Select Page

আইন মুক্তি দিলেও সমাজ রেহাই দেয় না, ‘দাগি’ এক নির্মম বাস্তবতা

আইন মুক্তি দিলেও সমাজ রেহাই দেয় না, ‘দাগি’ এক নির্মম বাস্তবতা

রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের প্রতিশোধপরায়ণ কাঠামোতে মানুষ আসলে কোথায় দাঁড়ায়? আইন আদালত, কোর্ট কাচারি মানুষকে মুক্তি দিলেও সমাজ, রাষ্ট্র,পরিবার সহসাই মানুষকে মুক্তি দেয় না!

মানুষ নামক কস্টিউমে সবচেয়ে নিকটতম তিনটি অঙ্গ ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে থাকে: প্রথমটি রাষ্ট্র, দ্বিতীয়টি সমাজ, তৃতীয়টি পরিবার। মানুষকে আমি রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজের পোশাক হিসেবেই জানি। কারণ, রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার মানুষকে যে পোশাকে দেখতে চায়—মানুষ আসলে তাই।

রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার—এই তিনটি অঙ্গ মানুষকে হয় ধারণ করে, লালন-পালন করে, এমনকি বিকশিত করে। আর না হয়, এই তিনটি অঙ্গই কালেভদ্রে মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, মানুষের বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মানুষকে কারণে অকারণে ডমিনেট করে।

মানুষ নামক প্রজাতন্ত্রে মানুষের সাথে সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার এই তিনটি অঙ্গ ভয়াবহ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে থাকে। সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার মানুষকে প্রতিশোধপরায়ণ হতে শেখায়।

মানুষের জীবনে যত রকমভাবে ঝড়, ঝঞ্ঝাট, ঝুঁকি, ঝামেলাই আসুক না কেন—সেগুলো কোন রাস্তায় মীমাংসা হবে, সেই রাস্তা একজন মানুষের জন্য সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার কখনোই খোলা রাখে না।

কারণ, যে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার যুথবদ্ধভাবে মানুষকে গড়ে তোলার কথা ছিল, সেখানে এই তিনটি অঙ্গই মানুষের জীবনে নিরুপায়ভাবে আচরণ করে। মানুষকে যথাযথ উপায়ে গড়ে তোলার জন্য এই তিনটি অঙ্গই অপর্যাপ্ত।
তাতে অসুবিধাই বেড়েছে।

অথবা মানুষ যখন বুঝে হোক, আর না বুঝে হোক—বে-আইনি, অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে, বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত হয়, এমনকি সংঘটিতভাবে নিরুপায় মানুষের ক্ষতিও করে, তখন যাঁর ক্ষতি হয়ে গেল, সেই মানুষটিকে সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার ভয়াবহ অরাজকতার মাধ্যমে আবার প্রতিশোধ নেওয়ার বয়ানই প্রতিনিয়ত শেখায়।
কিভাবে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, তার পাশে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার যথাযথভাবে দাঁড়ায় না।

মনে হয়, এখানে প্রতিশোধের কাফেলাই শেষ কথা।
এই কাফেলায় উত্তীর্ণ যে হবে, সেই সবচেয়ে বাহবা পাবে।
রক্তাক্ত কাফেলার বাহিরেও মানুষের মুক্তির অসংখ্য রাস্তা খোলা রাখা যেত—সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ তেমন হয়নি এখানে।

সেখানে কিভাবে প্রতিশোধ না নিয়ে, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতির পরিমাণ কমানোর দায়িত্ব নেওয়া যায়—সেই আলাপ, বয়ান, প্রক্রিয়া, পদ্ধতি সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবারে একবারেই অনুপস্থিত।

🎥 ‘দাগি’ সিনেমায় অন্যরকম সাহস: প্রতিশোধ নয়, সংবরণ

আমি চলচ্চিত্র পরিচালক শিহাব শাহীনকে অনেকদিন ধরে লক্ষ্য করে আসছি।
সে মোটামুটি বাংলাদেশের মানুষের সাইকোলজি স্টাডি করে গল্প তৈরি করে।
ধীর গতিতে গল্পের অস্তিত্ব খোলাসা করে।

একটা গল্পের মধ্যে, সমাজের তথাকথিত জীবনকে চ্যালেঞ্জ করার মতো বিকল্প জীবন আদৌ আছে কি না, সেই অনুসন্ধান সব পরিচালক করতে পারে না।

সবাই কেবল প্রতিশোধের গালগল্পের পসরা সাজিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে।
প্রতিশোধকে পাশ কাটিয়ে ইউটার্ন দিয়ে কিভাবে দায়বোধ তৈরি করা যায়, রিটার্ন তৈরি করা যায়—সেই আলাপ চলচ্চিত্রের ভাষায়, চিন্তানন্দনতাকে বাড়িয়ে দিতে পারে একজন সফল চলচ্চিত্র নির্মাতা।

অনেকদিন পর বাংলা চলচ্চিত্রে আজকে ‘দাগি’ সিনেমার মধ্যে সেই রকম উপাদান খুঁজে পেলাম।
‘দাগি’ সিনেমায় কোনো সংকীর্ণতা জায়গা পায়নি। বরং সংবরণ কী জিনিস, সেটাই গল্পের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে।

আমি এমনিতেই নিশোর ভক্ত। ওর অভিনয় শিল্পের বৈচিত্র্য পুনঃপুনিক।
অভিনয়কে সাধারণ কাতারে নামিয়ে আনার ক্ষমতা নিশোর মধ্যে আছে।
কোনো হাইপ তোলা সিনেমা নয়, কিন্তু মানুষের সাথে গল্পের ছলে কথা বলার জন্য যে অভিনয়ের দরকার হয়—সেটা নিশো ভালোভাবে করতে পেরেছে।

এছাড়া কয়েদি স্ত্রীর চরিত্রে তমা মির্জা, কয়েদির মেয়ে চরিত্রে সুনেরাহ বিনতে কামাল, বিশেষ চরিত্রে মনোজ কুমার প্রামাণিক, রাশেদ মামুন অপু, গাজী রাকায়েত, শহীদুজ্জামান সেলিম, মিলি বাশার, মনিরা আক্তার মিঠু, মেহের আশা, বাসার বাপ্পি, প্রীতি আলভী, লুৎফর রহমান শিমন্ত অসাধারণ অভিনয় করেছেন।

মানুষ রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের ভাষায় কথা নাও বলতে পারে—এই স্বাধীনতা টুকু শিহাব শাহীনের ‘দাগি’ মুভিতে বোঝাতে পেরেছেন।
সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার যখন-তখন একটা মানুষকে অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিতে পারে।
আইন-আদালত, কোর্ট-কাচারি মানুষকে মুক্তি দিলেও—সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার মানুষকে মুক্তি দেয় না।
এটাও এই মুভির একটি গুরুত্বপূর্ণ সিগনেচার।

🧠 সাইকোলজি বনাম তথাকথিত জীবন: দুই জগত, এক বাস্তবতা

মানুষের তথাকথিত জীবন আর মানুষের সাইকোলজি—এই দুটো দুই জগতের হলেও মানুষকে সাইকোলজির ক্রিয়াতেই কোনো না কোনোভাবে প্রোথিত হতে হয়।

মানুষের কালেক্টিভ ইনটেনশন গুলো ইউটিলাইজ করলেই মানুষের কমন ইনটেনশন গুলোর উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়।
অপরাধ জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শাখা—কমন ইনটেনশন এবং কালেক্টিভ ইনটেনশন।
মানুষকে যাচাই-বাছাই করার এই দুটি নিক্তি আজও কত অমলিন ঘটনার সূত্রপাত করে।

মানুষকে কোনো ফ্রেমে বাঁধা যায় না—এটা উত্তর-আধুনিক যুগের কথা।
তবুও মানুষ তার জীবন অতিবাহিত করে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার নামক তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে।
সেখানে এই তিনটি ফ্রেমের ওয়ার্কশপই বলে দেয়—একটা মানুষ কীভাবে, কী উপায়ে, কী করে, এবং কোন কারণে এই তিনটি নির্দিষ্ট এরিয়ায় এক্সিস্ট করে।

মানুষকে ইউটিলাইজ করা যায় না—এটা যেমন ঠিক, আবার মানুষের ক্রিয়াকর্ম, চিন্তাপদ্ধতি এই দু’টি মানুষকে ঘটনার প্রবাহেই ধরতে হয়।
মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। মানুষকে ইউটিলাইজ করার জন্য স্পেস দিতে হবে।
মানুষকে তার দায়বোধ প্রকাশেরও রাস্তা দিতে হবে।

যে মানুষ অপরাধ করেও একটা সময় পর নিরপরাধ মানুষ হিসেবে রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে—এই জায়গাটিকে স্বীকৃতি দিতে হবে।


About The Author

লেখক ও কলামিস্ট

Leave a reply