Select Page

আজম খানের কিছু গানের পেছনের গল্প

আজম খানের কিছু গানের পেছনের গল্প

বাংলা গানের ইতিহাসের আজম খান কে বা কী, তা নিয়ে আলাদা করে কোনো বিশেষণ দেওয়ার দরকার নেই। তার নামের ভেতরেই সব ধারণ করে। সম্প্রতি ফেসবুকে লুৎফুল কবির আজম খানের কিছু গানের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। সেই পোস্টের কিছু অংশ তার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বিএমডিবি পাঠকদের জন্য সংরক্ষণ করা হলো—

আলাল-দুলাল

কবি জসীম উদ্দীনের বাড়ির বাগানের দেবদারু গাছতলায় প্রতিদিনই তারা সব বন্ধুরা আড্ডা দিতেন। গিটার নিয়ে টুংটাং করতেন। তার দুই বন্ধু শাহজাহান আর জাহাঙ্গীর আপন দুইভাই। তাদের ‘আলাল-দুলাল’ বলে ক্ষেপাতো আরেক বন্ধু আলমগীর। শাহজাহান হলো আলাল আর জাহাঙ্গীর হলো দুলাল। তারপরই ‘আলাল-দুলাল’ গানের সৃষ্টি। পপসম্রাট এ গান গাইলে লজ্জায় শাহজাহান আর জাহাঙ্গীর মাথা নিচু করে থাকতেন।

প্রথম প্রথম গাইতেন, ‘আলাল-দুলাল, তাদের বাবা হাজি চান, প্যাডেল মেরে ওই পুলে পৌঁছে বাড়ি।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে তখন একটা পুল ছিল। তাদের আড্ডা থেকে পুলটা দেখা যেত। তার মেজ ভাই সংগীত পরিচালক আলম খান গানটি শুনে বললেন, ‘পুলের জায়গায় চানখাঁর পুল শব্দ দুইটা দে, শুনতে ভালো লাগবে।’ তাই করলেন তিনি। একদিন ভাবলেন, গান যখন গাইছেন এটা নয় কেন? বিটিভিতে ১৯৭৫-৭৬ সালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের জন্য গানটা রেকর্ড করলেন কাকরাইলের ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিওতে। সে গানও রাতারাতি হিট।

মজার বিষয় হলো, পুরান ঢাকার চানখাঁর পুলে সত্যি সত্যি ‘হাজি চান’ নামের এক মুরব্বি ছিলেন। গান শুনে তিনি বেজায় খুশি। ভাবলেন গানটি বুঝি তাকে নিয়েই লেখা! তিনি আজম খানের এক বন্ধুকে পেয়ে বললেন, ‘আজম খান তো গানটা জব্বর গাইছে। ওরে লইয়া একদিন মহল্লায় আহ।’ তারপর বন্ধুরা মিলে একদিন তার বাড়িতে যান, গান করেন।

ওরে সালেকা ওরে মালেকা

এটি পাকিস্তান আমলের গান। জসীম উদ্দীন রোডে ঢুকতেই চিটাগাং হোটেলের পাশে ছিল টাওয়ার হোটেল। সেটা একতলা থেকে দোতলা হয়েছে। সেখানে একটা পানির ট্যাংক ছিল। আজম খানের বন্ধু নীলু গিটার বাজাতেন। ছোট বাঁশের স্টিক দিয়ে পানির ট্যাংকটাকে তিনি ড্রাম বানিয়ে বাজাতে লাগলেন। সেই রিদমের তালে তালে তারা পাঁচ-ছয় বন্ধু মজা করছেন। নীলুর বিটের তালে কোনো ছাড়াই পপসম্রাটের মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এলো, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে’। এ গান নিয়ে পরে দেড় ঘণ্টা মজা করলেন তারা। এরপর ১৯৭৩ সালে তারা যখন পপ গান করেন, তখন হঠাৎ মাথায় এলো এ গানটাও তো করা যা! তারপর গানটা নতুন করে গাইলেন আজম খান। সেটাও সুপারহিট।

অভিমানী তুমি কোথায়

১৯৭৩ সালে এটি লেখেন আজম খান। তিনি খাতা-কলমে কোনোদিন গান লিখতেন না। হঠাৎ মাথায় এসে পড়লে মুখে মুখেই বানিয়ে ফেলতেন। তারা আড্ডা দিতেন চিটাগাং হোটেলের সামনে। সঙ্গে একটা গিটার থাকত। যেখানে গান করতেন সেখানে এক ভারতীয় পাগল ছিল। সে সুরে সুরে একটা গান গাইত আর নাচত, ‘ইতলের বিনা, বিনারে ভাগি, বিনা চালা গ্যায়া।’ ঠান্ডা পাগল ছিল। শুনে খুব মজা লাগত। এই গান থেকে তিনি পেয়ে গেলেন সুর। হঠাৎ মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘অভিমানী, তুমি কোথায় হারিয়ে গেছো …’।

পাপড়ি কেন বোঝে না

পাপড়ি বাস্তব একটি চরিত্র। ১৯৭৫ সালে ঢাকায় কমলাপুরের ১২ জসীম উদ্দীন রোডের একটি বাড়ির দোতলায় পাপড়ি তার পরিবারের সঙ্গে ভাড়া থাকতেন। সেটা ছিল আজম খানের বড় ভাইয়ের বাড়ি। তখন তার উঠতি বয়স। মহল্লার ছেলেরা তাকে দেখলেই নানাভাবে বিরক্ত করত। স্থানীয় হিসেবে আজম খানের দাপট ছিল। পাপড়ির সঙ্গে বখাটেদের উত্ত্যক্ত করার কথা শুনে তিনি রাগান্বিত হলেন। একদিন তাদের ডেকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘আর কোনোদিন ওর দিকে চোখ তুলে তাকাবি না!’ এরপর থেকে পাপড়ির সবকিছু খেয়াল রাখা যেন আজম খানের দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত হলো। একদিন পাপড়িরা বাসা বদল করে চলে যায় অন্যত্র। তারপরই ‘সারা রাত জেগে কত কথা ভাবি আমি, পাপড়ি কেন বোঝে না তাই ঘুম আসে না’ গানটির সৃষ্টি। সেটা ১৯৭৫ সালের কথা। এটা বিটিভিতে প্রথম ১৯৭৭ সালে পরিবেশন করেন আজম খান। তারপরই গানটি সুপারহিট হয়ে যায়। ১৯৮৪-৮৫ সালে চট্টগ্রামে একটা অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ একজন এসে তাকে জানালেন, তিনি পাপড়ির স্বামী। আজম খানকে ওই ভদ্রলোক জোর করে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। পাপড়ির সঙ্গে তার আবার দেখা হলো ১০ বছর পর। আজম খানের ‘বাধা দিও না’ গানটিও পাপড়িকে নিয়েই লেখা।

হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘোরে

গানটির পেছনে ঘটনাটি ছিল এমন যে স্বাধীনতার পর থেকে সেখানে আস্তানা গেড়েছিলেন নূরা পাগলা নামের এক সাধু। সেখানে সেই সাধু দিন-রাত বিভিন্ন নেশায় মগ্ন থাকতো কিন্তু ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে মাজারের সুখ্যাতি ক্রমেই ছড়িয়ে পড়লে এই জন্য যে সেখানে নূরা পাগলা নামক সেই ফকিরের বসার আসনটি অর্থাৎ পাটের তৈরি পুরাতন একটি ছালা, ভক্তদের মাঝে বিক্রি হয় সে সময়ে ১০০ টাকা মূল্যে যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক একটা জিনিস।

পপ সম্রাট শিল্পী আজম খানের চোখে সেটা পড়ায় তিনি তাঁর গানে সেই ঘটনা থেকে নেয়া এই লাইনটুকু যোগ করে দিলেন।


Leave a reply