অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয়
পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি – সত্তা, গল্প – সোহানী হোসেন, পরিচালক – হাসিবুর রেজা কল্লোল, মুক্তি – ৭ এপ্রিল ২০১৭
শ্রেষ্ঠাংশে – শাকিব খান, পাওলি দাম, নাসরিন, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শামীমা নাজনীন, কাবিলা, রীনা খান, ডন প্রমুখ।
উল্লেখযোগ্য গান – তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম, না জানি কোন অপরাধে।
‘সত্তা’ ছবি সমাজের বাস্তবসম্মত ঘটনা থেকে উঠে আসা ব্যক্তির অস্তিত্বের সংগ্রামের গল্প এবং সে অস্তিত্বের সন্ধানের মাধ্যমে উঠে এসেছে আত্মপরিচয়। নারী উদ্যোক্তা সোহানী হোসেন তার ‘মা’ গল্পে মায়ের সন্তান জন্মদানের সাথে নিজের সামাজিক স্বীকৃতি এবং সমস্যার সাথে যুদ্ধ করা প্রধান দুই চরিত্রের বাস্তবিক সংগ্রাম দেখান। নিজের ঠিকানা সমাজের কোথায় সেটি খুঁজতে খুঁজতে একজোড়া নারী-পুরুষ নিজেদের জীবনের গল্প বলে। নির্মাতা এ গল্পকে দুইভাবে সাজিয়েছেন প্রথমত বাস্তবতা মেনে নেয়া এবং বাস্তবতার মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যার বিরুদ্ধে যাওয়া। সমাজের বাস্তবতা মেনে নেয়াতে সিনেমার প্রধান দুই অভিনেতা-অভিনেত্রী সমানভাবে ছিল পরে সামাজিক প্রতিবাদে অভিনেতাকে দেখা গেছে। গল্প ও সিনেমা বলে দেয় সমাজে অস্তিত্বরক্ষার চেয়ে বড় আর কিছুই নেই এবং সে অস্তিত্ব আত্মপরিচয়ের জন্যই।
সীমান্ত এলাকার অবক্ষয়যুক্ত সমাজ থেকে প্রধান অভিনেত্রী পাওলি দামের উঠে আসা। মায়ের মৃত্যুর পর শহরে আসলে শহুরে জীবনের ফাঁদে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সে পড়ে যায়। তখন আর কিছুই করার থাকে না। ভাগ্য এবং বাস্তবতা দুটোই পাশাপাশি চলতে থাকে। পতিতাবৃত্তিতে মনের বিরুদ্ধেই যোগ দিতে হয়। ঘটনাক্রমে প্রধান অভিনেতা শাকিব খানের সাথে দেখা হয়। মাদকের সাথে তার নিত্য ভাব। হুক্কা টেনে আরামে কথা বলে। পাওলির প্রতি তার ভালো লাগা তারপর তাদের সন্তান আসলে অস্তিত্বের সংকটে পড়ে পাওলি। সমাজের প্রচলিত সমস্যায় এসব ক্ষেত্রে নারীকে প্রথমে ভোগান্তি সইতে হয়। সমাজের এ সমস্যাকে কাউন্টার দেবার জন্য শাকিব খান তখন প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান করে। আর এখানেই ছবির দর্শন তিনভাগে ভাগ হয় –
১. সমাজের জীর্ণ সমস্যাকে দেখানো
২. প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
৩. প্রতিষ্ঠান গড়ে সমাধানের পথ বলা
সামাজিক সমস্যার মধ্যে প্রধানত শাকিব খান ও পাওলি দাম দুজনই ছিল। সমস্যাগুলোর আকার ছিল এরকম –
১. নারীর প্রতি অবিচার
২. পতিতাবৃত্তি
৩. মাদকাসক্তির প্রভাব
৪. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা
৫. ফ্যাশনেবল তারুণ্যের সমস্যা
৬. বুদ্ধিবৃত্তিক অবনতি বা টক শো সমস্যা
৭. সম্পত্তি সমস্যা
৮. চিকিৎসা দুর্নীতি
এসব সমস্যার বিপরীতে নিজেই অবস্থান নেয় প্রধান চরিত্র শাকিব খান। তার বাবা হওয়ার পথে যে সামাজিক সমস্যাগুলো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেগুলোকে কাউন্টার দেবার পালা তখনই শুরু হয়। সিনেমাটি সেখানেই শক্তিশালী হতে শুরু করে। নিজে যে জীবন যাপন করত তার বিরুদ্ধে নিজেরই অবস্থান থাকা কঠিন বিষয়। শাকিব খান সেটাই করে নিজের সত্তা-কে সন্তানের পিতার দায়িত্বশীল ভূমিকার জন্য যাতে করে নিজেকে নতুন করে চেনা যায়। অন্তর্গত সত্তাটা সেখানেই বাস করে। এর মধ্য দিয়ে আইডেনটিটি ক্রাইসিসকে শাকিব খান উপলব্ধি করে।
প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গিয়ে শাকিব খান যে সংগ্রাম করে তার আগে সামাজিক অপরাধের সাথে সে নিজেই সংযুক্ত থাকে। মাদকাসক্ত শাকিব খান সাংবাদিকের সাথে তার কথোপকথনে নিজেকে যেভাবে পরিচয় করায় সেখানে স্যাটায়ার ছিল। সেই স্যাটায়ারে বাস্তবতা উপস্থিত। তার বক্তব্যে ছিল- ‘রোজ তো বাঁচার লাইগা ফরমালিন খান আর স্বপ্নের জন্য এইটা (হুক্কা) খাইলেই দোষ?’ তার এ সংলাপে ‘ফরমালিন’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে খাদ্যে ভেজাল সমস্যা তুলে ধরাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কি হয় সে কথা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় তুলে ধরে স্যাটায়ারে। তারুণ্যের ফ্যাশনেবল আচার-আচরণের মধ্যে যে সমস্যা থাকে সেটিকে আঘাত করা হয়। পাওলি দামকে জোর করে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার পর তার যে বাস্তবতা শুরু হয় সেখানে শাকিব খান আসে প্রেমিকের বেশে তারপর বাবার ভূমিকায়। পাওলির সামাজিক স্বীকৃতির সমস্যা ছবির মানবিক দিক। চিকিৎসকের যৌন কামনা থেকে পাওলির বাস্তবতা শুরু এবং খুনের পর শহরে আসলে ক্রাইসিস শুরু। নাসরিন সে স্বীকৃতির জন্য আর একজন সংগ্রামী কিন্তু রীনা খান সমস্যার মধ্যেই একজন। অন্যদিকে শাকিব খানের ব্যক্তিজীবনের সম্পত্তি সমস্যায় তার আপনজনের সাথে লড়াই করতে হয় এটাও সামাজিক সমস্যা।
এ সমস্যাগুলোর বিপরীতে শাকিব বিদ্রোহ করে। যে আইডেনটিটি ক্রাইসিসে পাওলি দাম পড়ে যায় শাকিব তাকে সেই আইডেনটিটি দেয়। এরপর যেসব বাধা ছিল সেগুলোকে কাউন্টার দেয়। কাউন্টার দিতে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। সেগুলো ছিল এ ধরনের –
১. সে চিকিৎসকের কাছে যায় সেখানে পাওলির চিকিৎসা করতে রাজি ছিল না ডাক্তার। কারণটা পতিতা। শাকিব বাধ্য করায় চিকিৎসা করতে। হাস্যরসের মাধ্যমে কঠিন বাস্তবতা উঠে আসে।
২. কোচিং সেন্টারে যায় শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করা শিক্ষককে ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে তাদের মুখোশ খুলে দিতে। বিদ্রোহের পথটা যখন দেখিয়ে দেয় সেখানে প্রতিবাদটা ছাত্র-ছাত্রীরাই করে। জুতা ছুঁড়ে মারে ব্যবসায়ী শিক্ষকদের মাঝে। বাস্তবে এমন হাজারো ব্যবসায়ী শিক্ষক আছে যাদের শিক্ষা দেয়া কর্তব্য। বর্তমানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো জঘন্য অপরাধের সাথে অসৎ শিক্ষকই জড়িত প্রধানভাবে।
৩. মাদকচক্রের বিরুদ্ধে নিজেই রুখে দাঁড়ায় শাকিব অথচ হুক্কা ছাড়া তার চলতই না। হিরোইন ধরিয়ে দিয়ে ডিস্ট্রিবিউটরকে কনজিউমার করে দেয় যা সিনেমার অন্যতম শক্তিশালী একটা পার্ট প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবাদের ক্ষেত্রে।
৪. টক শো-তে বুদ্ধিজীবী সাজতে যাওয়া কতিপয় অসাধু লোকের কারবার। এরা সমস্যা তৈরির চেষ্টায় থাকে তাদের কথাবার্তায়। এদেরকে শিক্ষা দিতে টক শো-র মধ্যে নেশাগ্রস্ত করে অপমান করা হয় লাইভে। এটা চমৎকার ছিল।
৫. সম্পত্তি সমস্যা চিরায়ত একটা দিক। এতিমের সম্পত্তি বেশি থাকলে তাকে জেঁকে ধরার লোক অনেক থাকে। সেদিক থেকে জাদু আজাদ, ডন তারা শাকিবের পারিবারিক শত্রু। ঘরের সমস্যাকে মেটাতে শাকিব তাই বিদ্রোহী হয়।
এ সমাধানের পথগুলো যখন শাকিব নিজেই দেখিয়ে যাচ্ছিল এর পাশাপাশি সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। পতিতার নামে প্রতিষ্ঠান বলে প্রথমত সাংবাদিক ও উপস্থিত লোকজন আপত্তি করলে বলে-’পতিতা সমাজের অভিশাপ আর কাউকে যেন এ অভিশাপের মধ্যে পড়তে না হয়।’ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গিয়ে আবার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এটা সিনেমার আর একটি শক্তিশালী দিক। খারাপ প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস এবং ভালো প্রতিষ্ঠানের জন্ম এটাই মূলকথা।
সংলাপ ছিল ‘সত্তা’ ছবির প্রাণ। সংলাপের মাধ্যমে social message উঠে এসেছে। সামাজিক সমস্যা দেখিয়ে তার সমাধানের পথ দেখানো যেমন লেখিকা সোহানী হোসেনের লক্ষ্য তার সাথে মেসেজ দেয়াও ছিল লক্ষ্য। ছবিতে সেটা সেন্স অফ হিউমার এবং স্যাটায়ার দুই দিক থেকে দেখানো হয়েছে। সংলাপগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু না বললেই নয় –
১. শাকিব খান : টাকার কি খুব দরকার?
পাওলি দাম : বাঁইচা থাকা দরকার
এ সংলাপটি ছিল পাওলির পতিতাবৃত্তির জন্য বলা। পতিতাবৃত্তিকে না বলাটা যেমন এখানে আছে পাশাপাশি অস্তিত্বের সংগ্রামটাও আছে।
২. পণ্যের ডিস্ট্রিবিউটর হইতে পারলে কনজিউমার হতে সমস্যা কি আপনার?
এ সংলাপটি শিমুল খানকে বলে শাকিব খান। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতিতে যোগানদাতাকে ভোক্তা বানানো কঠিন যেখানে মাদকের সাপ্লাই দিচ্ছে শিমুল খান তাকে বাগে আনতে বা ব্যবসা বন্ধ করতে হিরোইন খাওয়াচ্ছে শাকিব খান। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা।
৩. এই দেশে কোনোকিছুই যখন ভালো না তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কী করে ভালো হবে স্যার?
সোহেল রশিদ এ সংলাপটি বলে শাকিবকে। দেশের সব সেক্টরের দুর্নীতির মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও আক্রান্ত তাই এ সংলাপ এবং তা বাস্তবসম্মত।
৪. রোজ তো বাঁচার লাইগা ফরমালিন খান আর স্বপ্নের লাইগা এইটা (হুক্কা) খাইলেই দোষ?
মজার মাধ্যমে খাদ্যে ভেজাল এবং মাদকাসক্তির প্রভাব নিয়ে কথা বলে শাকিব খান।
৫. আমি শুরু করছি মাত্র শেষ করবেন আপনারা।
শাকিব খারাপ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ভালো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে এবং এর ধারাবাহিকতা রাখার জন্য সমাজের বাকিদের আহবান করে।
৬. ঘুমা একটু ঘুমা।
পেটের ক্ষুধায় পাওলির পেটের সন্তান নড়াচড়া করে। দারিদ্র্য ও পতিতাবৃত্তির বাস্তবতা করুণ হয়ে ওঠে এ সংলাপে।
সংলাপগুলোতে ইন্টারেস্টিং ও সিরিয়াস দুই ধরনের উপাদানই আছে।
৭. ‘অর যা রূপ শিয়াল কুকুরে তো দেখবই’
রীনা খানের অসাধারণ সংলাপ। নারীলোভীদের চেহারা এ সংলাপে স্পষ্ট।
ছবির নির্মাণের সুনির্দিষ্ট সমস্যাটা ভালো দর্শন থাকার পরেও ছিল। সেখানেই মার্কিংটা বাধাগ্রস্ত হয়। স্টোরি টেলিং ভালোই ছিল। কিন্তু প্রথমার্ধ্বের চেয়ে দ্বিতীয়ার্ধ্বে যে গতি ছিল সেখানে দর্শকের একটা মনোযোগের ঘাটতির সুযোগ থেকে যায়। ক্যামেরার কাজ কিছু জায়গায় চমৎকার কিন্তু ইনডোর শটগুলোতে দুর্বলতা আছে। বিশেষ করে শাকিবের পারিবারিক সমস্যার জায়গায় ডন, জাদু আজাদ এদের অভিনয়ের গমানুগতিক ধারা এবং সেটের মধ্যে পুরাতন আবহ আছে। তার সাথে শাকিবের লং টার্ম শিডিউল সমস্যার কারণে লুকের সমস্যা তো ছিলই। শাকিবের সাথে পাওলির পরিণতি কি হয় এবং এর মাধ্যমে শাকিব নিজেকে কীভাবে আবিষ্কার করে সেখানে আছে তাদের সত্তার পূর্ণতা। বিষয় ও দর্শন ‘সত্তা’-কে গুরুত্বপূর্ণ করে ফিনিশিং-এ।
জেমস-এর ‘তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম’ আগে থেকেই হাইপের জন্য জনপ্রিয় হয়েছিল। মমতাজের ‘না জানি কোন অপরাধে’ গানটিও তাই। বাকিগুলো রোমান্টিক ধারায় চলনসই।
শাকিব খান, পাওলি দাম, নাসরিন, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রীনা খান তারা ন্যাচারালি পারফর্ম করেছে। ডন, জাদু আজাদ, কাবিলা খাপছাড়া ছিল। কাবিলা গতানুগতিক অভিনয়ের জন্য কমেডি পার্টটা জমেনি। অথচ কমেডি নায়কের মাধ্যমেই অনেকটা কাভার হয়েছে। নাসরিন তার অন্য অনেক ছবির থেকে এ ছবিতে ভিন্নভাবে প্রধান দুই চরিত্রকে সাপোর্ট করার ক্ষেত্রে আলোচিত হয়ে থাকবে। মনোযোগী ছিল অভিনয়ে এবং লুকও ভালো ছিল। শাকিব খানের জন্যও তার অন্যতম সেরা ছবি হয়ে থাকবে।
সমাজ থেকে সমস্যা কখনো উঠে যায় না। সমস্যাগুলোকে ছবিতে পুরোপুরি তুলে ধরাও যায় না। যতটা তুলে ধরলে সচেতনতা তৈরির একটা প্রচেষ্টা ভালোভাবে করা যায় সেটা ‘সত্তা’ ছবিতে আছে।