আগুনের পরশমণি : ক্যামেরার পিছনের কিছু গল্প
লেখক খ্যাতির পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদ জাতীয় পুরস্কারজয়ী চলচ্চিত্রকারও। প্রথম পরিচালিত সিনেমা ছিলো ‘আগুনের পরশমনি’। প্রথম সিনেমা দিয়েই বাজিমাত করেছিলেন এবং একইসাথে রেকর্ডসংখ্যক ৮টি জাতীয় পুরস্কায় জয়লাভ করেন। সিনেমা নিয়ে তো অনেক পর্যালোচনা হয়েছে। এবার চলুন ‘আগুনের পরশমনি’ সিনেমায় ক্যামেরার পিছনের কিছু গল্প করি।
এক
পরিচালিত প্রথম সিনেমা আগুনের পরশমনি হলেও এর আগে নিজের শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসের জন্যও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। উনার ভাষ্যমতে কেউ কেউ সেটা দেখে ‘সিনেমা ভাষা ব্যবহার হয় নি’ ‘২ ঘন্টার নাটক লেগেছে’ এরকম অভিযাগ করে। সিনেমার চিত্রনাট্য ব্যাপারটিকে তিনি বেশ গুরুত্ব দিতেন। উনার মতে একটা সিনেমার ভালো চিত্রনাট্য মানে পুরো কাজটা হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা! নিজের পরিচালিত ‘আগুনের পরশমনি’ সিনেমায় যেন এরকম অভিযোগ কেউ না করতে পারে সেজন্য চিত্রনাট্যের প্রথম ৬টি দৃশ্য লিখেই স্টপ মারলেন। নিউমার্কেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী ও বিদেশ থেকে বন্ধু-বান্ধব সবার কাছ থেকে ফিল্ম মেকিং এর নানা বই যোগাড় করলেন। আগে এই বিষয়ক খুটিনাটি পড়াশোনা তারপর কাজে ঝাপিয়ে পড়া।
দুই
সিনেমাটি বানাতে হলে এখন কম করে হলেও দরকার ৪০ লাখ টাকার মতন। উনার নিজের কাছে আছে বই লিখে টিখে জমানো মাত্র ২ লাখ টাকা। কিভাবে কি করা যায় সেটা ভাবতে ভাবতে এক সকালে অভিনেতা অাসাদ্দুজামান নূরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সমাজের ধনবান হিসেবে পরিচিত মানুষদের কাছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুভি হচ্ছে, ভালো একটা কাজ, মানুষজন তো অবশ্যই এগিয়ে আসবে। এই ছিলো উনার ধারণা। কিন্তু বিফল মনেই সারাদিন ঘুরে ২জনকে ফেরত আসতে হলো। এমনকি হুমায়ূন আহমেদ কয়েকজন প্রকাশকের কাছেও গিয়েছিলেন এই ব্যাপারে সাহায্য পাওয়ার জন্য। সেখানেও নিরাশ হতে হলো।
তিন
একরাতে হতাশ হয়ে ঠিকই করলেন যে সিনেমা বানানোর পাগলামীটা এবার বন্ধ করবেন। পরেরদিন সকালে আবার সব ভুলে গিয়ে রওনা হলেন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার সাথে দেখা করতে। বলে রাখা ভালো সেই সময় সরকারী অনুদানে সিনেমা প্রথাটা বন্ধ ছিলো। হুমায়ূন আহমেদের লক্ষ ছিলো যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বানানো একটা মুভিতে যে সরকারের সাহায্য করা উচিত সেটা গিয়ে বুঝানো। যথারীতি তথ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করলেন এবং উনাকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন। তথ্যমন্ত্রী আগুনের পরশমনি মূল বইয়ের একটা কপি পাঠিয়ে দিতে বলে উনাকে বিদায় দিলেন। তারপর কয়েকদিন পরের গল্প। সকালে পেপার হাতে হুমায়ূন আহমেদ আবিষ্কার করলেন সিনেমা নির্মাণে সরকার ২৫ লাখ টাকা করে অনুদান প্রথা আবার চালু করেছে এবং এবারের নির্বাচিত ৩টি সিনেমার মাঝে প্রথমেই ‘আগুনের পরশমনি’ এর নাম!
চার
সিনেমাটি যারা যারা ছিলেন তাদের কিছু গল্প করা যাক। সিনেমাটি চরিত্র বেশ অল্পই ছিলো। নির্দিষ্ট কিছু চরিত্রের মাঝেই পুরো মুভির কাহিনী ঘুরপাক খেয়েছে। তবে রাত্রি চরিত্রে বিপাশা হায়াত, বদি চরিত্রে আসাদ্দুজামান নূর(এখানে একটা মজার ব্যাপার। বদি চরিত্রে দেশের নামডাকা প্রচ্ছদ শিল্পী ধ্রুব এষ হুমায়ূন আহমেদের পছন্দে ছিলেন এবং তিনি ধ্রুব এষকে এই চরিত্রে অভিনয় করানোর জন্য অনেক চেষ্টাও করেছিলেন। বাট অভিনয়ে ধ্রুব এষ একদমই রাজি ছিলেন না), বদির মা এর চরিত্রে দিলারা জামান, রাত্রির ছোটবোন অপলার চরিত্রে শীলা আহমেদ, কাজের মেয়ে বিন্তির চরিত্রে পুতুল এর কাজ ও অভিনয় দেখে দর্শকদের সাথে সাথে হুমায়ূন আহমেদ নিজেও বেশ তৃপ্তি ও খুশিতে হয়েছিলেন। তবে রাত্রির বাবা চরিত্রে আবুল হায়াত ও মা এর চরিত্রে ডলি জহুর এর কাজ উনার মনমতন ছিলো না। উনার মনে হয়েছিলো শক্তিমান এই ২ অভিনেতাকে তিনি ঠিকমতন ব্যবহার করতে পারেন নি। তবে একটা নাম হুমায়ূন আহমেদ আলাদা করে বলেছেন। নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ওয়ালিউল ইসলাম ভুইয়া। অত্যাচারী সেই পাকিস্তানী কর্ণেলের চরিত্রে ছিলেন। অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। উনার মতে অন্য সবার সাথে এই চরিত্রটির জন্য তাকে জাতীয় পুরস্কারটা না দেয়া কিছুটা অন্যায়ই হয়ে গেছে।
পাঁচ
ক্যামেরার পিছনের কাজে অনেকে ছিলেন। কিন্তু সবার মাঝে কয়েকটা নাম একটু আলাদা। উনারা নিজ তাগিদে দেখা করে আগুনের পরশমনি নামক সিনেমার কাজের সাথে থাকতে চেয়েছিলেন। যেমন নামকড়া সম্পাদক আতিকুর রহমান মল্লিক হুমায়ূন আহমেদের বাসায় এসে দেখা করে সম্পাদকের দায়িত্বটা নেন। বরেন্য সুরকার সত্য সাহার ফোন করে কথা বলে সিনেমাটির সঙ্গীতের কাজ নেন। ভালো একটা কাজের সাথে সবাই নিজের আগ্রহ থেকেই থাকতে চাইছিলো।
ছয়
এবার অংশটি আমার কাছে বরাবরই একটু অবাক লাগে। মোজাম্মেল হোসেনকে নিয়ে সব ঠিকঠাক করে শুটিং শুরুর কয়েকদিন আগে হুমায়ূন আহমেদ চলে যান ভারতের আজমীর শরীফে! উদ্দেশ্য চিত্রনাট্য দেখিয়ে সেখানে খাজা বাবার দোয়া নেয়া। এখানে বেশ ভালো অবাক করার মতন ঘটনা ঘটে। মাজারের হিন্দীভাষী খাদেম চিত্রনাট্য নিয়ে ভিতরে যায়। কিছুক্ষণ পরে এসে জানায় চিত্রনাট্যে সমস্যা আছে! বইয়ের সাথে কিছু অংশ মিল নেই! হুমায়ূন আহমেদ এবং মোজাম্মেল হোসেন ২জনই বেশ ভালোরকমের অবাক হয়ে গেলেন! এইটা এই খাদেম জানলো কিভাবে! কথায় কথায় পরে জানা গেলো খাদেম স্ত্রী ঢাকার মেয়ে। নাম সাজিয়া। বিটিভিতে প্রচারিত ‘সকাল সন্ধ্যা’ নামক ধারাবাহিকে অভিনয়ও করেছিলো। সে হুমায়ূন আহমেদের প্রায় সব বই পড়ে ফেলেছে। চিত্রনাট্যটা পড়ে সেই এসব জানিয়েছে। এতদূরে এসে এরকম একটা কাকতালীয় ঘটনার মাঝে পড়ে উনারা ২জনও অবাক না হয়ে পারলেন না।
সাত
নতুন পরিচালকদের নতুন মুভির কাজ শুরুর আগে এফডিসির পরিচালক সমিতির কাছে ভাইবা টাইপ একটা পরীক্ষা দিতে হয়। পরিচালক হিসেবে যোগ্য নাকি সেটা পরীক্ষার। উনারা পাশ মার্ক দিলেই সিনেমার কাজে পরিচালক নামতে পারবেন। হুমায়ূন আহমেদকেও একদিন সেই পরীক্ষা দিতে পরিচালক সমিতির অফিসে হাজির হলেন। তখন সমিতির সভাপতি চাষী নজরুল ইসলামসহ ২০জনের মতন পরীক্ষক/পরিচালক ভাইবা নেয়ার জন্য বসে আছেন। একের পর এক নানা প্রশ্নবানে পরীক্ষাও হয়ে গেলো কোনরকম। নম্বর মিলাতে গিয়ে দেখা গেলো ১০০ এর মাঝে কেউ ৯০ দিয়েছে আবার কেউ ০ দিয়ে বসে আছে। কম নম্বরের কারণে উনাকে সরাসরি সমিতির সদস্যপদ দেয়া হলো না। সহযোগী সদস্যপদ দেয়া হয়েছিলো।
আট
শুটিং শুরু। মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত অস্ত্র, গেনেড, গোলাবারুদ লাগবে। হুমায়ূন আহমেদ চাইছিলেন নকল ব্যবহার না করে সিনেমাতে আসলগুলোই ব্যবহার করবেন। সে অনুযায়ী পুলিশের সাহায্য চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর দরখাস্ত আবেদন করে জমা দিলেন। বাকিটা ইতিহাস। সে দরখাস্তের খবর জানতে ২৫ বছর পর হুমায়ূন আহমেদ একার খোজ নিয়েছিলেন। তখনও কোন আপডেট পাওয়া যায় নি। পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তারপর উনি গেলেন সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ লেফট্যানেন্ট জেনারেল নূর উদ্দিন খানের কাছে। পুরো ব্যাপারটি নিয়ে পরবর্তীতে খুব আন্তরিক এবং বিনয়ের সাথে সবধরণের সহযোগীতা এই সেনাবাহিনী করে দিয়েছিলো উনাকে। এখানে একটা মজার ঘটনা আছে। সেনাবাহিনী নিয়ে প্রথমদিন যেদিন এফডিসিতে সিনেমাটির কাজ করবেন সেদিন সকাল ১১টায় অস্ত্র সস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর কনভয় এফিডিসির গেটে হাজির শুটিং এ অংশগ্রহন করার জন্য। কনভয় দেখার সাথে সাথে ভয়ে হোক কিংবা অন্য কোন কারণে হোক এফডিসির সব গেট বন্ধ। তারপর নানারকম জলঘোলাঘুলি আর দরখাস্তের ক্যাচাল শেষে সেনাবাহিনীকে দিয়ে এফডিসিতে শুটিং শুরু করা গেলো।
নয়
এবার আমি খাওয়া-দাওয়া সংক্রান্ত আলাপে। অবশ্যই এই মুভি সংক্রান্ত। হুমায়ূন আহমেদ নিজে যেহেতু বাড়াবাড়ি রকমের ভোজনরসিক মানুষ তাই স্বাভাবিকভাবে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কিছু অংশ বরাবরই বরাদ্দ থাকে। একটা ব্যাপারে সবসময়ই আলোচনা হয়ে আসছে। সেটা হলো এফডিসিতে দুপুরে কিংবা রাতে যে খাবার দেয়া হয় সেটা দেশের অন্যতম সুস্বাদু এবং সস্তা খাবার। হুমায়ূন আহমেদ নিজেও এই কথার সাথে বেশ কড়াভাবে সহমত পোষণ করে গেছেন। আগুনের পরশমনির শুটিং এর সময় দুপুরের খাবারের জন্য উনাদের পারহেড ৩০ টাকা দিতে হতো। এই ৩০টাকা পাওয়া যেতো : ভাত, তিন রকমের সবজি, ৪পদের ভর্তা, শুটকি, ছোটমাছ, বড় মাছ, চিংড়ি ভুনা (সবার জন্য না), খাসী ভুনা (সবার জন্য না), মুরগী, গরুর গোশত, ২পদের ডাল। ড্যাম!! মাত্র ৩০ টাকায় কেমনে সম্ভব!! তারউপর খাবারও নাকি সেই লেভেলের সুস্বাদু। একদিন খাইতে হবে এফডিসির খাবার। কারো পক্ষে সম্ভব হলে দাওয়া দিয়েন -_-
দশ
পৃথিবীর প্রায় অনেক ব্যাপার নিয়ে অনেকদিন যাবৎ প্রচলিত কিছু মিথের খোজ দেখা যায়। এফডিসিতেও অনেকদিন যাবৎ চলে আসা এরকম কিছু মিথ ছিলো। সেগুলো অবশ্যই সিনেমার হিট তকমা সংক্রান্ত। আগুনের পরশমনির শুটিং এর সময় এরকম নানা অদ্ভূত মিথ আবিষ্কার করেন পরিচালক নিজে। যেমন: সেটে কারো চশমা ভাঙা মানে সিনেমা সুপার ডুপার হিট (চশমা ভেঙেছিলো মোজ্জামেল হোসেনের। সাথে সাথে মিষ্টি এনে উদযাপন করাও হয়েছিলো), ছবিতে সাপ থাকলে সিনেমা সুপার ডুপার হিট (সাপ দেখা যায় নাই), ছবিতে শুটিং এর সেট ভেঙে গেলেও নাকি সিনেমা বাম্পার হিট (একটা দূর্ঘটনায় সেটের এক বড় অংশ ভেঙে গেলো। যথারীতি এবারও মিষ্টি এনে সবাইকে খাওয়ানো হলো।)
শেষ করছি এই সিনেমা নির্মাণ সংক্রান্ত বিশেষ প্রিয় একটু অংশ দিয়ে। সিনেমাটি নির্মান শেষ হয়ে গেছে। হয়ে গেছে এডিটিং, ডাবিং, শব্দ সংযোজনের কাজ। সেন্সরে জমা দেয়া হবে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা বিষয় হুমায়ূন আহমেদকে বেশ পীড়া দিচ্ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা অথচ কোথাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেই। ব্যাপারটা মানতে পারছিলেন না। কিন্তু তখনকার সময়টাই এমন যে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাটাও ছিলো বিপদজনক একটা কাজ। আর সেখানে সিনেমাতে বঙ্গবন্ধু জুড়ে দেয়া হলে সিনেমাটি সেন্সরেই আটকে যেতো। এদিকে সিনেমার শুটিংও শেষ। সবদিক ভেবে একটা বুদ্ধি বের করলেন। সিনেমার শুরুটা ছিলো মতিন সাহেব বারান্দায় বসে বসে রেডিওতে বিবিসি শুনছেন। সেই দৃশ্যে বিবিসি এর বদলে একাত্তরে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর ‘বজ্রকন্ঠ’ এর ৭ মার্চের অংশ জুড়ে দেয়া হয়। সেন্সর ঠিকই ধরে ফেলে। সেখান থেকে তাদেরকে যুক্তির খেলায় হারিয়ে দিয়ে শেষমেষ বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ ঠিকই মুক্তি পায় ‘আগুনের পরশমনি’।
এরকমই নানা ঘটনা আর ক্যামেরার পিছনের নানা গল্প নিয়ে তৈরী আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত অন্যতম সেরা সিনেমা ‘আগুনের পরশমনি’। নিজ লেখা ‘ছবি বানানোর গল্প’ বইতে এই সিনেমা নিয়ে নানা স্মৃতিচারণ করেছিলেন।