনেক দেরি হয়ে যাবে। বাড়ি ফেরার তাড়ায় না বুঝেই চলতি বাস থেকেই লাফ দিয়েছি। ভাগ্য ভাল গাড়ির চাকার নিচে পড়িনি। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলাম। উঠে দাঁড়ানোর পর মনে হল আমি কিছুই চিনতে পারছি না। মনে হল আমি সব ভুলে গেছি। সিনেমাতে দেখেছি মাথায় আঘাত পেলেই নায়ক স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যায়্। ভাবলাম আমার স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গেছে। এরপর কাঁদতে শুরু করি আর হাঁটতে থাকি। হাটঁতে হাঁটতে লক্ষ্য করলাম গুলিস্তানের দিকেই যাচ্ছি। ডিআইটি রোডের ওখানে বিটিভির অফিস ছিল। বিটিভির অফিসের চূড়াতে একটা লালবাতি জ্বলত। ওই বাতি দেখে বুঝলাম সবকিছু চিনতে পারছি। আমার মাথা নষ্ট হয়নি।

ছোটবেলায় যে চলচ্চিত্র বেশি দেখা হতো…

তখন তো পাকিস্তান আমল। এ্যাকশন চলচ্চিত্রের প্রতি বেশি ঝোঁক ছিল। সেই সময় মোহাম্মদ আলীর একটা চলচ্চিত্র দেখেছিলাম, নাম ‘বাঘি সিপাহী’। এই চলচ্চিত্রটি দেখে আমার জীবনে ঘটেছিল একটা অন্যরকম ঘটনা।

কী ঘটনা?

ওই চলচ্চিত্রে একটা কুকুর ছিল। সাদা রঙের কুকুর। ওই দেখে আমার ইচ্ছে হল একটা সাদা কুকুর পালব। অনেক কষ্ট করে একটা সাদা রঙের কুকুর জোগাড় করলাম। পালতে শুরু করলাম। কুকুর যারা পালে তারা সবাই জানে কুকুর তার পালককে কত ভালবাসে। আমি স্কুল থেকে বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে ও লাফ দিয়ে আমার কাছে চলে আসত। মা এটা পছন্দ করত না। একদিন কী হল, মা টেবিলে তরকারি সাজিয়ে রেখেছেন। আমি স্কুল থেকে কেবল এসেছি। কুকুরটা তরকারি মাড়িয়ে লাফ দিয়ে আমার কাছে চলে আসে। মা তো ভীষণ রেগে গেলেন, বকাবকি করতে শুরু করলেন। উনি রেগে বললেন, ‘তুই কুকুর ফেলে আসবি, না হয় কুকুর নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি।’ কী আর করা! কুকুর নিয়ে অনেক কান্নাকাটি করলাম। ওকে অনেক আদর কললাম। এরপর সদরঘাটে গিয়ে নৌকা করে নদীর ওপারে রেখে আসলাম।

স্কুল-কলেজেও কি অভিনয় করতেন?

আমার দুইটা ইচ্ছা ছিল। একটা হল ডাক্তার হওয়া, অন্যটা চলচ্চিত্রের মানুষ হওয়া। চলচ্চিত্রে আসা আমার জন্য খুব ডিফিকাল্ট ছিল। কারণ কাউকে চিনতাম না-জানতাম না। আমার ধারণা ছিল ফিল্মের মানুষ হতে অনেক টাকা লাগে। তাই খুব একটা আশাও ছিল না।

স্কুল লাইফে আমার স্কুলের পাশের মন্দিরে শুটিং চলছে। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমি যখন গেলাম আমাকে ঢুকতে দিল। আমার মনে হল আমি অনেকটা নায়কদের মতো দেখতে, তাই আমাকে ঢুকতে দিয়েছে।

ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালে স্কাউট করতাম। স্কুলেই এক বন্ধুর সঙ্গে অভিনয় করে দারুণ প্রশংসিত হয়েছিলাম। এরপর দেশ স্বাধীনের পরে দশম শ্রেণীতে পড়াকালে মঞ্চনাটকে অভিনয় করে স্কুলে অনেক প্রশংসিত হই।

সুভাষ দত্তের ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ১৯৭৭ সালে চলচ্চিত্রে আসেন। এতবড় মাপের একজন পরিচালকের চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ কিভাবে ঘটে?

স্কুলে যে বন্ধুর সঙ্গে অভিনয় করেছিলাম অনেক দিন পর তার সঙ্গে দেখা। সে জানাল, তারা একটা নাটক বানাচ্ছে। ওখানে আছে চলচ্চিত্রের একজন নায়িকা ও পরিচালক। আমাকে ওদের শুটিং দেখতে যাওয়ার কথা বলল। শুটিংয়ে দেখলাম নায়িকা জুলিয়া ও কায়েস ভাইকে। কায়েস ভাই অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। এক সময় বলেই বসলেন, ‘আপনার বন্ধুটিকে নিচ্ছেন না কেন?’ ওরা বলল, ‘ও তো আমাদের গ্রুপের না।’ কায়েস ভাই চুপ করে গেলেন। শুটিংয়ে একজন শিল্পী আসেননি। পরিচালক আমাকে প্রক্সি দিতে বললেন। কায়েস ভাই দলের অন্যদের উদ্দেশ করে বললেন, ‘দেখেন কী শিল্পী আমাকে দিয়েছেন। প্রক্সি দিতে এসে কী চমৎকার অভিনয় করছে।’

পরে আমাকে ওই নাটকে ছোট্ট একটা অভিনয় দেওয়া হল— চাকরের অভিনয়। আমার প্রেস্টিজে এটা খুব বাধল। ‘সৃজন সংঘ’ নামে আমাদের একটা দল ছিল। দলের সদস্যদের বললাম, আমরা কি একটা নাটক করতে পারি না। সবাই রাজি হল। নাটক মঞ্চায়নে প্রধান অতিথি থাকার কথা ছিল সেই সময়ের পানি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান আসাফউদ্দৌলা সাহেবের। আমাদের সুপ্ত বাসনা ছিল ওয়াপদা স্টুডিওতে যে শো হবে, হলের ভাড়াটা তার কাছ থেকে নেব। সেই হলের ভাড়া ছিল সাড়ে ৩ হাজার টাকা। উনি রাজিও হয়েছিলেন, পরে অন্য গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের কারণে অনুষ্ঠানে আসতে পারলেন না। তাকে না পেয়ে এক বন্ধুর পরামর্শে সুভাষ দত্তকে আমরা প্রধান অতিথি বানালাম। উনি আমাদের নাটক দেখলেন। সেই সময় উনি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের একটা চলচ্চিত্র বানাবেন বলে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। নতুন নায়ক-নায়িকা খুঁজছেন। উনি নাটক দেখতে এসে আমাকে আবিষ্কার করলেন।

আপনার অভিনীত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের নাম বলুন…

তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ (১৯৮৯), শিবলী সাদিকের ‘ভেজা চোখ’ (১৯৮৮), হাফিজ উদ্দিনের ‘সেই তুফান’ (২০০৯), আবু সাইয়ীদের ‘নিরন্তন’ (২০০৫), মতিন রহমানের ‘রাধা কৃষ্ণ’ (১৯৮৯), শঙ্খমালা (১৯৯০), ওয়াকিল আহমেদের ‘কে আমি’ (২০০৮) ও সৈয়দ হারুন পরিচালিত ‘বাঁচার লড়াই’ (১৯৯৫)। মমতাজ আলী পরিচালিত ‘সোহরাব রুস্তম’ (১৯৯৬) চলচ্চিত্রে বনশ্রী আমার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শাস্তি’ (২০০৬) চলচ্চিত্রে অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই। আরও আছে আলমগীর কবির পরিচালিত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘পরিণীতা’ (১৯৮৬) ও মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘আঁখি মিলন’ (১৯৯৪)। সব মিলিয়ে সাড়ে তিনশ’র মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি।

অভিনয় কেন কমিয়ে দিলেন?

চলচ্চিত্রে অভিনয় কমিয়ে দিয়েছি বললে ভুল বলা হবে। বাংলাদেশে কোনো অভিনেতাই অভিনয় করা কমিয়ে দেয় না। আমি শুধু টাকার জন্য অভিনয় করি না। অনেক চলচ্চিত্রের প্রস্তাব আসে, কিন্তু ব্যাটে-বলে না মেলার কারণে অভিনয় করা হচ্ছে না। আমি আগেও বলেছি আমার প্রেস্টিজ নষ্ট হবে এমন কোনো কাজ করি না। অনেক সময় টাকার হিসাব ঠিক থাকলেও যদি মনে হয় এই চলচ্চিত্রে আমাকে ছোট করা হচ্ছে— তাহলে অভিনয় করি না। আমি এত দিনে যেটা অর্জন করেছি সেটা ক্ষয় করে ফেলতে রাজি না। যদি বাড়াতে পারি সেটাই ভাল।

বলা হয়ে থাকে ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালী যুগ ছিল। কখন থেকে সেটা দুর্বল হতে শুরু করল?

আমাদের চলচ্চিত্রের মার্কেটটা অনেক বড় ছিল। দীর্ঘদিন থেকে এই মার্কেট পার্শ্ববর্তী দেশগুলো দখল নেওয়ার চেষ্টা করেছে। যখন এটা পাকিস্তান ছিল তখন পাকিস্তানী চলচ্চিত্রের দাপট ছিল। সে সময়কার পরিচালক-প্রযোজকরা নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য কষ্ট করে চলচ্চিত্র বানিয়েছে। সত্যিকার অর্থে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ক্ষমতায় যারা এসেছেন— তাদের মধ্যে একমাত্র বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের উন্নয়ন করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। উনি ছাড়া কারও ভেতরে চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতি এমন ভালবাসা দেখিনি। এরপর যারাই এসেছেন তারাই এটাকে সৎ সন্তান হিসেবে দেখেছেন। এখনো সৎ সন্তান হিসেবে দেখছেন।

পাকিস্তানীরা বলেছিল, পূর্ববাংলা ধুলোবালি-বৃষ্টিপাতে ভরা। এখানকার আবহাওয়া ভাল না। ছবি বানানোর জন্য এ স্থান অযোগ্য। পরে বঙ্গবন্ধুর কারণে এ দেশে এফডিসি তৈরি হয়। দেশীয় চলচ্চিত্রকে প্রটেকশন দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু নিয়ম করলেন, বাইরের দেশের কোনো চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে হলে শুধু ইংরেজি ভার্সন হতে হবে। অন্য কোনো ভাষার ছবি এ দেশে চালানো যাবে না।

কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে আমাদের দেশে দালালের কোনো অভাব নেই। তারা নিজের লাভের জন্য দেশ বিক্রি করে দেবে। এই দালালদের কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের এত মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এই দালালরাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে কে হিন্দু, কে মুক্তিযোদ্ধা চিনিয়ে দিয়েছে। এই দালালদের মাধ্যমেই চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংস হয়েছে।

এখন যুদ্ধের ভাষা বদলেছে। বর্তমান পৃথিবীর পলিসি হচ্ছে এখন আর যুদ্ধ করে তোমার দেশ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। দরকার সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার। আমি ব্যবসা করব তোমার দেশে। যদিও আমরা ইন্ডিয়ার সাহায্য নিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছি। সেই পলিসি থেকেই আমাদের চলচ্চিত্র বাজার নিয়ে তাদের মনে অনেক বড় আশা ছিল। ছোট্ট দেশ হলে কি হবে, আমাদের প্রায় ১৭-১৮ কোটি মানুষ। ছলে বলে কৌশলে আমাদের মার্কেট ধরার চেষ্টা করছে ভারত।

প্রথমেই আমাদের দেশে পাইরেসি শুরু হল। যখন সৈয়দ হারুনের মতো পরিচালক নির্মাণ করলেন ‘চরম আঘাত’, সেই সময় পাইরেসি শুরু হল। আমরা ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আইনের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কেউ সাহায্য করেনি।

আবার এক ধরনের লোক চিন্তা করল ভাল ভাল চলচ্চিত্র বানালে মানুষ পুরো পরিবার নিয়ে দেখে মৌজ-মাস্তি করবে। চলচ্চিত্রের বাজার ধ্বংস করার জন্য চিন্তা করল— অশ্লীলতা ঢুকিয়ে দিলে পরিবার নিয়ে আর কেউ হলে যাবে না। ১৯৯০ সালের দিকেই কিছু কিছু অশ্লীলতা চলচ্চিত্রে ঢুকে পড়ে, ১৯৯০ এর দশকের পরে এটা প্রকট আকার ধারণ করে। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মোটামুটি আমরা টিকে ছিলাম।

একদিকে পাইরেসির কারণে খরচ করে ভাল ছবি কেউ বানাতে পারছে না, অন্যদিকে অশ্লীলতার কারণে পরিবার নিয়ে কেউ আর চলচ্চিত্র উপভোগ করতে পারছে না। হলে দর্শক হচ্ছে না, হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হল বাঁচাতে হলে ভাল চলচ্চিত্র চালাতে হবে। ভাল চলচ্চিত্র কোথা থেকে আসবে? পাশের দেশ থেকে আসবে। পরিকল্পনা করে এ রকম একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। এটাকে কেউ কেউ বলে নিক্সনি বুদ্ধি, আবার কেউ বলে হিটলারি বুদ্ধি। আজকে কিন্তু তাদের পাঁয়তারা সাকসেস হয়েছে। হল বাঁচানোর জন্য বাইরের ছবি না এনে পাইরেসি বন্ধ করা উচিত। দেশের চলচ্চিত্র উন্নয়ন করা উচিত। এগুলো কেউ করবে না।

আপনি দুটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন— ‘বাবা আমার বাবা’ ও ‘মায়ের স্বপ্ন’। আবারও পরিচালনায় আসার ইচ্ছা আছে কি?

বেসিকলি আমার একটা প্রডাকশন হাউস ছিল। অনেক চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছি। আমার পরিচালিত চলচ্চিত্রের প্রযোজক ছিলেন অন্যজন। ২০০০ সালে এসে অশ্লীলতার কারণেই আমি আর অ্যাডজাস্ট করতে পারিনি। হাউস বন্ধ করে দিয়েছি। বিবেকের কারণেই পারিনি। নিরাপদ সড়ক নিয়ে দেশের মানুষের উন্নয়ন করব, আবার অশ্লীল চলচ্চিত্র বানিয়ে মানুষের নৈতিকতা নষ্ট করব— এটা হতে পারে না। একই কারণে অভিনয় করাও কমিয়ে দিয়েছি।

আবার হলও কমে গেছে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১৩০০ সিনেমা হল ছিল, এখন সাড়ে ৩শ’ সিনেমা হল। ১০০ হলে জাজের প্রজেক্টর বসানো, বাকি থাকল আড়াইশ’। এগুলোতে ডিজিটাল চলচ্চিত্র দেখাতে হলে প্রজেক্টর ভাড়া করতে হবে। প্রডিউসরের টাকা দিয়ে ছবি বানিয়ে আবার প্রজেক্টর নিয়ে দেখায়। এটা কেমন ব্যবসা। এটাকে কি ব্যবসা বলে! এরপরও মাঝে মধ্যে চলচ্চিত্র বানাতে ইচ্ছে করে। ছবি বানিয়ে কাকে ধরব, কিভাবে চালাব। আর কত ছোট হব। এ সব ভেবেই আর বানাতে ইচ্ছা করে না।

হ্যাঁ, এখন তো ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে…

ইন্ডিয়াসহ সারা পৃথিবীতে ছবি চলে কিভাবে! ডিজিটাল মানে কী? জাজ যেটা বানাচ্ছে সেটাকেও তো ডিজিটাল বলা চলে না। ডিজিটাল হচ্ছে— আমি আমার কম্পিউটার থেকে কোড নাম্বার দেব স্যাটেলাইটে। স্যাটেলাইট থেকে তারা কোড দেবে প্রতিটা হলে। হলে ছবি চলবে স্যাটেলাইট থেকে। এত প্রতিবন্ধকতার পরও আমাদের দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে। অনেকেই নাটকের মতো সিনেমা বানাচ্ছে। তারপরও তো হচ্ছে। অনেকে আবার মনে করে ডিজিটাল ছবি মানে খরচ কম।

২২ বছর ধরে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন চালাচ্ছেন। বর্তমানে এর অবস্থা কী?

এটাই আমার জান, সবকিছু। আগে এখানে আমার প্রডাকশন অফিস ছিল, এখন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের অফিস। ২২ বছর ধরে আন্দোলন করছি। আমি জানি না, এটা সামাজিক আন্দোলন কিনা। কারণ কোনো সরকারই আমাদের আন্দোলনকে সহযোগিতা করেনি। ১৯৯৩ সালে শুরু করে যা কিছু করেছি নিজের চেষ্টায় করেছি। বড় কোনো প্রোগ্রামের সময় ব্যবসায়ীরা আমাদের স্পন্সর করে। এভাবেই চলছে আন্দোলন।

আমরা সরকারকে বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমরা বলেছিলাম— যারা এসএসসির পর পড়ালেখা করতে পারে না, তাদের বৃত্তি দিয়ে ৬ মাসের ড্রাইভিং কোর্স করিয়ে যদি ড্রাইভার বানানো যায়। এখন তো ড্রাইভারদের ভাল বেতন আছে। এ ব্যাপারে সরকারকে বলছিলাম। আমার প্রতিষ্ঠানে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দের কথাও বলেছিল। সেই টাকা আর দেয়নি। অন্যদিকে মন্ত্রণালয় থেকেই ‘নিরাপত্তা সড়ক’ নাম দিয়ে একটা গোষ্ঠী টাকা নিয়ে গেছে।

সংগঠনটি বর্তমানে কী কী কার্যক্রম চালাচ্ছে?

এখন একটা স্কুল চলছে। ২০১০ সালে আমরা ‘নিসা ড্রাইভিং এ্যান্ড মেকানিক্যাল ইনস্টিটিউট’ নামে একটা ড্রাইভিং স্কুল করেছিলাম। সেখানে বিনা পয়সায় এসএসসি পাস ছেলেদের ড্রাইভিং শিখাচ্ছি। এ পর্যন্ত প্রায় ৪৫০ জন ছেলে এখান থেকে বের হয়েছে।

আরেকটা কাজ করছি। ইনস্টিটিউশন থেকে না শিখেই যারা গাড়ি চালাচ্ছে, তাদের কমপক্ষে একদিনের মোটিভেশন কোর্স করাই। আর আমাদের সভা-সেমিনার তো চলছেই। এমনকি জনসভাও করেছি। আমি ওয়ালটনের সঙ্গে আছি। ওয়ালটনের মাধ্যমে ৩৭৫ এর বেশি জনসভা করেছি।

সবার উদ্দেশে যে কথাটি বলতে চান…

এ দেশ আমাদের। দেশটাকে ভালবাসতে হবে।

এক নজরে ইলিয়াস কাঞ্চন : জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ১৯৫৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার আশুতিয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম হাজী আব্দুল আলী ও মা সরুফা খাতুন। ইলিয়াস কাঞ্চন তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামের স্কুলে পড়েন। ১৯৬৬ সালে ঢাকায় এসে টিপু সুলতান রোডের গ্র্যাজুয়েটস হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৭৬ সালে সেখান থেকেই এসএসসি পাস করেন। কবি নজরুল ইসলাম সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হলেও চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার কারণে শেষ করেননি।


Leave a reply