আনোয়ারা: এক কিংবদন্তি
আনোয়ারা। আমাদের চলচ্চিত্রের গর্বিত একজন অভিনেত্রী। তিনি সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের চলচ্চিত্রকে। শুরুর দিকে নায়িকা তারপর মায়ের চরিত্রে চিরস্থায়ী আসন গড়েছেন।
খালেদা আক্তার কল্পনা আসার আগ পর্যন্ত একটা সময় চলচ্চিত্রে মায়ের চরিত্রে নির্ভরশীল অভিনেত্রীই ছিলেন আনোয়ারা। তাঁকে ছাড়া ভাবার সুযোগ ততটা ছিল না।
জন্ম কুমিল্লায়। নৃত্যশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে আসেন ষাটের দশকের সময়। বেশকিছু উর্দু ছবিতে নায়িকা ছিলেন।
‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবিতে আলেয়ার চরিত্রে তিনি দর্শকমন জয় করেছিলেন। ‘দেবদাস’ ছবির চন্দ্রমুখী দিয়ে ক্যারেক্টার আর্টিস্টের জায়গায় তাক লাগিয়ে দেন তখনকার চলচ্চিত্র সমালোচক, দর্শকদের। দর্শক তাঁকে এরপর আলেয়া বলত বিশেষ করে কোথাও বেড়াতে বা শুটিংয়ে গেলে তাঁকে এ নামেই ডাকত এতটা গ্রহণ করেছিল দর্শক।
আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবিতে ময়নাবু চরিত্রের সাথে মিশে যাওয়ার অভিনব সক্ষমতা দেখিয়েছেন। চাষী নজরুল ইসলামের ‘শুভদা’ ছবিতে প্রধান চরিত্রে হৃদয়ে দাগ কাটার মতো অভিনয় করেছেন। ‘অংশীদার’ ছবিতে নায়ক রহমানের বিপরীতে বিখ্যাত সেই গান ‘তোমারই পরশে জীবন আমার ওগো ধন্য হলো’ তাঁর লিপে ছিল। ‘ভাত দে’ ছবিতে ভাতের ক্ষুধার জ্বালায় স্বামী আনোয়ার হোসেন ও মেয়ে আঁখি আলমগীরকে ছেড়ে অন্য একজনের ঘরে চলে যায় আনোয়ারা। মর্মান্তিক এক বাস্তব চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন।
‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ ছবির ‘বাবা বলে গেল আর কোনোদিন গান করো না’ গানে শিশুশিল্পীর সঙ্গে তিনি অসাধারণ ছিলেন। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবিতে শাওনের মায়ের চরিত্রেও অনবদ্য। শাওন বিষ খাওয়ার পর শেষ দৃশ্যে তাকে নৌকায় করে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে নিতে কিন্তু নৌকাতেই মারা যায় শাওন, তখন জাহিদ হাসান ও মাহফুজকে আনোয়ারা বলেন-‘নাও ঘোরা।’
অমর নায়ক সালমান শাহ-র দাদীর চরিত্রে ‘অন্তরে অন্তরে’ ছবিতে ‘ও দাদী দাদী আমি তোমার দিবানা’ গানটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়। এছাড়া প্রধান চরিত্রে ‘দাদীমা’ নামে আরেকটি ব্যবসাসফল ছবিও আছে। ‘প্রেম পিয়াসী’ ছবিতে আনোয়ারা খুবই টাচি চরিত্রে ছিলেন। অমর নায়ক সালমান শাহর সাথে শাবনূরের প্রেম তিনি মানতে পারেন না ধর্মীয় কারণে। শাবনূরের বিয়ের দিন আনোয়ারা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছুটে যান কিন্তু দেখেন শাবনূরের বিয়ে হয়ে গেছে ততক্ষণে। হতাশ হয়ে যখন ফিরে আসেন বিস্মিত হয়ে দেখেন সালমান গলায় দড়ি দেওয়া অবস্থায় সিলিংফ্যানে ঝুলছে। মা আনোয়ারার বুকফাটা আর্তনাদ তখন চোখ ভিজিয়ে দেয়।
মায়ের চরিত্রে আনোয়ারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নিজের সময়ে ইন্ডাস্ট্রির ব্যস্ত নায়কদের মা হয়েছেন তিনি। ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান শীর্ষ নায়ক শাকিব খানের মায়ের চরিত্রেও ছিলেন। ‘বর্তমান’ ছবিতে মান্নার লিপে ‘মায়ের একধার দুধের দাম’ গান কিংবা ‘রঙন সমাধি’ ছবিতে শাকিব খানের লিপে ‘মাগো মা ওগো মা, আমারে বানাইলি তুই দিওয়ানা’ গানটিও সুন্দর ছিল।’
আনোয়ারা মায়ের চরিত্রে তাঁর সময়র প্রায় সব নায়কের ছবিতে ছিলেন সর্বশেষ ‘পোড়ামন ২’ ছবিতে পূজা চেরির দাদীর ভূমিকায় ছিলেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ার ছিল তাঁর।
আনোয়ারার মেয়ে রোমানা ইসলাম মুক্তিও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছে। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবি ‘চাঁদের আলো’।
উল্লেখযোগ্য ছবি: আজান, জানাজানি, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, দেবদাস, নয়নমনি, আশার আলো, অংশীদার, গোলাপি এখন ট্রেনে, জন্ম থেকে জ্বলছি, সুন্দরী, সখিনার যুদ্ধ, ভাত দে, শুভদা, মরণের পরে, রাধাকৃষ্ণ, নতুন পৃথিবী, চাষীর মেয়ে, কসাই, বাঁশরী, মরণের পরে, সুজন সখি, দাঙ্গা, বিরহ ব্যথা, প্রেম পিয়াসী, শ্রাবণ মেঘের দিন ও দাদীমা।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ৮ বার: গোলাপী এখন ট্রেনে – ১৯৭৮, সুন্দরী – ১৯৭৯, সখিনার যুদ্ধ – ১৯৮৪, শুভদা – ১৯৮৬, মরণের পরে – ১৯৯০, রাধাকৃষ্ণ – ১৯৯২, বাংলার বধূ – ১৯৯৩ ও অন্তরে অন্তরে – ১৯৯৪।
আনোয়ারার মতো অভিনেত্রী বর্তমানে না থাকার বাস্তবতা আমরা ভালোভাবেই বুঝি। তিনি সুন্থ থাকুন, ভালো থাকুন।