Select Page

অসাধারণ রোজী

অসাধারণ রোজী

১৯৬৯ সাল। গুণী পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা নির্মাণ করেন সুপার হিট ‘নীল আকাশের নীচে’। ছবিটি রোজী আফসারীর (তখন অবশ্য রোজী সামাদ) ক্যারিয়ারে দারুণ পরির্বতন আনে। একজন সাধাসিধে ট্যাক্সি ড্রাইভারের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হন তিনি, যদিও এর আগে তার করা হয়ে গেছে প্রায় বিশটির মতো চলচ্চিত্রে অভিনয়। তবে এ ছবিটি থেকেই মূলত একজন রোজীর চরিত্রাভিনেত্রীর এক সফল ক্যারিয়ার শুরু। যেখান থেকে আমরা তাকে পেয়েছি মমতাময়ী মা, স্নেহময়ী বোন ননদ বা দেবরের মিষ্টি ভাবী আবার কখনও আদর্শ স্ত্রীর চরিত্রে। প্রতিটি চরিত্রেই তিনি ছিলেন সফল।

গোলাম মুস্তফার সঙ্গে রোজী

মিতার ‘দ্বীপ নিভে নাই’, ই আর খানের ‘দাসী’, নুরুল হকের ‘বড় বউ’, খান আতাউর রহমানের ‘সুখ দুঃখ’, শিবলী সাদিকের ‘মা মাটি দেশ’, মালেক আফসারীর ‘এই ঘর এই সংসার’-এর মতো চলচ্চিত্রগুলোর গল্প তৈরিই হয়েছিল রোজী আফসারীকে নিয়ে!

শামীমা আক্তার রোজী, যাকে আমরা রোজী নামেই চিনি, যিনি রোজী সামাদ নামেও পরিচিত ছিলেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ এপ্রিল লক্ষীপুর জেলার শমসেরাবাদ গ্রামে জন্ম তার, বেড়ে উঠেন ঢাকার পুরানা পল্টন এলাকায়। প্রথমে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল ও পরে ভিকারুন্নেসা নুন স্কুলে পড়াশোনা করেন। ভীষণ ডানপিটে রোজীর ছোটবেলা থেকেই সাইকেল চালানো, ঘোড়ায় চড়া, খেলাধুলা আর নাচের প্রতি আগ্রহ থাকার দরুন তার পিতা মো. অলিউল্লাহ বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন এবং বেশ কয়েক বছর তিনি সেখানে নাচের তালিম নেন।

চার বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে রোজী ছিলেন সবার বড়। মা হাসনা হেনা আখতারী চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতেন, বাবা অলিউল্লহ ছিলেন সুপরিচিত একজন কবি ও গল্পকার।

প্রথম স্বামী আব্দুস সামাদের সঙ্গে রোজী

রোজী বাবার বন্ধু জিল্লুর রহিমের পরিচালনায় ‘এই তো জীবন’ (১৩/০৩/১৯৬৪) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রথম অভিনয় করেন, তার নায়ক ছিলেন শওকত আকবর সাহেব। মামাদের প্রবল আপত্তি থাকলেও মূলত বাবার অনুপ্রেরণা ও উৎসাহে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এরপর একের পর এক ছবিতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।

জহির রায়হানের ‘সঙ্গম’ (উর্দু), বেবী ইসলামের ‘তানহা’ (উর্দু) কাজী জহিরের ‘বন্ধন’ (উর্দু), ইবনে মিজানের ‘একালের রূপকথা’, ‘রাখাল বন্ধু’, মিতার ‘চাওয়া পাওয়া’সহ বিখ্যাত অনেক চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে থাকেন রোজী।

এর মধ্যে কাজী জহিরের ‘বন্ধন’ ছবিতে মাত্র ১৪-১৫ বছরের বালিকা রোজী ৪০ ঊর্ধ্ব নারীর চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দেন। ছবিটির জন্য গ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড ও স্ক্রিন নাইট অ্যাওয়ার্ড পান তিনি। এই পুরস্কার দুটি পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) কোন শিল্পীর জন্য প্রথম ছিলে (তথ্যটি যাচাই করা হয়নি)।

কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কারে পুরস্কৃত হন রোজী আফসারী। প্রথম শুরু হওয়া জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ১৯৭৫ সালে মিতার পরিচালনায় ‘লাঠিয়াল’ ছবিতে শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা আর বাউন্ডুল স্বভাবের দেবরের প্রতি মা ও ছেলের ভালোবাসার মতো দ্বন্ধপূর্ণ চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় স্বরূপ তিনি এই পুরস্কারে সন্মানীত হন।

চলচ্চিত্রের পাশাপাশি দু-তিনটি টিভি নাটকেও অভিনয় করেন তিনি। এর মধ্যে ১৯৬৮ সালে আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় ‘সংশপ্তক’ নাটকে হুরমতি চরিত্রে অভিনয় করেন, এ ছাড়া ‘শাহজাহান’, ‘পদ্মগোখরা’ নামেও দুটি নাটকে অভিনয় করেন তিনি (তথ্যটি যাচাই করা হয়নি। অভিনয়ের পাশাপাশি রোজী আফসারী ১৯৮৬ সালে ‘আশা নিরাশা’ (০৪/০৭/১৯৮৬) নামের একটি ছবি পরিচালনাও করেন।

রোজী এ দেশের প্রথম বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক আব্দুস সামাদ (১৯৩৭-২০০৪) এর সাথে ১৯৬৫ সালের ২১ ডিসেম্বর কোর্ট ম্যারেজ করেন, এরপর ১৯৬৫ সালে ২৭ ডিসেম্বর পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয় রমনা কাজী অফিসে। তখন তিনি স্বামীর নামের সাথে যোগ করে রোজী সামাদ নামে পরিচিত ছিলেন, তবে ১৯৮৬ সালের ৫ মে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। তাদের একমাত্র মেয়ের নাম কবিতা সামাদ। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে পরিচালক মালেক আফসারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দুজনে মিলে গড়ে তুলেন ‘রোজী ফিল্মস’ নামের একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে বেশ কয়েকটি সফল চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়।

সত্যজিৎ রায় ও সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে রোজী

নব্বই দশকের পর হতে রোজী আফসারী আস্তে আস্তে চলচ্চিত্রে অভিনয় কমিয়ে দেন, উনার সর্বশেষ অভিনীত চলচ্চিত্রটি ছিল নূরুল আলম পরিচালিত ‘পরম প্রিয়া’। ২০০৭ সালের ৯ মার্চ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে মূত্যুবরণ করেন সবার প্রিয় রোজী আফসারী! মহান আল্লাহ্তয়ালা তাকে বেহেস্ত নসীব করুন!

মালেক আফসারীর সঙ্গে রোজী

প্রায় দুই শতাধিকের কাছাকাছি ছবিতে অভিনয় করা রোজী আফসারীর উল্লেখ্যযোগ্য কিছু ছবি: এইতো জীবন, সঙ্গম (উর্দু; পাকিস্তানের প্রথম রঙিন সিনেমা), তানহা (উর্দু), বন্ধন (উর্দু), রাখাল বন্ধু, এতটুকু আশা, আলোর পিপাসা, জোয়ার ভাটা, নীল আকাশের নীচে, যে আগুনে পুড়ি, কখগঘঙ, জীবন থেকে নেয়া, অধিকার, দ্বীপ নিভে নাই, বড় বউ, সুখ দুঃখ, কাঁচের স্বর্গ, পুনম কি রাত (উর্দু), ইস ধারতি পার (উর্দু), রংবাজ, তিতাস একটি নদীর নাম, চোখের জলে, সূর্য সংগ্রাম, সূর্য গ্রহণ, আলোর মিছিল, দুই রাজকুমার, লাঠিয়াল (জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত), আলোর পথে, বন্ধু, মিন্টু আমার নাম, দাবী, অশিক্ষিত, ফকির মজনু শাহ, ঘর জামাই, ছোট মা, শহর থেকে দুরে, নাগর দোলা, মোকাবেলা, প্রতিজ্ঞা, আনার কলি, বিনি সুতার মালা, স্বামী, সোহাগ মিলন, সওদাগর, মেঘ বিজলি বাদল, টক্কর, তাসের ঘর, আল হেলাল, প্রতিহিংসা, চেনামুখ, চ্যালেজ্ঞ, নাজমা,গাদ্দার, পদ্মাবতী, মহল, সকাল সন্ধ্যা, রাজডন্ড, গীত, সোনার সংসার, বধু বরন, মায়ের দাবী, মা বাপ, আশা নিরাশা, দ্বীন দুনিয়া, রাস্তার রাজা, মা মাটি দেশ, মরন কামড়, ধনী গরীব, ক্ষতিপূরণ, ঘরবাড়ি, ক্ষমা এবং  এই ঘর এই সংসার।


About The Author

আরিফুল হাসান

চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক

Leave a reply