আমাদের অ্যাকশন সিনেমার কান্ডারি জসিম
নব্বই দশকের প্রথম দিকের কথা, রাজশাহীর উপহার সিনেমা হলে জসিমের একটি ছবি দেখতে গেছি বারোটার শোতে, নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। একটি অ্যাকশন দৃশ্য ছিল জসিম গুন্ডাদের ভয় দেখাতে পাশে রাখা ডাবের দোকান থেকে একটি ডাব তুলে তা এক ঘুষিতে ফাটিয়ে দেন, আর তা দেখে মুহূর্তের মধ্যেই যেন সারা সিনেমা হল মুখরিত হয়ে উঠেছে।
মজার বিষয় হলো, সিনেমা দেখে যখন বাইরে এলাম তখন চোখে পড়লো জটলার মতো করে একজন তরুণ একটি ডাব ঘুষি দিয়ে ফাটানোর চেষ্টা করছে। আর তা দেখে উৎসুক জনতারা বলছে ‘ভাই… এটা আমার আপনার দ্বারা সম্ভব না, এটা একমাত্র আমাদের জসিমের দ্বারাই সম্ভব।’
ভাবুন একবার… জসিম কী পরিমাণ জনপ্রিয় ছিলেন যে পর্দায় দেখা তার অ্যাকশনগুলো কতটা বাস্তব হয়ে ধরা দিতো দর্শকদের মনে!
পুরো নাম আবদুল খায়ের জসিম উদ্দিন, যাকে ভালোবেসে এ দেশের সবাই জসিম বলে ডাকেন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম অ্যাকশন দৃশ্যের প্রবর্তক অভিনেতা ও সফল প্রযোজক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যায় তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সৈনিক হিসেবে দুই নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন জসিম। দেশকে ভালোবেসে দেশের কান্ডারি ভূমিকা থেকে আবার চলচ্চিত্রের কান্ডারি হয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন সমানতালে।
জসিমের জন্ম ১৯৫০ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকার নবাবগঞ্জের বক্সনগর গ্রামে। ১৯৭৩ সালে প্রয়াত গুণী পরিচালক জহিরুল হকের পরিচালনায় ঢাকার প্রথম অ্যাকশন দৃশ্য সংবলিত চলচ্চিত্র ‘রংবাজ’ (১৬/০১/১৯৭৩) ছবিতে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। অবশ্য তার ক্যামেরায় প্রথম দাঁড়ানো ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া শেখ লতিফ পরিচালিত ‘দেবর’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে।
মূলত তিনি ‘দেবর’ ছবিটির মাধ্যমেই প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পান, তবে ‘রংবাজ’ তার অভিষেক ছবি। এরপর মুক্তি পায় ‘দেবর’ (০৯/০২/১৯৭৩)।
স্বাধীনতার পর আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রকে এগিয়ে যাওয়ার পেছনে জসিমের অবদান লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে, বাংলা চলচ্চিত্রে মূল অ্যাকশন ধারার প্রবর্তক এবং ‘ফাইটিং গ্রুপ’ এর শুরুটা হয়েছিল এই জসিমের হাত ধরেই। আমান, মাহাবুব খান, আমিন ও জসিম মিলে প্রথম তৈরি করেছিলেন জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপ। যার শুরু ওই ‘রংবাজ’ ছবিতে অ্যাকশন দৃশ্যগুলো সফল ভাবে পরিচালনার মাধ্যমে। পরবর্তীতে অনেক ফাইট ডিরেক্টর ও স্ট্যান্টম্যানরাও জসিমের ছাত্র ছিলেন।
রূপালি পর্দায় প্রথমবার এমন অ্যাকশন দৃশ্যে দেখে যেন দর্শকেরা অভিভূত, সেই সাথে ‘রংবাজ’ও ইতিহাস হয়ে যায় দেশের প্রথম অ্যাকশন ছবির নামের গৌরব অর্জনে।
জসিম পর্দায় এসেছিলেন দুই ধাপে। প্রথম ধাপে তিনি ছিলেন ভয়ংকর মন্দ চরিত্রে আর দ্বিতীয় ধাপে ছিলেন নায়ক চরিত্রে। নায়ক হয়ে প্রথম ছবি ছিল ফখরুল হাসান বৈরাগী পরিচালিত ‘মোকাবেলা’ (২২/০২/১৯৮০), তার নায়িকা ছিলেন সামিনা।
নায়ক জসিম আর ভিলেন জসিম, যেন দুই সফল অধ্যায়ের নাম। ভিলেন জসিম যেমন সব দর্শকদের ভালোবাসায় সিক্ত ছিলেন তেমনি নায়ক জসিমও ছিলেন সমস্ত দর্শকদের মণিকোঠায়। ‘দোস্ত দুশমন’ বা ‘আসামী হাজির’ ছবির ভয়ংকর ডাকু ধর্মার যেমন তিনি, ঠিক তেমনই ‘সবুজ সাথী’ বা ‘সারেন্ডারে’ করা দায়িত্বশীল ভাই এক নিঃস্বার্থ প্রেমিকের সফল চরিত্রের নাম। আশির দশক তো বটেই নব্বই দশকেও যখন সালমান-সানী-আমিন-নাঈমদের দাপট তখনো একজন জসিম সমানভাবে দিয়ে গেছেন একের পর এক সব জনপ্রিয় ছবি।
জসিম একমাত্র নায়ক যিনি ধুন্ধুমার সব অ্যাকশন দৃশ্য দিয়ে দর্শকদের হাততালি অর্জন করে নিতেন, তেমনই আবেগ মাখা অভিনয় দিয়ে দর্শকদের আবেগে জড়াতেন। নীরবে বহু দর্শকদের অশ্রু ঝরাতেন তার আবেগ মাখা কণ্ঠের অভিনয় দিয়ে। এক কথায় বলতে গেলে সে এক অসাধারণ প্রতিভা। আবার মন্দ চরিত্র দিয়েও সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। সে হিসেবে বলতেই হয় এমন ত্রিমুখী অভিনয়ের সফল সাক্ষর আর কোন তারকার ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।
জসিম তার অভিনয় আর দর্শকপ্রিয়তায় এতটাই উচ্চ অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে সে খবর সুদূর ইতালির এক জনপ্রিয় অভিনেতার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। বাংলা চলচ্চিত্রের দলিল-খ্যাত বিখ্যাত সাপ্তাহিক সিনে পত্রিকা ‘চিত্রালী’তে আশির দশকের কোন এক সংখ্যায় নিউজ হয়েছিল, ইতালির একজন জনপ্রিয় অভিনেতা জসিমের সাফল্যকে সাধুবাদ জানিয়ে তার সঙ্গে অভিনয়ের ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত সেই অভিনেতার নামটি কিছুতেই মনে করতে পারছি না।
যাই হোক… ভাবুন একবার, তখনকার দিনে এখনকারের মতো কোন মোবাইল ইন্টারনেটের সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও একজন জসিমের সফলতা ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিল দেশ থেকে বিদেশের গণ্ডিতেও!
ব্যক্তি জীবনে জসিম দুটি বিয়ে করেছিলেন। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ড্রিমগার্লখ্যাত নায়িকা সুচরিতা। পরে ঢাকার প্রথম সবাক ছবির নায়িকা পূর্ণিমা সেনগুপ্তার মেয়ে নাসরিনকে বিয়ে করেন। সে ঘরে তাদের তিন ছেলে রাতুল, রাহুল ও সামি, যারা প্রত্যেকই মিউজিক ব্যান্ডের সঙ্গে জড়িত আছেন!
১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর আমাদের সবার প্রিয় অভিনেতা জসিম মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে পরলোকগমন করেন!
জীবদ্দশায় একটিবারও তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত না করা হলেও তার মৃত্যুর পর তার সম্মানে এফডিসির সর্ববৃহৎ ২ নম্বর ফ্লোরকে জসিম ফ্লোর নামকরণ করা হয়, যা ছিল তার প্রতি সম্মান দেখানোর খুবই প্রশংসনীয় একটি কাজ!
ব্যবহৃত ছবি: সংগ্রহে ফিরোজ এম হাসান (আজাদ আবুল কাশেমের ফেসবুক পোস্ট থেকে)