Select Page

আমরা সবাই আবদুর রহমান

আমরা সবাই আবদুর রহমান

photo0871

আবদুর রহমান নামটা শুনলে আপনি চমকে উঠতে পারেন। কিন্তু আপনি নিজেই তো আবদুর রহমান। সেই কথাটা আমরা শুনছি ‘জ্বী হুজুর’ চলচ্চিত্রেরর প্রধান নারী চরিত্র বান্টির মুখে। তার কথার মধ্যে ঠাট্টার  সুর ছিলো বেশ। কিন্তু মানুষে মানুষে সমচেতনা জোরদারে কথাটা নিশ্চয় জোশ। জ্বী হুজুর পরিচালনা করেছেন ২০১০ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারে বেশ কটি বিভাগে পুরষ্কার জেতা ভালোবাসলে ঘর বাধা যায় না-র পরিচালক জাকির হোসেন রাজু। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন মাদ্রাসার ছাত্র নিয়ে একটা চলচ্চিত্র বানাবেন। সেটা গতানুগতিক মোল্লা ধারনার বাইরে। সেই দিক থেকে এই চলচ্চিত্র কৌতুহল তৈরির জন্য যথেষ্ট। এই চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন জাকির হোসেন রাজু নিজে।

বাংলা চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক ধারায় ধর্মকে শুভ শক্তি হিসেবেই বরাবর দেখা গেছে। এই জায়গায় জ্বী হুজুর আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয় নাই। এটা হলো সাধারণ লক্ষণ। এর বাইরে বিশেষ লক্ষণ হলো এই চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র মাদ্রাসা পাশ আবদুর রহমান (সাইমন সাদিক)। যে কিনা শহরে চাকুরীতে যোগ দিতে এসে বাবার বন্ধূর বাড়িতে উঠে।  সেই বাড়িতে বিপরীত সংস্কৃতিক পরিবেশের মুখোমুখি হয়। সমান্তরালে চলতে থাকা আরেক কাহিনীতে থাকেন দেশপ্রেমিক পুলিশ অফিসার ফারুক (জেমি)। রাজনৈতিক তদবিরের  কারণে সন্ত্রাসীদের ধরলেও ছেড়ে দিতে হয়। তাই তিনি তাদের ক্রয়ফায়ারে হত্যা করেন। সেই পুলিশ অফিসার ফারুক সন্ত্রাসীদের আক্রমনে নিহত হন। জীবনের ঝুকি নিয়ে  হত্যা মামলার স্বাক্ষী হন আবদুর রহমান। একজন ঈমানদার মানুষ হিসেবে অন্যায়ের প্রতিবাদ তার কাজ বটে!

 নামটি যদিও আবদুর রহমান কিন্তু নামে নামে যমে টানে নাই। আবদুর রহমান মানে আল্লাহর বান্দার। সে দিক থেকে সবাই আবদুর রহমান। বৈশ্বিক রাজনীতি এবং বাংলাদেশে সংঘটিত নানা ঘটনার কারণে মোল্লা বা হুজুর কথাটার সাথে প্রথমেই জঙ্গী শব্দটা আসে। মোল্লা বা হুজুর টুপি-দাড়ি-জোব্বা সহকারে ভীতিকর চেহারা নিয়ে হাজির হয়। এছাড়া নিজেদের চৌহদ্দির বাইরে সামাজিক রূপান্তরে তাদের সরব উপস্থিতি একপ্রকার চোখেই পড়ে না। নিদেনপক্ষে নারী অধিকার বা সম্পত্তি নিয়ে কথা উঠলে তাদের রাস্তায় এসে দাড়াতে দেখা যায়। কিন্তু এটা অধিকাংশের বৈশিষ্ট্য নয়। আবদুর রহমান- কোন কিসিমের হুজুর যে কিনা আন্তর্জাতিক ক্রাইম সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাড়াচ্ছে! এই সিন্ডেকেটের কাজ হলো দেশের ভেতর সবসময় অস্থিরতা জারি রাখা। এদের কাছে সব রাজনৈতিক দলই সমান।  শক্তিশালী দেশ এই সুযোগে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করে। এই যুগে যা কিছু দৈশিক তা আসলে বৈশ্বিক।

এই প্রথম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে হুজুর প্রধান চরিত্র হয়ে আসলো। মূলধারার বাইরে মাটির ময়না, রানওয়ে (তারেক মাসুদ) বা অপেক্ষার (আবু সাইয়ীদ) বয়ানে যে হুজুরের কথা আসে তারা কেউ জঙ্গী বয়ানের বাইরে নয়। হয় সে জঙ্গী অথবা ভালো মুসলমান (মডারেট বা গুড মুসলমান)। আবার এই ভালো মুসলামানের কিছু টাইপ আছে। তারা বিশেষ ধারার শান্তিতে বিশ্বাসী অথবা ফুল লতা পাতা খচিত মারেফতি বয়ানের মানুষ। সেখানে দিলে কি আছে তা বড়ো জিনিস। দিল হলো খোদার ঘর। তারা যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ভুল পথে করে। এইসব  চলচ্চিত্রের কাজ তাদের পথ ঠিক করে দেয়া। সেখানে বিশেষ ধরণের হুজুরের কথা তোলে কিন্তু সমাজে বিদ্যমান বৃহৎ অংশকে ভুলে যায়। ফলে সেই ক্ষুদ্র অংশ বৃহৎ অংশের প্রতিনিধি হয়ে দাড়ায়। ধর্ম শান্তির পক্ষে সেটাও বিশেষ অর্থে। এই আলোচনা  কোনটা ভালো বা কোনটা মন্দ সেই তরফের নয়। কিন্তু জ্বী হুজুরের হুজুরকে দেখে সিনেমা হলের দর্শকরা তাদের দেখা তরুণ মাদ্রাসা ছাত্রের সাথেই মিল পান বেশি। যারা সমাজের অপরাপর মানুষের মতোই হাজির। তবে তারা এইভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কিনা সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। প্রশ্নটা হলো এই চলচ্চিত্রটি আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার কতো কাছাকাছি।

বিশ্ব রাজনীতির ওয়াজ নসিহতের হাত থেকে দৃশ্যত মুক্ত এই জ্বী হুজুর। সে আল্লাহর বান্দা হয়ে সমাজে নিজের দায়  নিয়ে হাজির। তাই জ্বী হুজুর দেখার জন্য আপনাকে প্রাজ্ঞ হতে হবে না। আবদুর রহমানের মধ্যে হীনমন্যতা নাই। বিশ্বাসের অভাব নাই। সে কোন সম্বন্বয়ের তরিকা নিয়ে হাজির না। এই চলচ্চিত্রে সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ কোন মেটাল ডিটেককর হাজির হয় নাই- প্রশ্ন করে আবদুর রহমান জঙ্গী কিনা। ঠিক যে, রাজুর কাজের জায়গায় এই পরিস্থিতিকে উহ্য রাখা এক অর্থে দুর্বলতা আবার সবলতার বটে। আবার কেন যেন মনে হয় এই অনুপস্থিতি এই চলচ্চিত্রকে মাই নেম ইজ খানের খপ্পর থেকে বাঁচাল।

imagesআবদুর রহমানের বাবার বন্ধুর দুই মেয়ে বান্টি ও বাবলি- যারা শহুরে জীবন যাপনে ত্যক্ত হয়ে গান ধরে ডোন্ট ডিস্টার্ব মি (এই চলচ্চিত্রের গান)। একদম স্টিরিওটাইপ নির্মান। তারা যে ভাষায় হুজুরের আকিদা নিয়ে যে ঠাট্টা করে- তা সমাজে প্রচলিত রূপই। তবে  এই ঠাট্টা এই চলচ্চিত্রের মূল সুর নয়। বান্টি (সারা জেরিন) যে কিনা শ্রেণীগতভাবে উচ্চ শ্রেণীর। সে কোন বিষয়ে সিরিয়াস হতে পারে না। সিরিয়াস হতে গিয়েও ঠাট্টা করে ফেলে। দৃশ্যত এই ঠাট্টা আমাদের সামনে নতুন কিছু হাজির করে না। কিন্তু হুজুরের দাড়ি কাটা হলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তার জন্য দর্শক প্রস্তুত থাকে না। দাড়িভীতির একরৈখিক দৃশ্যেরই চিত্রায়নের আছে ধর্মের আকিদাগত চেহারা। আবদুর রহমানের যে প্রতিক্রিয়া তাতে বুঝা যায় টুপি-দাড়ি ভীতির মর্মের খোজ খুব কম লোকেই জানে। সে দিক থেকে চিন্তা ও কর্মকে এক করে দেখার মহাত্ম্য আছে।। দেহ-মনকে আলাদা করার তরিকাও এই হুজুরের নাই। তাই তাকে সব চিন্তাকেই কর্ম দিয়ে দেখতে হয়। যাকে এই চলচ্চিত্রে  ঈমান বলেছে – শুধুমাত্র অন্তরের বিষয়াশয় হয়ে উঠে না। বরং, বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে স্বতস্ফুর্ত। এর পূর্ণ রূপায়ন ঘটে প্রাণের মায়া না করে হত্যা মামলার স্বাক্ষী হয়ে উঠার মধ্যে। মুভির একদম শেষ দৃশ্যে আবদুর রহমান বান্টিকে বলছে- তোমার প্রতি টান অনুভব করি নাই এমন না কিন্তু আমার সাথে  তোমার জীবন প্রণালী একদম আলাদা। সেখানে আমাকে অন্য কাওকে খুজে নিতে হবে।

এই মুভিতে রাজু প্রত্যেকটা চরিত্রকে আলাদা বৈশিষ্ঠ্যে দাঁড় করিয়েছেন। সুক্ষ সুক্ষ অনেক বিষয়ে তিনি নজর রেখেছেন। যেটা আবার কাহিনীতে মেদ যোগ করেছে। পুলিশ অফিসার ফারুক ব্যক্তিগত জীবনে মদ্যপ কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে সাচ্চা। পুলিশ কমিশনারের বরাতে জানছি পাবলিক ও প্রাইভেটের পার্থক্য। কাজই বড়ো কথা। নিউ লিবারেল পরিসরে এই কথাটা বেশ গুরুত্বের দাবিদার। কিন্তু সেই চরিত্রকে নির্মান করতে গিয়ে রাজু কিছু সময়ের অপচয় করেছেন বটে। দেখাতে চেয়েছেন দেশপ্রেম তাকে নারীর প্রেমে বাঁধা পড়তে দেয়। চেষ্টাটা গতানুগতিক হলেও চিন্তার বিষয় বটে!

রাজনীতির কারণে অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যায়। ক্রসফায়ার এভাবেই বৈধতা পায়। রাজু রেকর্ড সৃষ্টিকারী বাহিনীর কথা না তুলে পুলিশকে সামনে এনে নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু এই নৈতিক সমর্থন ইনসাফের দিকে যাওয়ার পথে বাঁধা। ইতিমধ্যে হত্যা-গুম দিয়ে সেটা প্রমানিত। দেশকে আন্তজার্তিক ষড়যন্ত্রের দিক থেকে দেখা দারুন একটা আইডিয়া। এতে রাজনীতিবিদ এবং দেশের মানুষের জন্য দারুন মেসেজ আছে। কিন্তু চলচ্চিত্রের চিত্রায়ন সিন্ডিকেটকে যথার্থভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ। শক্রকে খুব বোকা ও সহজ টাগের্টই মনে হয়েছে। এটাকে আরো স্মার্টলী পরিবেশন করা যেত। ক্রাইম সিন্ডিকেটের চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তাদের খুবই আনাড়ী অভিনেতা মনে হয়েছে। যা চলচ্চিত্রটির মেরিটকে ব্যাহত করেছে। কাহিনী অনুযায়ী খুব বেশি উপদেশ সর্বস্ব না হওয়ায় কোথাও গতি হারায় নাই।

এই মুভিতে পাঁচটিঁ গান আছে। পাত্র পাত্রীর মেজাজ ধরে গানগুলো তৈয়ার করা। চরিত্রানুযায়ী সফট মেলোডি থেকে রক সবই ছিলো। কিন্তু কথা, সুর ও গায়কী খুবই গতানুগতিক। গানগুলোকে আরো আকর্ষণীয় করা গেলে চলচ্চিত্রটি হয়তো আরো আগ্রহ জাগাতে পারত।  চিত্রগ্রহনকে ভালো বলা যায় না- তবে দৃশ্যান্তরের যোগসুত্র ভালো। দুই- একটি চরিত্রের বাইরে সবাই নতুন অভিনেতা – অভিনেত্রী। রাজু প্রায় সকলের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিয়েছেন। আবদুর রহমান চরিত্রে সাইমন সাদিক অসাধারণ অভিনয় করেছেন। পত্রিকা মারফত জানা গেছে এই চরিত্রে অভিনয়ের আগ্রহ দেখিয়েছিলেন শাকিব খান। রাজু তাকে না নিয়ে যথার্থ কাজ করেছেন। আমরা সম্ভাবনাময় মুখ পেলাম। গতানুগতিক কাহিনীর ভিড়ে এই চলচ্চিত্র নিশ্চয় রাজুকে নিশ্চয় আরেক ধাপ এগিয়ে নিবে।

রেটিং: ৩.৫/৫


Leave a reply