Select Page

আন্ডার কনস্ট্রাকশন একটি হার্ডকোর নারীবাদী ছবি

আন্ডার কনস্ট্রাকশন একটি হার্ডকোর নারীবাদী ছবি

12541003_1124447694262051_8907345869727422285_n

নন্দিনী কে ? কি তার পরিচয় ?

রবীন্দ্রনাথ তার রক্তকরবীতে যে প্রেমময়ী কাল্পনিক নারীর বর্ননা দিয়েছেন  বাস্তবের নারীর মাঝে তার অস্তিত্ব কতটুকু বিদ্যমান?

নারীর স্বার্থক স্বরূপ কি কেবলই নন্দিনীর মাঝে; সুন্দরী, উর্বরা, যৌবনবতী?

ঘর সংসার, প্রেম-ভালোবাসা, স্বামী-সন্তান আর আত্মত্যাগ; পুরুষের বর্ননায়, পুরুষের কল্পনার পারফেক্ট নারীতো এমনই।

রুবাঈয়াত তার প্রথম ছবি ‘’ মেহেরজান ‘’ এ যুদ্ধকালীন মানবতাকে নিয়ে এসেছিলেন প্রেমময়ী এক তরুনীর প্রেমের গল্পের মধ্যে। চিরশত্রু পাকিস্তানীদের জন্য আবার মানবতা! এতো ভয়ঙ্কর সাহসের কথা!!

ফলে রুবাঈয়াতকে তার সাহসের চরম মূল্য দিতে হয়েছিলো সেসময়। সাধারন দর্শক যখন ছবিটি করতালিসহকারে উপভোগ করছে, একশ্রেনীর বুদ্ধিব্যাবসায়ীর আপত্তির মুখে ছবিটি প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। অনেক মানুষ ছবিটি না দেখেই এর প্রতি তীব্র ঘৃনা প্রদর্শন করে এবং রুবাঈয়াতকে হতে হয় চরমভাবে সমালোচনার স্বীকার।

 

একজন চলচ্চিত্রপ্রেমী হিসেবে এ ঘটনা ছিলো আমার জন্য হতাশার, কেননা ছবিটি আমি প্রথম দিনেই দেখেছিলাম এবং এর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলাম।

যাইহোক, আজকের লেখা মেহেরজানকে নিয়ে নয় বরং মেহেরজান এর নির্মাতা রুবাঈয়াত-এর নতুন ছবি আন্ডার কন্সট্রাকশনকে নিয়ে।

আমার মতে আন্ডার কনস্ট্রাকশন মেহেরজানের চেয়ে কয়েকগুন বেশী সাহসী কাজ।

এ ছবিতে রুবাঈয়াত মানবতা আনতে যাননি বরং ‘নারীবাদ’ ছবিতে মানবতার চেয়েও বড় করে এসেছে। এজন্যই ছবিটিকে আমি একটি হার্ডকোর নারীবাদী ছবি বলে বিবেচিত করছি।

আন্ডার কন্সট্রাকশন রয়া নামে এক আধুনিক বাংলাদেশী নারীর গল্প। রয়া একজন অভিনেত্রী। থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী করেই যার অভিনয় জীবন কেটেছে। রয়া এবং তাকে কেন্দ্র করে অন্য যেসব নারী আছে; যেমন তার মা, কাজের মেয়ে, বান্ধবী; আন্ডার কন্সট্রাকশন এইসব নারীর মাঝেই বাংঙ্গালী নারীর পরিচয় খুঁজে বেরিয়েছে।

এদের মধ্যে রয়াকে সবচেয়ে আধুনিক এবং নারীবাদী ধরতে পারি। অভিনেত্রী হওয়ায় তার রক্ষণশীল মা তার জন্য লজ্জিত বোধ করে। সমাজের চোখে অভিনেত্রীরা বেশ্যা হিসেবে নিন্দিত। তার স্বামী তার কাছ থেকে বাচ্চা আশা করে, তার খ্যাতি না। বরং তার অভিনয় ক্ষুধা তার স্বামীর চোখে নিছকই ছেলেমানুষী। তার আধুনিক শিক্ষিতা বান্ধবীর মতেও নারীর সার্থকতা মা হওয়ার মাঝে।

এদিকে রয়া মনের দিক থেকে স্বাধীনচেতা হলেও অর্থনৈতিকভাবে সে তার স্বামীর উপর নির্ভরশীল। সে হিসেবে বরং তার রক্ষনশীল মা কিংবা তার অশিক্ষিত কাজের মেয়েটি তার চেয়েও অনেক বেশী স্বাধীনচেতা এবং আত্মনির্ভরশীল।

রুবাঈয়াত এর মধ্য দিয়েই দেখিয়েছেন নারীর স্বাধীনতা এখনও আন্ডার কন্সট্রাকশন পর্যায়ে আছে। পরবর্তীতে রয়ার নন্দিনীকে আবিষ্কার এবং সবশেষে একটি ‘’হার্ড টু ডাইজেস্ট’’ সমাপ্তি এও ইঙ্গিত করে যে নারী অচিরেই  আন্ডার কন্সট্রাকশন পর্যায় থেকে এগিয়ে যাবে।

আন্ডার কন্সট্রাকশন সম্পূর্ন নারীবাদী সিনেমা হলেও ছোট ছোট, সরল এবং স্পষ্ট মেটাফোরের মাধ্যমে নির্মাতা আরো দেখিয়েছেন শুধুমাত্র নারী না বরং আমাদের গোটা সমাজ, রাজনীতি এখনো আন্ডার কন্সট্রাকশনেই আছে। আর এসব কিছু মিলিয়েই আন্ডার কনস্ট্রাকশন হয়ে উঠেছে দার্শনিক দৃষ্টিকোন থেকে একটি সঠিক সিনেমা।

তবে এ ছবির সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে এর নির্মানশৈলী। মেহেরজানের সেই অপরিপক্ক নির্মাতা এই কয় বছরেই হয়ে উঠেছেন অনেক বেশী ম্যাচিউর বা পরিপক্ক।

টেকনোলজির দিক বিবেচনায় এতোটা ম্যাচিউর কাজ বাংলাদেশে খুব কম হয়েছে। সিনেমাটোগ্রাফী এবং এডিটিং ছিলো অলমোষ্ট পিচ পারফেক্ট। কস্টিউম এবং শিল্প নির্দেশনা চোখ ও মন দুটোই জুড়ায়। সবমিলিয়ে সরল কিন্তু এফেক্টিভ; একেবারেই বাহুল্যবর্জিত কাজ যাকে বলে। ডায়লগ একেবারেই পারফেক্ট। আর অভিনয়ের কথা বলতে গেলে কয়েক পৃষ্ঠা লেগে যাবে। রয়া চরিত্রে শাহানা গোস্বামী যে মাপের পারফর্ম্যান্স দেখিয়েছেন তা বাংলা চলচ্চিত্র তো বটেই; গোটা বিশ্ব চলচ্চিত্রেই খুব কম দেখা যায়। এতোটা পারফেকশন অভিনয়ে নিয়ে আসা বুঝি কেবলমাত্র শাহানার মতো অভিনেত্রীদের দ্বারাই সম্ভব। শাহানার প্রত্যেকটি ডায়লগ একেকটি জীবন্ত শিল্প হয়ে উঠে। বিশেষ করে নন্দিনী চরিত্রে অভিনয়ের সময় সে গায়ের রোম পর্যন্ত জাগিয়ে দিয়ে যায়। বাকিরা সবাই ভালো করেছেন। রাহুল বোসকে অবশ্য ছোট্ট চরিত্রে অনেকটা অতিথি শিল্পী হিসেবে দেখা গেছে। যা তার ভক্তদের জন্য হতাশাজনক হতে পারে।

সবমিলিয়ে, আন্ডার কন্সট্রাকশন হয়তো অল্প কিছু দর্শকদের জন্য তৈরী যারা সিনেমা কেবলমাত্র বিনোদনের জন্য দেখেনা বরং সিনেমা থেকে শিল্পের ক্ষুধা মিটায়। তার চেয়েও বড় কথা এ ধরনের ছবি দিয়ে নির্মাতা তার নিজের ভিতরকার ক্ষুধা মেটাতে চেষ্টা করে। হয়তো সাধারন চোখে ‘’শিল্পের ক্ষুধা’’ বিষয়টি হাস্যকর। ফলে ছবির শেষে রয়ার স্বার্থপরতা বা অমানবিকতাই চোখে পড়ে, তার ভিতরকার শিল্পের ক্ষুধা না। তারপরও সবশেষে আন্ডার কন্সট্রাকশন একটি পরিপূর্ন ছবি হয়ে উঠে। যে ছবি ভালো লাগুক আর মন্দ লাগুক; বাংলা চলচ্চিত্রে একটি সংযোজন হয়েই থাকবে।

রমিজ, ৩০-০১-১৬


মন্তব্য করুন