অসম্ভবকে সম্ভব করার কারিগর জসিম
১৯৫১ সালের ১৪ আগস্ট জন্ম জসিমের। বাবা এ কে ফজলুর রহিম ছিলেন পুলিশ অফিসার। বাবার বদলির চাকরির সূত্রেই ঢাকার নবাবগঞ্জের মূল বাড়ির বদলে কেরানীগঞ্জে জন্ম তার।
জসিমের পুরো নাম এ কে জসিমউদ্দিন। ঢাকার আরমানিটোলা স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি ও পরবর্তীতে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন।
চলচ্চিত্রে জসিম
ছোটবেলা থেকে সপরিবারে সিনেমা হলে যাওয়ার সংস্কৃতি থেকে চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ হোন। স্কুল জীবনেই পাড়া-মহল্লায় কুস্তি প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে পরিবারকে চমকে দিয়েছিলেন। পুরস্কার জেতার আগে জসিম যে কুস্তিগির সেটা পরিবারের কেউই জানতো না।
কলেজজীবনেই জাতীয় ক্রীড়া ফাউন্ডেশন থেকে জুডো শিখেন, যা তার প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র এবং বাংলাদেশের সর্বপ্রথম অ্যাকশন দৃশ্য যুক্ত হওয়া চলচ্চিত্র জহিরুল হকের ‘রংবাজ’-এ সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল।
জসিম গিয়েছিলেন ‘রংবাজ’ ছবির শুটিং দেখতে। তৎকালীন সময়ের জনপ্রিয় নায়ক রাজ্জাকের ধাক্কায় ছবির একজন অভিনেতা বারবার পড়ে যাচ্ছিল দেখে জসিম পাশ থেকে মন্তব্য করছিলেন, ‘হচ্ছে না, এভাবে কেউ ধাক্কা খেয়ে কয়েক হাত দূরে পড়ে না।’ জসিমের মন্তব্য শুনে পরিচালক জহিরুল বলেছিলেন, ‘এই ছেলে বারবার এমন মন্তব্য করছো কেন? তুমি কি জানো কীভাবে পড়বে? জানলে দেখিয়ে দাও তো দেখি।’ আর তখনই তরুণ জসিম ঝটপট জুডোর কৌশল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে মারলে মাটিতে কোন ভঙ্গিতে পড়তে হয়। ব্যস, জহিরুল হকের মন জয় করে কয়েকটা দৃশ্য অভিনয় করে ফেললেন। এরপরেরটা ইতিহাস।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা চলচ্চিত্র যখন সামাজিক, রোমান্টিক ও ফোকধারা নিয়ে খুব ধীরে এগোচ্ছিল, ঠিক তখনই প্রয়াত জহিরুল হক ‘রংবাজ’ দিয়ে ঢাকার চলচ্চিত্রে অ্যাকশন দৃশ্য বা অ্যাকশন ধারার সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি টেকনিক্যাল সুবিধা ও পেশাদার অ্যাকশন গ্রুপ ছাড়াই গুটিকয়েক ‘টিসুম টিসুম’ দিয়ে অ্যাকশন ধারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেও পরবর্তীতে বাংলা অ্যাকশন ছবির উত্তরণে মূল কাজটি করেন জসিম। তার সঙ্গে ছিল জুডো শেখা বন্ধুবান্ধব মীর এনামুল করিম আমান, মাহবুব খান গুই ও রুহুল আমিন বাবুল। তারা পেশাদার মারপিঠের দল তৈরি করেন, যার নাম ‘জ্যাম্বস (JAMB’S) ফাইটিং গ্রুপ’। জ্যম্বাস ছিল সবার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে তৈরি।
‘রংবাজ’-এ খুব ছোট চরিত্রে দিয়ে জসিমের শুরু। এরপর বাংলাদেশের প্রথম খলনায়ক হিসেবে জসিমকে দর্শক দেখতে পায়। খলনায়ক হিসেবে একে একে পাই মাসুদ পারভেজের ‘গুনাহগার’, ‘দস্যু বনহুর’, দেওয়ান নজরুলের ‘দোস্ত দুশমন’, ‘আসামি হাজির’, ‘বারুদ’, ‘ওস্তাদ সাগরেদ’, ‘জনি’, ‘কুরবানি’, ‘ধর্ম আমার মা’, এ জে মিন্টুর ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘প্রতিজ্ঞা’, ‘বাঁধনহারা’, শেখ নজরুলের ‘আলী আসমা’, ইবনে মিজানের ‘বাহাদুর’, অশোক ঘোষের ‘তুফান’, শফি বিক্রমপুরীর ‘রাজদুলারি’সহ বক্স অফিস কাঁপানো ছবিগুলোতে।
তবে দেওয়ান নজরুলের ‘দোস্ত দুশমন’ দিয়ে আলোড়ন তোলেন আলাদাভাবে। কথিত আছে, ‘দোস্ত দুশমন’ ছবিতে সেই ডাকাত চরিত্রের অভিনয় দেখে ভারতের প্রখ্যাত অভিনেতা আমজাদ খান ভূয়সী প্রশংসা করেন, যিনি মূল ছবি ‘শোলে’তে একই ভূমিকায় ছিলেন।
দেওয়ান নজরুলের ‘আসামি হাজির’ ছবির ডাকু ধর্মার সঙ্গে ওয়াসিমের লড়াই দেখতে দর্শক সিনেমা হলের মূল গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেছিল। ছবিটি মুক্তির প্রথম দিনেই ঢাকার গুলিস্থান সিনেমা হলের কলাপসিবল গেট ভেঙে ফেলেছিল বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অস্থির দর্শকেরা। ‘আসামি হাজির’ ছবির দীর্ঘ ২০ মিনিটের শেষ ফাইটিং দৃশ্যটা দর্শক মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে উপভোগ করেছিল । এত লম্বা শেষ ফাইটিং দৃশ্য বাংলা চলচ্চিত্রের আমি এরপর আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
সব ছবিতেই জসিম ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলে হাজির হতেন এবং বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে স্টাইলিশ, স্মার্ট খলনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। খলনায়কের পাশাপাশি এর মধ্যে জসিম ‘সোহাগ মিলন’ ছবিতে দ্বিতীয় নায়ক হিসেবে অভিনয় করে ফেলেন।
এরপর আশির দশকের শুরুর দিকে পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝনটু’র পরামর্শে সুভাষ দত্তের ‘সবুজ সাথী’ ছবির মাধ্যমে নায়ক চরিত্রে পর্দায় হাজির হন, যেখানে দর্শক জসিমকে একটিবারও অ্যাকশন দৃশ্য বা মারামারি করতে দেখেনি। মজার ব্যাপার হলো, ‘সবুজ সাথী’ মুক্তির পর জসিম দুইদিন ঘর থেকে বের হননি, দর্শক তাকে নতুন রূপে গ্রহণ করবে কি করবে না এই চিন্তায়। কিন্তু প্রথম দুই দিনের মন্দাভাব কাটিয়ে হুট করে সারা বাংলাদেশে ‘সবুজ সাথী’ সুপারহিট হয়ে যায়। অর্থাৎ সিনেমা পাগল দর্শক নতুন জসিমকে গ্রহণ করেছে । জসিমের বাসায় প্রযোজকদের ভিড় লেগে গেলো নতুন ছবিতে নতুন জসিমকে দেখানোর জন্য।
খলনায়ক থেকে নায়ক চরিত্রে এসেও জসিম ব্যাপক সাফল্য লাভ করেন, যার ফলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ‘নায়ক জসিম’ হিসেবেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন ও আজও আছেন। বাংলা চলচ্চিত্রে দুর্দান্ত খলনায়ক থেকে দুর্দান্ত নায়ক হওয়ার রেকর্ড আর একটিও পাওয়া যাবে না ।
জসিম যখন নায়ক হয়ে ‘ রকি’, ‘ মোহাম্মদ আলী’, ‘ হাসান তারেক’ দিয়ে পর্দা কাঁপাচ্ছিলেন তখনো খলনায়ক রূপে পূর্বে চুক্তিবদ্ধ হওয়া সিনেমাগুলো মুক্তি পাচ্ছিল। তবুও নায়ক জসিমকে দমানো যায়নি। এ যেন অবিশ্বাস্য এক রূপকথা! বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন উদাহরণ দ্বিতীয়টি নেই।
অসম্ভবকে সম্ভব করা নাম জসিম
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে হলিউডের ‘সুপারহিরো’ ট্র্যাডিশনটা সার্থকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন জসিম। যার ফলে সেই সময়ের দর্শকদের মাঝে বেশ বড় একটা অংশের কাছে জসিম ছিলেন অন্যরকম এক উন্মাদনার নাম। জসিম মানেই ‘অসম্ভবকে সম্ভব করা’ কোন বীরপুরুষ, কোন সুপারহিরো। জসিম মানেই ঘাত প্রতিঘাত ,বাধা বিপত্তি জয় করা এক দুর্দান্ত সাহসী কোন মানুষ। আমি সিনেমা হলে যতবার অস্থির, উত্তেজিত, উচ্ছৃঙ্খল দর্শকদের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখেছিলাম তার প্রায় ৭০% ঘটনাই ঘটেছিল নায়ক জসিমের ছবির বেলায়। টিকিট ও সিট নিয়ে মারামারি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এর কারণ হলো, সুপারহিরো জসিমের জনপ্রিয়তা। দর্শক তার ছবি দেখতে এসে হলের বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ধৈর্য রাখতে পারতো না।
৯০ দশকের তরুণ দর্শক যারা সালমান-সানীর চরম ভক্ত তারাও জসিমের ভক্ত ছিলেন। আমার এক বন্ধু ছিল জসিমের মতো মোটাসোটা এবং চেহারাটাও জসিমের সঙ্গে অনেক মিল তাই যাকে আমরা ‘জসিম’ বলে ডাকতাম। সেই বন্ধুটি সালমানের দারুণ ভক্ত, কিন্তু জসিমের ছবি মুক্তি পেলে সবার আগে গিয়ে দেখে আসতো। পর্দায় জসিম যখন ভিলেনদের মারতেন তখন সে উত্তেজনায় সিটে বসা থেকে দাঁড়িয়ে ঘুষি দেখিয়ে ‘মার মার’ বলে চিৎকার করতো যা অন্য কোন নায়কদের ছবি বেলায় তাকে কোনদিন করতে দেখিনি।
জসিমের ছবি যাদের সিনেমাহলে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তারা কোনো দিনও বুঝতে পারবে না যে, তিনি কতটা জনপ্রিয় ছিলেন। বরং তাদের কাছে রূপকথার গল্পের মতোই লাগবে। জসিমের ছবি মানেই আমজনতার সুখ-দুঃখ ও জীবনসংগ্রামের গল্প। যার ফলে বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকদের বিরাট একটি অংশ পাগলের মতো ভালোবাসতো তাকে।
নায়ক হিসেবে জসিমের জনপ্রিয় ছবির মধ্যে রয়েছে মোহাম্মদ আলী, রকি, হিরো, অশান্তি, বৌমা, স্বামীর আদেশ, টাকা পয়সা, অভিযান, পরিবার, সারেন্ডার, ভাই আমার ভাই, ভাইজান, গর্জন, বিজয়, লালু মাস্তান, অবদান, ন্যায় অন্যায়, লোভ লালসা, আদিল, কাজের বেটি রহিমা, এক্সিডেন্ট, উচিৎ শিক্ষা, লক্ষ্মীর সংসার, মাস্তান রাজা, কালিয়া, ওমর আকবর, দাগি সন্তান, সম্পর্ক, শান্তি অশান্তি, বিস্ফোরণ, গরীবের প্রেম, শত্রুতা, নিষ্ঠুর, পাষাণ, হিংসা, ভাইয়ের আদর, হাতকড়া, ডাকাত, বাংলার নায়ক, রাজাবাবু, রাজাগুণ্ডা, আখেরি মোকাবেলা, বীর বাহাদুর, ঘাত প্রতিঘাত, স্বামী কেন আসামী, টাইগারসহ অসংখ্য ছবি তাকে এনে দেয় ‘অ্যাকশন কিং’ খেতাব।
খলনায়ক জসিমের যেমন ভক্ত ছিলাম ঠিক তেমনি নায়ক জসিমের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম শুধু মাত্র তার অভিনয় গুন, স্টাইলের কারণে। জসিম যেমন ধুমধাম অ্যাকশন, গরিব-দুঃখী মানুষের সাহসী নায়ক, ঠিক তেমনি ছিলেন খুব অসহায় নায়ক যিনি ‘সারেন্ডার’, ‘ভাইয়ের আদর’, ‘অবদান’, ‘লক্ষির সংসার’সহ অসংখ্য পারিবারিক রোমান্টিক ছবিতে প্রমাণ করেছিলেন ।
‘সারেন্ডার’ ছবির সেই ব্যর্থ প্রেমিক জসিমের করুণ মুখটি আজও সেদিনের দর্শকেরা হয়তো ভুলতে পারেনি। যে শাবানার সঙ্গে নায়ক জসিম সুপারহিট হয়েছিলেন সেই শাবানার পাশেই ভাইয়ের চরিত্রে জসিম সুপারহিট হলেন। শাবানার প্রেমিক, স্বামী হিসেবে জসিম যেমন দারুণ ঠিক তেমনি শাবানার বড় বা ছোট ভাইয়ের চরিত্রেও জসিম দুর্দান্ত যা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। পরিচালকরা জসিমকে সবভাবেই সদ্ব্যবহার করেই সফলতা পেয়েছিলেন যা এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
একটি মজার তথ্য না দিয়ে পারছি না। জসিম কখনো কোন ছবিতে জুনিয়র নায়ক-নায়িকাদের বুড়ো বাবার চরিত্রে অভিনয় করতে চাইতেন না, শুধু অ্যাকশন দৃশ্য দর্শক যদি তাকে গ্রহণ না করে বা অ্যাকশন দৃশ্য অভিনয় করার সুযোগ যদি পরিচালক না দেন সেই কারণে।
অভিনয় জীবনে জসিম কাজ করেছিলেন জহিরুল হক, সুভাষ দত্ত, ইবনে মিজান, আজিজুর রহমান, আলমগীর কুমকুম, দেওয়ান নজরুল, এ জে মিন্টু, ফজল আহমেদ বেনজির, মোতালেব হোসেন, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, সিদ্দিক জামাল নানটু, এফআই মানিক, শফি বিক্রমপুরীসহ দেশসেরা সব পরিচালক-প্রযোজকদের সঙ্গে।
অ্যাকশন কিং থেকে গায়ক
বাংলা বাণিজ্যিক ছবিতে অ্যাকশন ছবির উত্তরণে জসিমের অবদানের জন্যই তাকে ‘অ্যাকশন কিং’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। ‘সোহাগ মিলন’ ও ‘কাজের বেটি রহিমা’ ছবির দুটি গানে কণ্ঠ দিয়ে জসিম নিজের প্রতিভার আরেকটি স্বাক্ষর রেখে গিয়েছিলেন।
শুধু ফাইটিং ডিরেক্টর নয় প্রযোজক হিসেবেও জসিম ছিলেন খুবই সফল যার প্রযোজনা সংস্থা ‘জ্যাম্বস’-এর অনেক ছবি আছে বক্সঅফিস কাঁপানো ও ব্যবসাসফল। ‘দোস্ত দুশমন’ ছিল যেমন দেওয়ান নজরুলের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ঠিক তেমনি তা ছিল ‘জ্যাম্বস’-এর প্রথম ছবি। যদিও ‘জ্যাম্বস’ গ্রুপের পেছনে জসিমের বন্ধু মাহবুব খান গুই, মীর এনামুল করিম আমান ও রুহুল আমিন বাবুল ছিলেন, তবুও জ্যাম্বস বলতে দর্শকেরা জসিমের প্রতিষ্ঠানই বুঝে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অ্যাকশন ধারার প্রবর্তক এবং ‘ফাইটিং গ্রুপ’ এর শুরুটা জসিমের হাত ধরেই। আজকের অনেক ফাইট ডিরেক্টর ও স্ট্যান্টম্যান জসিমের ছাত্র ছিলেন। তার হাত ধরে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম, আরমান, চুন্নু, মোসলেমদের মতো ফাইট ডিরেক্টররা এসেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে জসিম
ব্যক্তিগত জীবনে জসিম ছিলেন খুবই পরোপকারী ও সাদাসিধে নিরহংকার মানুষ। ইউনিটের সকলের বিপদ-আপদে ছিলেন ভরসা।
জসিমের চলচ্চিত্রের গুরু পরিচালক জহিরুল হকের আকস্মিক মৃত্যুর পর তার পরিবারের পাশে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সকল সহযোগিতায় ছিলেন যা কেউই জানতো না। জসিমের মৃত্যুর পর জহিরুলের বড় ছেলে কাহিনিকার আব্দুল্লাহ জহির বাবু কথাটি জসিমের পরিবারকে প্রথম জানান যা তিনি জসিমের অনুরোধে গোপন করেছিলেন। অথচ আজকের অনেকে ব্যক্তিকে দেখা যায় টাকার জোরে নায়ক হয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে এসে প্রবীণ-দুস্থ শিল্পী-পরিচালকদের ব্যক্তিগত ম্যানেজারের মারফতে সামান্য টাকার চেক পাঠিয়ে পত্র-পত্রিকায় ছবি ছাপিয়ে বিরাট মহান ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে অসম্ভবকে সম্ভব করছেন যা তাদের হীনমন মানসিকতার পরিচয়। অথচ জসিম ব্যক্তিগতভাবে বহুজনের বিপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, যা সেদিনের কোন পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেননি, এমনকি আশপাশের কাউকেও জানতে দেননি। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ছবিতে কাজ করতে গিয়ে অনেক রাত হয়ে গেলে ইউনিটের নারী শিল্পীদের নিজের গাড়িতে করে নিজেই ড্রাইভ করেই নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে দিতেন জসিম।
আরও একটি তথ্য না দিয়ে পারছি না। একবার বাড়ির ঠিকাদার বেশ কিছু টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে গেলে জসিম তার পুরোনো ও বিশ্বস্ত রাজমিস্ত্রিকে রাগে চড় মেরেছিলেন, যিনি কিনা বয়সে কিছু বড়। জসিম রাতের বেলায় বাসায় ফেরার পর বুঝতে পারলেন দিনের দুর্ঘটনাটার জন্য শুধু শুধু রাজমিস্ত্রিকে অপমান করা ঠিক হয়নি। ভোর হওয়া মাত্রই সেই বাসায় ছুটে গিয়ে ঘুম থেকে তুলে রাজমিস্ত্রির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং তার পরিবারের সঙ্গে সকালের নাশতা খান। পর্দার জসিম বাস্তবেও ছিলেন অনেক বড় মনের মানুষ, আচরণ দিয়ে সবার মনে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন।
বাস্তবেও অ্যাকশন
মৃত্যুর কিছুদিন আগে উত্তরায় জসিম যখন নতুন বাড়ির কাজ শুরু করেছিলেন তখন স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। জসিম সন্ত্রাসীদের নিজের বাসায় টাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। কথামতো ৩-৪ জন সন্ত্রাসী অফিসে এসে হাজির হয়।
জসিম ৫ লাখ টাকা তাদের হাতে তুলে দিয়ে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে বললেন, ‘তোমাদের কথামতো আমি টাকা দিয়েছি, তোমরা টাকা নিয়ে চলতে যেতে পারবে একটি শর্তে। তা হলো যদি আমার সঙ্গে শূন্য হাতে লড়াই করে আমাকে পরাজিত করে ফেলে দিতো পারো তাহলে। কারণ আমার অনেক কষ্টে আয় করা করা টাকা তোমরা চাওয়া মাত্র অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছো। যদি তোমাদের শক্তি থাকে তাহলে আমার সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হয়ে টাকাটা নাও তাতে আমার কোন আক্ষেপ থাকবে না।’
জসিমের কথা শুনে সন্ত্রাসীদের গলা শুকিয়ে গেলো। সন্ত্রাসীরা সেদিন জসিমের সাহসিকতা দেখে মাথা নত করে ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিয়েছিল যা ছিল অনেকের অজানা।
অবশেষে
জহিরুল হকের ‘সারেন্ডার’ ছবিতে জসিমের গেয়ে উঠেছিলেন, সবাই তো ভালোবাসা চায়/ কেউ পায় কেউবা হারায়/ তাতে প্রেমিকের কী আসে যায় ‘ … সেই ছবিতে জসিম ভালোবাসার মানুষটিকে না পেলেও সারা জীবন মানুষটিকে ভালোবেসে গিয়েছিলেন এবং ভালোবাসার মানুষটির বুকের ধন একমাত্র শিশু পুত্রটির জীবন বাঁচিয়ে দিয়ে নিঃস্বার্থ এক প্রেমিক হিসেবে দর্শকদের মনে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। চলচ্চিত্রের জসিমও ‘সারেন্ডার’ ছবির সেই চরিত্রের মতোই রয়ে গেলেন।
জসিম আধুনিক বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে উত্তরণে নিবেদিত ছিলেন। নিজের মেধা, অভিনয়, শ্রম, আন্তরিকতা, সততা দিয়ে যেমন প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পী, দর্শকসহ মানুষের মন জয় করে নিয়েছিলেন ঠিক তেমনি ব্যক্তিগত জীবনে অনেক বড় মনের মানুষ হিসেবেও আশপাশের সকল মানুষের মন জয় করে ‘কিং’ হয়ে নীরবে আজও বেঁচে আছেন ও থাকবেন।
আধুনিক দুর্ভাগা ও অকৃতজ্ঞ জাতি চলচ্চিত্রের ‘অ্যাকশন কিং’ জসিমকে মনে না রাখলেও তাতে কিছু যায় আসবে না। জসিম বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আকাশে চিরদিন উজ্জ্বল এক নক্ষত্র হয়েই জ্বলবেন চিরদিন তাতে অন্ধরা না দেখলেও জসিমের কিছু যায় আসবে না। জসিম ঠিকই তার ভক্তদের মনে চিরদিন রয়ে যাবেন ।
১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মৃত্যুবরণ করেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, আমজনতার জনপ্রিয় নায়ক অ্যাকশন কিং জসিম।