Select Page

মিশা সওদাগর অধ্যায়

মিশা সওদাগর অধ্যায়

মিশা সওদাগর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেতা। দেশীয় চলচ্চিত্রে সর্বাধিক ছবির রেকর্ড তাঁরই আছে। সেই ১৯৯০ থেকে আজ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে অভিনয় করে যাচ্ছেন।

জন্ম – ৪ জানুয়ারি, ১৯৬৬ সালে। ১৯৮৬ সালে এফডিসি কর্তৃক আয়োজিত চলচ্চিত্র প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রম ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ আয়োজনের মাধ্যমে তিনি ঢালিউডে এসেছেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ইন্ডাস্ট্রির অনেক ঘটনার স্বাক্ষী তিনি। নিঃসন্দেহে এটি বিরল অর্জন।

‘নতুন মুখের সন্ধানে’ আয়োজনে মিশা-র অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যই ছিল নায়ক হতে চাওয়া। ইন্টারভিউয়ের সময় মজার ঘটনা ঘটেছিল। বোর্ডের প্রশ্নকর্তাদের পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন তিনি। এতে তাঁর বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করেছিলেন উপস্থিত প্রশ্নকর্তারা।

মিশা-র মূলনাম শাহিদ হাসান। চলচ্চিত্রে নামকরণটি ছিল কিছুটা মজার। স্ত্রীর নাম ‘মিতা।’ ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। মিতার ‘মি’ আর নিজের শাহিদের ‘শা’ মিলিয়ে ‘মিশা’ আর দাদার নামের ‘জুম্মন সওদাগর’ থেকে ‘সওদাগর’ নিয়ে হয়ে যান মিশা সওদাগর। সেদিন কে জানত এ নামটাই একদিন ইতিহাস হবে! মিশা-মিতা দম্পতির দুটি ছেলে আছে।

১৯৯০ সালে তাঁর প্রথম ছবি ‘চেতনা’ মুক্তি পায়। পরিচালক ছিলেন ছটকু আহমেদ। তিনিই তাঁর গুরু। ছবিটিতে মিশার সাথে অমিত হাসান ও অন্যান্য আরো কয়েকজন ছিল নায়ক হিসেবে। মিশার বিপরীতে ছিল সাথী। ছবিতে স্টুডেন্ট ও লোকাল পলিটিক্সের গল্প দেখানো হয়েছে। আলমগীর মিশা-দের প্রিয় শিক্ষক। এটিএম শামসুজ্জামানের সাথে শত্রুতার কারণে আলমগীর খুন হলে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা প্রিয় শিক্ষকের হত্যার প্রতিশোধ এবং এলাকাকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে চায়। ছবিতে মিশা-কে ফাইট করতেও দেখা যায়। বিপ্লবী ভূমিকায় একসময় তাঁর মৃত্যু ঘটে। ছবির ‘বন্ধু এসো না সবার/এই হাত করি হাতিয়ার’ গানটি অনুপ্রেরণা দেয়ার মতো। নায়ক হয়ে দ্বিতীয় ছবি আলমগীর কুমকুম পরিচালিত ‘অমর সঙ্গী।’ তখনকার নামকরা পরিচালকরা মিশা-র লুকের মধ্যে খলনায়কের ইমেজ দেখতে পান তাই তাঁকে পরামর্শ দেন খলনায়ক হতে। এরপর তাঁদের পরামর্শে প্রথম খলনায়কের কাজ করেন ‘আশা ভালোবাসা’ ছবিতে। ছবিতে সালমান শাহ-র প্রতিদ্বন্দ্বী দেখা যায় তাঁকে। কমেডির সাথে ভিলেনের সংযোগ ঘটিয়ে অভিনয় করেছেন। এই ছবি মুক্তির পর দর্শক তাঁকে গ্রহণ করে এবং পর পর ৭টি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হন। মিশা-র কথামতে তিনি ছিলেন ইন্ডাস্ট্রির ১৩ তম খলনায়ক। তাঁর সমসাময়িক খলনায়ক ছিল ডন, সজীব তাহের, রাফাতসহ আরো কয়েকজন। হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন তাঁর আদর্শ এছাড়া অন্যান্য খলনায়কদের সাথেও তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিল।

পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্টে।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার :
বস নাম্বার ওয়ান (২০১১)
অল্প অল্প প্রেমের গল্প (২০১৪)

নাটক – ললিতা, আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে।
উপস্থাপনা – পাঁচফোড়ন

উল্লেখযোগ্য ছবি – চেতনা, অমর সঙ্গী, আশা ভালোবাসা, জীবন সংসার, সত্যের মৃত্যু নেই, প্রেম পিয়াসী, বুকের ভিতর আগুন, তুমি সুন্দর, প্রিয় তুমি, স্বামী কেন আসামী, মেয়েরাও মানুষ, চাকরানী, শেষ ঠিকানা, চালবাজ, আমার প্রতিজ্ঞা, গুন্ডা পুলিশ, দরদী সন্তান, আম্মা, এই মন তোমাকে দিলাম, বিয়ের ফুল, প্রেমের তাজমহল, ও প্রিয়া তুমি কোথায়, মানুষ মানুষের জন্য, এ জীবন তোমার আমার, আমার ঘর আমার বেহেশত, এই মন তোমাকে দিলাম, অধিকার চাই, ভালোবাসার ঘর, রঙিন উজান ভাটি, ভুলোনা আমায়, জীবন মানেই যুদ্ধ, সাবধান, মন, তোমার জন্য পাগল, বাস্তব, প্রতিবাদী মাস্টার, আব্বাস দারোয়ান, রাজধানী, আমি জেল থেকে বলছি, রুস্তম, ক্ষমতার দাপট, প্রেম কয়েদি, নিঃশ্বাস আমার তুমি, নগ্ন হামলা, তুমি আমার ভালোবাসা, দাদীমা, চাচ্চু, মা আমার স্বর্গ, খোদার পরে মা, তুমি আমার প্রেম, আমাদের ছোট সাহেব, তুমি স্বপ্ন তুমি সাধনা, মন যেখানে হৃদয় সেখানে, সবাই তো ভালোবাসা চায়, সাহেব নামে গোলাম, সে আমার মন কেড়েছে, ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না, মনের জ্বালা, টাইগার নাম্বার ওয়ান, প্রিয়া আমার প্রিয়া, তোর কারণে বেঁচে আছি, কিং খান, ভালোবাসা আজকাল, মাই নেম ইজ খান, কিস্তিমাত, অগ্নি, হিরো দ্য সুপারস্টার, অল্প অল্প প্রেমের গল্প, ছুঁয়ে দিলে মন, মেন্টাল, মুসাফির, স্বপ্নজাল, অনিল বাগচীর একদিন।

লিজেন্ড জসিমের একটা পরামর্শ মিশা সবসময় মেনে চলতেন অভিনয়ে-‘তুই যখন অভিনয়টা করবি মানুষের ভ্রু যেন নিচে না নামে, উঁচু যেন থাকে তোর অভিনয় দেখে।’ মৃত্যুরর অভিনয় নিয়ে তার স্টাডি আছে। কিভাবে মারা গেলে পারফেক্ট লাগবে এটা তিনি খেয়াল রাখতেন। তাঁর অভিনয়ের ডেডিকেশন এত ছিল যে একবার ফাঁস দিয়ে মৃত্যুর দৃশ্যে ‘আমার প্রতিজ্ঞা’ ছবিতে প্রায় মরেই গিয়েছিলেন। আটকে গিয়েছিলেন ফাঁসের সাথে। টিমের ছেলেরা বলেছিল-‘মিশা ভাই তো মারা গেছেন।’ ধরাধরি করে নামানো হয় তারপর জ্ঞান ফিরে আসে। তাঁর সমসাময়িক বা পরের অনেকেই খলনায়কের ভূমিকায় কাজ করেছে যেমন – ওমর সানী, অমিত হাসান, রুবেল, আলেকজান্ডার বো কিন্তু মিশা-র মতো জনপ্রিয়তা বা সাফল্য পায়নি। একবার এক ভক্ত এসে তাকে বলেছিল-‘আপনি যখন ছুরি ঢুকিয়ে দেন কারো পেটে আপনার চোখমুখ এমন থাকে যে মনে হয় নাড়িভুঁড়ি সব বের করে দিচ্ছেন এত মগ্ন থাকেন অভিনয়ে।’ এগুলো তাঁর অর্জন।

নিজের অভিনয়দক্ষতায় নায়কের থেকেও বেশি লাইমলাইটে আসতে পেরেছেন মিশা। এরকম একটি ছবি ‘মা আমার স্বর্গ।’ এ ছবির ফিনিশিং-এ প্রতিদ্বন্দ্বী শাকিব খানের পাশে দাঁড়ান তিনি। ববিতাকে তাঁর ভুল ভাঙিয়ে শাকিবকে পূর্ণিমার সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তখন তাঁর অভিনয় নায়ককেও ছাড়িয়ে যায়।

ডিজিটাল ছবির সময়ে মিশা-কে স্টাইলিশ ভিলেনের ভূমিকায় দেখা গেছে ‘মুসাফির, ইউটার্ন, অগ্নি, সম্রাট’ ছবিগুলোতে। ‘মুসাফির’ ছবিতে আরিফিন শুভ-র সাথে তাঁর কিছু অসাধারণ সিকোয়েন্স আছে। এছাড়া ‘ইউটার্ন’ ছবিতেও আছে।

নায়ক-খলনায়ক রসায়নে ঢালিউডে রুবেল-হুমায়ুন ফরীদি, জসিম-আহমেদ শরীফ এমন জুটির পাশাপাশি আছে শাকিব খান-মিশা সওদাগর। তাদের পর্দা রসায়ন অসাধারণ। বেশকিছু ছবিতে তাদেরকে দেখা গেছে।

অনেক ছবির সংলাপই জনপ্রিয় মিশা-র। এর মধ্যে ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ছবিতে লিজেন্ড রাজিবকে বলা তার সংলাপ ‘এই বাবা, ডায়লগ কম’ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘কিস্তিমাত’ ছবিতে ‘আমি কবিতা লেখার কবি না’ সংলাপটিও জনপ্রিয় হয়েছিল। আরো বহু সংলাপ আছে জনপ্রিয়। স্টেজ পারফরম্যান্সে মিশা-র চমৎকার একটি গান ‘রঙ্গিলা।’ ‘শেষ ঠিকানা’ ছবির এ গানে তাঁর সহশিল্পী ছিল কাঞ্চি।

মিশা পজেটিভ চরিত্রেও কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন যেগুলো মূলত চরিত্রাভিনেতা হয়ে উঠতে তাঁকে সাহায্য করেছে। যেমন – ছুঁয়ে দিলে মন, স্বপ্নজাল।
এর মধ্যে ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ ছবিতে দর্শককে হাসিয়েছেনও কমেডিতে। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস থেকে নির্মিত ‘অনীল বাগচীর একদিন’ ছবিতেও মিশা-কে দেখা গেছে। গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের।

এত ভেরিয়েশন রাখা অভিনেতা মিশা সওদাগর বেশকিছু অশ্লীল ছবিতেও অভিনয় করেছেন। এগুলো সমালোচিত হয়েছে বিভিন্ন সময়।

ব্যক্তিগতভাবে তিনি সহযোগিতাপ্রবণ মানুষ। পরিবারপ্রিয়, ধার্মিক।

মিশা সওদাগর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নব্বই দশকের সর্বশেষ প্রতিভা যিনি এখনো কাজ করে যাচ্ছেন দাপটের সাথেই। আরো বৈচিত্র্য রেখে কাজ করে যাবেন এই প্রত্যাশা থাকবে। তাঁকে বাদ রেখে দেশীয় চলচ্চিত্রের সম্পূর্ণ আলোচনা হতেই পারে না।

ছবিতে –
১. ‘নতুন মুখের সন্ধানে’-র মাধ্যমে অভিষেকের সময়
২. গুরু ছটকু আহমেদের সাথে
৩. নায়ক হিসেবে প্রথম ছবি ‘চেতনা’-র দৃশ্যে
৪. পরিবারের সাথে


মন্তব্য করুন