আমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয়েছে : কাজী হায়াৎ
কাজী হায়াৎ— দেশের স্বনামধন্য নির্মাতা। সম্প্রতি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সদস্যপদ প্রত্যাহারে আবেদন করেছেন তার ছবির নাম নিবন্ধন না করায়। এছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে সমিতির সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ ছাপা হয় দৈনিক কালের কণ্ঠে। পুরোটা প্রকাশ হলো বিএমডিবি-তে।
চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। এর জন্য সভাপতি ও মহাসচিবকে দায়ি করছেন। আসলে ঘটনা কী ছিল?
আমার এক বন্ধু প্রযোজক তার ম্যানেজারকে পাঠিয়ে বলল, নাম এন্ট্রির কাগজে সাইন করে দিতে এবং ইচ্ছেমত একটা নাম দিয়ে দিতে। পরবর্তী দিন ম্যানেজার পরিচালক সমিতিতে গেলে তাকে ছবির নাম এন্ট্রি করতে দেয়নি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, তাদের ছবির নাম নিয়ে কোন আপত্তি নেই। সভাপতি গুলজারকে ফোন দিলাম। সে বলে, এটা তো মহাসচিবের কাজ, এরপরও আমি দেখতেছি। এরপর দিন আমি সমিতির অফিসে মহাসচিব খোকনকে জিজ্ঞেস করলে আমাকে বলে, সভাপতি নিষেধ করছে। এরপর আমি সভাপতির জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। সে আমাকে দেখে না দেখার ভান করে ঢুকছিল। পেছন থেকে ডাক দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলে নিষেধের ব্যাপারটি অস্বীকার করে। তারও পরদিন আবার মহাসচিবকে জিজ্ঞেস করলে সে আমাকে শাপলা মিডিয়া তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার কারণে নাম না দেওয়ার বিষয়টি জানায়। তখন আমি সমিতির প্যাড এনে সদস্যপদ প্রত্যাহারের আবেদন করি। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি, চারটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও পাঁচটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়েছি। এ সমিতিতে আমার অনেক অবদান আছে। আমার সাথে এ টালবাহানা আমাকে কষ্ট দিয়েছে। তাই নিজের কাছে নিজে যাতে ছোট না হই এর জন্য এ সিদ্ধান্ত।
ষড়যন্ত্র আছে এর পেছনে কোনো? পরিচালক সমিতির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে আপনার অবস্থান ছিল। মামলার বিষয়টি অজুহাত কিনা?
না আমি এটা মনে করি না। আমার ধারণা একটু অন্য। পুরো চলচ্চিত্র ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তা না হলে এ শিল্প থেকে চলে যাওয়া ব্যক্তিবর্গ— যারা বহুদিন আগে এর ক্ষতি করেছিল, তারা নেতৃত্বে এসেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি জানি বদিউল আলম খোকন যে বাড়িতে থাকে তা তার শ্বশুরের দেওয়া। তার শ্বশুর বাড্ডা থানা জামায়াতে ইসলামীর আমির ছিল। ওই পরিবারের সবাই জামাতপন্থী। সে নিজে কট্টর বিএনপি। একবার শুটিংয়ে সে জনকণ্ঠ ও যুগান্তর সরিয়ে আমার দেশ ও দিনকাল পত্রিকা রেখে শট রিটেক নিয়ে ছিল— শুধুমাত্র পত্রিকাগুলো আওয়ামী লীগপন্থী বলে। মিশা তো জামাতপন্থী বিএনপি সাপোর্টার। আমার দৃঢ় ধারণা এ সরকারের কোন ভালো কাজ কিংবা সফলতাকে তারা ভালো বলতে পারে না। তা না হলে এফডিসির সংবাদ সম্মেলনে তারা বলতে পারে না, প্রয়োজন হলে আমরা প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার বিতরণী বয়কট করব। পরে তথ্যমন্ত্রী সুপারিশ করে তাদের নিয়েছিল অনুষ্ঠানে।
কিন্তু ষড়যন্ত্র আসলে কোন জায়গায়, কী নিয়ে হচ্ছে?
সিনেমা হল হচ্ছে আবেগ তৈরির কারখানা। এ যে আমাদের ধর্ষণ বেড়েছে এর বড় কারণ হচ্ছে সিনেমা দেখা ও বই পড়া কমে যাওয়া। তারা সেটাই হয়ত করতে চাইছে। সিনেমা শিল্পে যে বিভাজন তৈরি হয়েছে তা দূর হোক।
গুঞ্জন রয়েছে আপনাকে জাজ ও যৌথ প্রযোজনা ইস্যুতে সমিতি থেকে নোটিশ করা হয়েছিল। আপনি তার জবাব দেননি। তাই আপনি সদস্যপদ প্রত্যাহারে আবেদন না করলে তারাই আপনাকে বহিষ্কার করত।
এটা পুরোপুরি মিথ্যে কথা। কোন নোটিশ তারা দেয়নি। বরং তারা আমার কাছে ফোন করে তদবির করেছে— সমিতির মিটিংয়ে বলা হয়েছে আমি নাকি ফরম জমা দিইনি। অথচ আমার প্রযোজকের ম্যানেজারকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়টা যেন মেনে নিই। আমি তাদের এ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাকে মানতে পারিনি।
স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক আমি। চলচ্চিত্র বানাতে হলে সমিতির সদস্যপদ লাগে না। আমার ওস্তাদ আলমগীর কবির ছবির পর ছবি বানিয়ে গেছেন সদস্য না হয়েই। তানভীর মোকাম্মেলের তো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার পরেও সদস্যপদ ছিল না।
আপনি তো এর আগেও অনেকবার চলচ্চিত্র ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাহলে যদি আমরা এবারেরটিও প্রচারণা কৌশল হিসেবে ধরে নেব?
না তেমন না ব্যাপারটি। বিদায় নেওয়ার ঘোষণা দিইনি। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে দশ কোটি মানুষ আমাকে চিনে। আট কোটি আমার ফ্যান। এদের অনেকেই আমাকে ফোন করে, দেখা করে— কান্নাকাটি করে বলে, আপনি সিনেমা ছেড়ে যাবেন না। আমরা আপনার সিনেমা আজীবন দেখতে চাই। তাদের জন্য ছেড়ে যেতে চাইলেও যেতে পারি না।
জাজের কট্টর সমালোচক ছিলেন। পরবর্তীতে এখন তাদের সাথে…
না না, আমি কখনই জাজের কট্টর সমালোচক ছিলাম না। আপনি কোথাও পাবেন না এমন। কারণ আমি বাস্তবসম্মত কথা বলি। আমার টেকিনিক্যাল জ্ঞান আছে। যাদের নেই তারা জাজের বিরুদ্ধে কথা বলবে। এখন সরকার যদি ১০০ ডিজিটাল মেশিন দেয় হলে তাহলে কমপক্ষে চারটা মাইক্রোবাস ও ষোল জন ইঞ্জিনিয়ার লাগবে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। জায়গায় জায়গায় অফিস করে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণে কত খরচ তা আমি জানি। ভারতে ১৯ হাজার রুপি দিতে হয় সিনেমা হল প্রতি, যা আমাদের দেশের দ্বিগুণের বেশি। আমি জাজকে নিয়ে বলতাম, জাজ যে ভাড়া নিচ্ছে মেশিন বাবদ তা কমানো উচিত আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে।
জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রযোজনায় ছবি করছেন।
আমার সাথে এরকম কোন চুক্তিপত্র এখনও স্বাক্ষর হয়নি। এখন থেকে দুইমাস আগে— সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র সকল ঘটনার আগে। জাজ থেকে ফোন করে শুধু বলা হল, আপনি আমাদের একটা ছবি করবেন। আমি তখন পাবনায় শুটিংয়ে— অভিনয় করাবেন নাকি পরিচালনা করাবেন তা বুঝতে পারি নাই। পরবর্তীতে তাদের অফিসে আমার সাথে মিটিংয়ে তারা বলে, একটি ছবিতে আপনি অভিনয় করবেন আর আরেকটি ছবি পরিচালনা করবেন। অভিনয়ের ব্যাপারে আমি রাজি হই। কিন্তু পরিচালনার ব্যাপারে আমি বলি, আমার মাথায় অনেকদিন হলো কোন গল্প নেই। আমাকে কিছুদিন সময় দিতে হবে। এ হলো ঘটনা।
আরেকটা কথা আমি ৪৯টি ছবি বানিয়েছি। কোন দিন কোন প্রযোজকের অফিসে গিয়ে তার সাথে ছবি নিইনি। এমনকি একটা পরিচালক কোন ছবিতে অভিনয়ের পরে তার পরের ছবির সময় ফোন করে বলি নাই, ‘আমি কি তোমার এ ছবিতে থাকছি না?’ মান্না ও ডিপজলের ৩টা ছবির ৬ লাখ টাকা সাইনিং মানি ফেরত দিয়েছিলাম, তাদের সাথে ছবি করব না বলে। আমাকে ছবি দিয়ে ধন্য করার বিষয় নেই তো।
যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা নতুন করে হচ্ছে। কী কী দেখতে চান এতে?
আমি যৌথ প্রযোজনার ছবি করিনি কখনও। আমার ‘দাঙ্গা’ ভারতে রিমেক করার অফার এসেছিল। তখন এদেশের ছবি ওখানে রিমেকের সংস্কৃতি এসেছিল— বেদের মেয়ে জোসনা, পিতা মাতা সন্তানসহ অনেক ছবিই হয়েছিল। তো তারা করতো কী— এখনকার ছবির অনেক ফুটেজ, গান ওখানে লাগিয়ে দিত। আমার প্রযোজককে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, সবাই তো তাই করছে। আমি বললাম আমি ফিল্ম স্মাগলিংয়ের সাথে যুক্ত হতে পারব না। পরবর্তীতে তারা তা স্বপন সাহাকে দিয়ে বানালেন।
প্রশ্নটা ছিল যৌথ প্রযোজনার নতুন নীতিমালা নিয়ে…
শিল্পীর কোন জাত নেই, শিল্পের কোন সীমানা নেই। সরকার ও সংশ্লিষ্টরা চিন্তা-ভাবনা করে ভালো একটি নীতিমালা করবে আশা করি। দুই দেশ মিলে যদি দুই দুই চার কোটি টাকার ছবি হবে— এটা ভাল বিষয়। যৌথ প্রযোজনা অব্যাহত রাখা উচিত।
আপনার পরিচালিত ২৬টা ছবি সেন্সর বোর্ডের কাঁচির নিচে পড়েছিল। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন ফিল্ম গ্রেডেশন আইন হচ্ছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এটাকে আমি স্বাগত জানাই। আমি মনে করি সেন্সর শব্দটাই থাকা উচিত না। এ শব্দটি অভিধান খুঁজলে আপনি দেখবেন, প্রাচীন গ্রিসে ব্যবহৃত হত— যারা শাসন করত তাদের সেন্সর বলা হতো। পরবর্তীতে ইংরেজরা সারাবিশ্ব দখল করার পর তারা মিডিয়াকে দখল করার জন্য শব্দটি আরোপ করে। আমি মনে করি কোন স্বাধীন দেশে সেন্সর নামক শব্দটি জীবিত অবস্থায় থাকতে পারে না। এটি পরাধীন দেশের শব্দ। অতএব প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ তিনি এটি বুঝতে পেরেছেন। আমি অনেক খুশি।
একটা বিষয় প্রচলিত— কাজী হায়াত ৮০-৯০ দশকে যে ধরনের ছবি বানাতো কিংবা ছবিগুলো তার যে একটা সিগনেচার ছিল তা পরবর্তীতে তিনি ধরে রাখতে পারেননি। এ অভিযোগ বা অনুযোগের ব্যাখার কীভাবে করবেন?
এটা ব্যাখা কীভাবে করব? কিছু করার নেই। তবে সত্যি কথা বলতে কী সিনেমা হয় পর্যবেক্ষণ থেকে। আগে আমার যেভাবে তৃণমূলে যাতায়ত ছিল তা কমে গেছে। আরেকটা কথা আপনি পত্রিকায় সরকারি নেতা-কর্মী নিয়ে সরাসরি হেডলাইন করে খবর প্রকাশ করতে পারবেন। কিন্তু আমি চাইলে সিনেমায় বিনোদনের মাধ্যমে পুলিশ, সমাজ কিংবা আমলাদের দুর্নীতি দেখাতে পারব না। তাহলে আমি কী দিয়ে ছবি বানাবো? আমাকে তো আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয়েছে।
আগে কী এ বাধাগুলো ছিল না?
অনেকটাই কম ছিল। যদিও আমার অনেক ছবি ব্যান ছিল, তদবির করে ছাড়িয়েছি। যেমন— সিপাহী দুই বছর, আম্মাজান একজন ব্যান ছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে আপনি কী কী ছবি নির্মাণ করবেন?
কাজী হায়াৎ ফিল্মস থেকে ‘রাজা গোলাম’ বানাবো মারুফকে নিয়ে। শাপলা মিডিয়া থেকে ‘আমার স্বপ্ন আমার দেশ’ বানাবো শাকিব খানকে নিয়ে। ‘রাজা গোলাম’ ঈদের পর শুটিং শুরু হবার কথা রয়েছে। কোনটিরই নায়িকা ঠিক হয়নি।